উম্মে হাবিবা বিনতে আবি সুফিয়ান। ইসলামের একসময়ের অন্যতম দুর্ধর্ষ শত্রুর কন্যা। তার বাবা ছিলেন মক্কার অবিসংবাদিত নেতা। তার মেয়ে স্বামীর সাথেই ইসলাম গ্রহণ করে। যে মেয়েকে তিনি এতদূর পর্যন্ত বড় করেছেন আজ সেই তার শত্রুর দলে যোগ দিচ্ছে! তার পুরো গোত্রের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে!
উম্মে হাবিবা (রা.) রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর অন্য সাহাবিদের মতই বিভিন্ন সমস্যায় ভুগেছেন। তিনি তাদের অনেককেই আবিসিনিয়ায় হিজরত করতে বলেন, অথচ এর নামও মক্কার অনেক মানুষ আগে শুনেনি। অপরিচিত ভূমি, অপরিচিত মহাদেশ, অপরিচিত ভাষা, অপরিচিত সংস্কৃতি। কিন্তু তারা সকল চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলেন যতক্ষণ সেটা আল্লাহর জন্য ছিল।
উম্মে হাবিবা (রা.) তার স্বামী উবাইদুল্লাহ ইবনে আল জাহশ এর সাথে জাহাজে করে লোহিত সাগর পাড়ি দিয়ে আফ্রিকায় পৌঁছান। আবিসিনিয়ার রাজা ছিলেন আল-নাজ্জাশী। তিনি ন্যায়পরায়ণ রাজা হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তার রাজ্যে প্রত্যেকে ন্যায়বিচার পেত। সেখানে যাবার পর সাহাবারা নিজেদের ধর্ম স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে পালনের সুবিধা পেলেন। সেখানে রাজার কাছ থেকেও সুযোগ সুবিধা পেতেন।
উম্মে হাবিবা (রা.) এর পরিবার আবিসিনিয়ায় বসতি গঠনের পর একটি ঘটনা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। উম্মে হাবিবা (রা.) একরাতে স্বপ্নে দেখেন যে স্বামীর সাথে তিনি হিজরত করেছেন তিনিই সাগরে ডুবে যাচ্ছেন। মাঝরাতে ঘুম থেকে তিনি শঙ্কিত হয়ে জেগে উঠলেন। তিনি স্বপ্নের অর্থ বুঝতে পেরেছিলেন কিন্তু তার স্বামীকে তিনি কি দেখেছেন তা বলতে পারছিলেন না।
কিছুদিন পরেই ঘটনাটি ঘটে। তার স্বামী ঘরে ফিরেন নতুন চেহারায়, ভিন্ন আচরণে। তিনি তার মুখ থেকে অ্যালকোহলের গন্ধ পাচ্ছিলেন। তিনি বুঝতে পারলেন তার স্বামী বদলে গেছেন। তার স্বামী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার কি হয়েছে?’
তার স্বামী সত্যকে গোপন করলেন না। তিনি ধর্মান্তরিত হয়েছেন। উম্মে হাবিবা (রা.) নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে বললেন, ‘কিন্তু কেন?’
তার স্বামী শর্ত জুড়ে দিলেন, ‘হয় তুমি তোমার ধর্ম বদলাবে নাহয় আমি তোমাকে ত্বালাক দিব।’
তিনি অনেক বড় পরীক্ষার সম্মুখীন হলেন। তিনি তার পরিবারকে পেছনে ফেলে এসেছেন, গোত্রের সবাইকেই ছেড়ে এসেছেন এই অচেনা জগতে। এই মানুষটিকে সাথে নিয়ে তিনি এতদূর পাড়ি দিয়েছেন কেবলই আল্লাহর জন্য। আজ সেই তাকে ত্যাগ করতে চাইছে! কিন্তু তিনি ঈমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। ইসলামকে ভালোবেসে তাকেই আঁকড়ে ধরলেন এবং ফলাফল হিসেবে ত্বালাক।
এখন উম্মে হাবিবা (রা.) নতুন সমস্যায় পড়লেন। তিনি সকলের থেকে দূরে এই আফ্রিকান ভূমিতে তবে তার সাথে কেবলই রয়েছেন আল্লাহ। নাজ্জাশীর এর দাসের মাধ্যমে তার কাছে সুসংবাদ এল। সে খবর দিল, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদিনা হতে শত মাইলের ব্যবধান সত্ত্বেও তার প্রতি বিবাহের আহবান জানিয়েছেন। তিনি তার কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে উম্মে হাবিবা (রা.) এর আল্লাহর প্রতি ভরসা এবং স্বামীকে ত্যাগের ঘটনাটি পৌঁছে গিয়েছিল। হয়ত এর পুরষ্কারস্বরূপ আল্লাহ তার রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জন্য এই মহান নারীকে বেছে নেন। তিনি তার নেকলেস, ব্রেসলেট সবকিছু এই গরীব দাসকে খুশি হয়ে দিয়ে দিলেন তার কাছে সুখবর নিয়ে আসার জন্য।
নাজ্জাশী ততদিনে মুসলিম হয়ে গিয়েছিলেন এবং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাহাবি হবার স্বীকৃতি পান যদিও তাদের কখনই দেখা হয়নি। নাজ্জাশীর উপর দায়িত্ব ছিল তিনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর পক্ষ হয়ে বৈবাহিক চুক্তি সম্পাদন করবেন। তিনি উম্মুল মু’মিনীন (রা.) কে ব্যাপারটি জানালেন। ফলে তার পক্ষ হতেও আরেকজনকে দায়িত্ব দিতে হত। তিনি খালিদ ইবনে সা’ইদ ইবনে আল-‘আস (রা.) কে নির্বাচন করেন যিনি তার সবচেয়ে নিকটাত্মীয় ছিলেন।
সেই সময়টা আনন্দ ও উৎসবমুখর হয়ে উঠেছিল। কেবল উম্মে হাবিবা (রা.) এর জন্যই নয় বরং পুরো মুসলিম সমাজের জন্য। মদিনার মুসলিমরাও উৎফুল্ল হন।
নাজ্জাশী তার প্রাসাদে বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজনের পরামর্শ দেন। তিনি সকল মুসলিমকে আমন্ত্রণ জানান এবং তার প্রাসাদে সবাই এসে উপস্থিত হয়।
নাজ্জাশী শুরু করেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। আমি নেগাস (নাজ্জাশী), রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর পক্ষ থেকে দায়িত্বে অবতীর্ণ হয়েছি যিনি মদিনায় অবস্থান করছেন তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং রামলা বিনতে আবি সুফিয়ান, উম্মে হাবিবা (রা.) এর মধ্যকার বৈবাহিক চুক্তি সম্পাদনের জন্য।’
উম্মে হাবিবা (রা.) এর পক্ষ হতে খালিদ ইবনে সা’ইদ ইবনে আল-‘আস (রা.) বলেন, ‘আমি উম্মে হাবিবা (রা.) এর পক্ষ থেকে বলছি যিনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর বিয়ের প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন।’
আন-নাজ্জাশী মোহর প্রদান করেন যা ৪০০ দিরহাম নির্ধারিত হয়েছিল। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর স্ত্রীদের মোহরানার মধ্যে এটাই সর্বোচ্চ ছিল। বিবাহ শেষে সবাই চলে যাচ্ছিল তখন নাজ্জাশী তাদের থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘কখনই নয়, আল্লাহর কসম। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সুন্নাহ হচ্ছে বিয়েতে খাবার পরিবেশন করা। আর এখানে তো সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষের বিয়ে সম্পাদিত হয়েছে। আজকে তিনি নতুন উপাধি পেয়েছেন, উম্মুল মু’মিনীন।’
আবিসিনিয়া উদযাপনের ভেতর দিয়ে অতিবাহিত করল যা ইতিহাসে একবারই ঘটেছে এবং কিয়ামতের আগে এর পুনরাবৃত্তি হবে না। যে উদযাপনকে আবিসিনিয়ার গাছপালা, উপত্যকা সবাই মনে রাখবে। উম্মে হাবিবা (রা.) অত্যন্ত খুশী ছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন আল্লাহ তার ধৈর্য্যের এবং দ্বীনের প্রতি অটল থাকার ফসল হিসেবে এত বড় পুরষ্কার দুনিয়াতেই দিয়েছেন।
দশ বছর প্রতিক্ষার পর তিনি তার স্বামী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে মিলিত হবার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। তিনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাথে দেখা করতে যাচ্ছেন এই খবরটি একদিন আগে তাকে এক দাসী মেয়ে এসে জানিয়ে যায়। খুশি হয়ে তিনি তার মোহরানার একটা বড় অংশ তাকে দিয়ে দেন কারণ সে তাকে যে বার্তাটি পৌঁছে দিয়েছে তার মূল্য স্বর্ণ বা রৌপ্যর সাহায্যে কখনই পরিমাপ করা যাবে না। কিন্তু নাজ্জাশী উম্মে হাবিবা (রা.) দাসী মেয়েটাকে যা দিয়েছিলেন তা এবং তারচেয়েও আরো বেশি কিছু দিয়ে তাকে ফেরত পাঠান উম্মে হাবিবা (রা.) এর কাছে।
মেয়েটি উম্মে হাবিবা (রা.) এর ঘরে প্রবেশ করেই বলে উঠল, ‘আশহাদু আল্লাহ ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। আমার সালাম রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে পৌঁছে দেবেন।’ এরপরে সে উম্মে হাবিবা (রা.) এর হাতে চুম্বন করল। সে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছিল কখনো তাকে না দেখেই।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন বলেছিলেন, ‘তোমরা কি আমার ভাইদের দেখেছ?’
এরপর সাহাবিরা বললেন, ‘আমরা কি আপনার ভাই নয় হে আল্লাহর রাসূল?’ আমরা তো আল্লাহর জন্য সবকিছু উৎসর্গ করছি।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জবাব দিলেন, ‘না, তোমরা তো আমার সাথী। আমার ভাই তারাই যারা আমাকে না দেখেই বিশ্বাস করেছে।’
এইপর্যায়ে উম্মে হাবিবা (রা.) মদিনায় তার স্বামীর সাথে দেখা করতে
প্রস্তুত ছিলেন। আবিসিনিয়ায় তার বিদায়বেলা উপস্থিত হয়েছে।
এরপরেই তিনি নাজ্জাশীর ভূমি ত্যাগ করেন।
উম্মে হাবিবা (রা.) এর পিতা আবু সুফিয়ান (রা.) [তখনও তিনি কাফির ছিলেন] যখন মক্কা থেকে মদিনায় সন্ধিচুক্তি করতে আসেন এবং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ঘরে প্রবেশ করেন তখন তার দেখা হয় তার মেয়ের (রা.) সাথে। তিনি দ্রুত মাদুর গুছিয়ে নিলেন। তার পিতা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হয়েছে? আমি কি সেখানে বসার যোগ্য নই নাকি মাদুরটি আমার যোগ্য নয়?’ তিনি বলিষ্ঠ জবাব দিলেন, ‘এই মাদুরে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বসেন। কিন্তু আপনি মুসলিম নন তাই তার জায়গায় আপনি বসতে পারবেন না।’
উম্মে হাবিবা (রা.) আমাদের কাছে পরিচিত শুধু উম্মুল মু’মিনীন হিসেবেই নয় বরং তিনি একজন প্রসিদ্ধ হাদিস বর্ণনাকারী ছিলেন। প্রচুর হাদিস তিনি বর্ণনা করেছেন। তার চমৎকার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল যা তাকে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর অন্যান্য স্ত্রীদের কাছেও ভালোবাসার পাত্রে পরিণত করেছিল।