বিংশ শতাব্দীর শুরুতেও মানুষ এই মহাবিশ্বকে স্থির বিবেচনা করত। তারা ভাবত এই মহাবিশ্বের কোন শুরু বা শেষ নেই। এরকম চিন্তাই বস্তুবাদের জন্ম দেয় এবং স্রষ্টাকে অস্বীকার করতে থাকে। তবে আধুনিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন গবেষণা এবং পর্যবেক্ষণ আমাদের সামনে মহাজাগতিক অনেক তথ্য এনে দিয়েছে। এটা মাথায় রাখতে হবে যে সাইন্স যা বলে তা সবসময়ই শতভাগ সত্য নয় কারণ বিভিন্ন তত্ত্ব প্রতিনিয়তই পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। পূর্বের অনেক তত্ত্ব বাতিলও হয়েছে। তবে এখানে অধিকাংশ বিজ্ঞানীদের দ্বারা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত কিছু বিষয়ে আলোচনা করা হবে।
এসবের মধ্যে একটি হচ্ছে মহাবিশ্বের নিয়মিত প্রসারণ। এই ধারণা প্রথম আসে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে রাশিয়ান পদার্থবিদ আলফ্রেড ফ্রিডম্যান এবং বেলজিয়ান পদার্থবিদ জর্জ লেমাইটারের কাছ থেকে। তারা বিভিন্ন ক্যালকুলেশনের মাধ্যমে দেখান যে এই মহাবিশ্ব নিয়মিত গতিতে প্রসারিত হচ্ছে। পরবর্তীতে ১৯২৯ সালে এই ধারণাকে প্রমাণ করেন এডউইন হাবল। Bill Nyee বলেন:
“এডউইন হাবল রাতের পর রাত তার টেলিস্কোপ দিয়ে মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করতেন। তিনি লক্ষ্য করেন, আকাশের তারকাগুলো নিয়মিত একে অপরের থেকে সরে যাচ্ছে অর্থাৎ তাদের মধ্যবর্তী দূরত্ব বেড়েই চলেছে। যদিও তিনি নিশ্চিত ছিলেন না এমনটা ঘটার কারণ সম্পর্কে।“
ব্রায়ান গ্রিন বলেন: “এই মহাবিশ্ব প্রতিনিয়ত প্রসারিত হয়েই চলেছে। দূরের গ্যালাক্সিগুলো যেন আমাদের থেকে দৌড়ে পালাচ্ছে যা প্রমাণ করে এই বিশ্ব প্রসারণক্ষম। অনেকটা বেলুনের মত। বেলুনকে ফোলালে যেমন এটি প্রসারিত হয়, এই জগতের ক্ষেত্রেও তাই ঘটছে। আল্লাহ কুরআনে এ ব্যাপারটিই ১৪০০ বছর আগেই জানিয়ে দিয়েছেন:
وَالسَّمَاءَ بَنَيْنَاهَا بِأَيْدٍ وَإِنَّا لَمُوسِعُونَ ﴿٤٧﴾
আমি আকাশ নির্মাণ করেছি আমার ক্ষমতাবলে এবং আমি অবশ্যই মহা সম্প্রসারণকারী। (সূরা আয যারিয়াত ৫১:৪৭)
এই প্রসারণকে যদি উল্টিয়ে দেয়া হয়, তাহলে গ্যালাক্সিগুলো একে অপরের কাছাকাছি চলে আসবে যতক্ষণ পর্যন্ত না সবকিছু একটা বিন্দুতে পরিণত হচ্ছে। এর সংকোচনকে আরো এগিয়ে নিলে একপর্যায়ে কিছুই পাওয়া যাবে না। কোন স্পেস, কোন টাইম, কোন এনার্জি, কোন ম্যাটার বলতে কিছুই থাকবেনা। থাকবে কেবল বিশ্বজগত সৃষ্টির কারণটি। আর ‘কারণের‘ জন্যই মহাবিস্ফোরণের ফলে সবকিছুর সৃষ্টি হবে।
এই বিস্ফোরণ ঘটেছিল বলতে গেলে সবজায়গায়। কারণ একদম শুরুতে সবকিছু অত্যন্ত ক্ষুদ্র ছিল। লরেন্স ক্রাউস বলেন,
“সৃষ্টির সময়টি কেমন ছিল তা মানবীয় ভাষায় বর্ণণা করা অসম্ভব। আমরা ধারণা করতে পারি, সে সময়ে অসীম ঘনত্ব, অসীম তাপমাত্রা এবং অসীম পরিমাণ সংঘর্ষ ঘটেছিল।“
بَدِيعُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَإِذَا قَضَى أَمْرًا فَإِنَّمَا يَقُولُ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ ﴿١١٧﴾
আল্লাহ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃজনকারী, যখন কোন কাজ করতে মনস্থ করেন, তখন তার জন্য শুধু বলেন, হয়ে যাও, তক্ষুনি তা হয়ে যায়। (সূরা বাকারা ২:১১৭)
আরবি শব্দ “বেদা‘আ” দ্বারা বোঝায় শুণ্য থেকে কোনকিছু সৃষ্টি করাকে। এখান থেকে এটাও বোঝা যায় যে এই সৃষ্টিটি পূর্বের কোন সৃষ্টির ধরণ মেনে করা হয়নি বরং এটা নিজেই এক নতুন ধরণ। সৃষ্টির সবচেয়ে অসাধারণ ব্যাপার হচ্ছে এর সবকিছুই এসেছে শূণ্য থেকে।
লরেন্স ক্রাউস বলেন:
“আমরা দেখছি যে সবকিছুই এসেছে একদম শুণ্য থেকে। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে ফিজিক্স এই তত্ত্বকে সমর্থন করে। এর অর্থ হচ্ছে আমরা যেই বিশ্বকে দেখছি, যেসব পদার্থ আমাদের চারপাশে আছে এই উৎপত্তিস্থল কেবলই শুণ্যতা।“
শাইখ আহমেদ দীদাত বলেন, “তারা বলে যে এই মহাবিশ্বের জন্ম হয়েছে বিগ ব্যাং এর মাধ্যমে। এই তারাটা কে? জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। আল্লাহ বলেন, “অবিশ্বাসীরা কি দেখেনা?” অবিশ্বাসীরা, নাস্তিকেরা যারা আল্লাহর অস্তিত্বকে অস্বীকার করে তারা কি দেখতে পায় না?
أَوَلَمْ يَرَ الَّذِينَ كَفَرُوا أَنَّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ كَانَتَا رَتْقًا فَفَتَقْنَاهُمَا وَجَعَلْنَا مِنَ الْمَاءِ كُلَّ شَيْءٍ حَيٍّ أَفَلَا يُؤْمِنُونَ ﴿٣٠﴾
অবিশ্বাসীরা কি দেখে না যে, আকাশ আর যমীন এক সঙ্গে সংযুক্ত ছিল, অতঃপর আমি উভয়কে আলাদা করে দিলাম, আর প্রাণসম্পন্ন সব কিছু পানি থেকে সৃষ্টি করলাম। তবুও কি তারা ঈমান আনবে না? (সূরা আল আম্বিয়া ২১:৩০)
আল্লাহ এখানে কাদের কথা বলছেন? কাফিরদের, অবশ্যই। কোন কাফির? ১৪০০ বছর আগের বেদুইন? নিশ্চয়ই নয়। তিনি বিজ্ঞানের এই জগতের লোকদের বলছেন যারা নিজেদের জ্ঞানী বলে দাবী করে। যারা মানুষের কাছে সৃষ্টির ইতিহাসের বিভিন্ন তত্ত্ব কপচে বেড়ায়।“
বিগ ব্যাং এর বিস্ফোরণের পরে কি দেখা যাবার কথা? ধোঁয়া, মেঘাচ্ছন্ন গ্যাস তাইনা? বিজ্ঞান একে বলে নেবুলা। নেবুলা হচ্ছে এক আন্ত:জাগতিক আয়নিত গ্যাসের মেঘপিন্ড যা হিলিয়াম, হাইড্রোজেন, ধূলা ইত্যাদি দ্বারা গঠিত। এখানে কুরআন বলছে:
ثُمَّ اسْتَوَى إِلَى السَّمَاءِ وَهِيَ دُخَانٌ١١
তারপর তিনি আসমানের দিকে মনোনিবেশ করেন। তা ছিল ধোঁয়া। (সূরা ফুসসিলাত ৪১:১১)
অর্থাৎ সেসময় ধোঁয়া ছিল। তবে নেবুলার পরিমাণ ছিল বেশী যেহেতু বিস্ফোরণের পর মাত্র কিছু সময় অতিক্রান্ত হয়েছে।
দুখান বলতে শুধু গ্যাসই বোঝায় না। এর সবচেয়ে কাছাকাছি অর্থ হচ্ছে ধোঁয়া। আর বিজ্ঞান বলছে যেহেতু সেসময়টা অত্যন্ত উত্তপ্ত ছিল তাই তখনকার ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য ধোঁয়া অধিক সঠিক শব্দ। কল্পনা করুন ১৪০০ বছর আগেই কুরআন বলে দিচ্ছে জগতের শুরুতে ধোঁয়ার অস্তিত্ব ছিল যেটা এই বিজ্ঞান মাত্র কিছুদিন আগে আবিষ্কার করেছে। কিভাবে একজন মানুষ ১৪০০ বছর আগে যখন বিশ্বজগতের সৃষ্টি সম্পর্কিত কোন জ্ঞানই ছিল না তখন বিগ ব্যাং, প্রসারণশীল বিশ্বজগত, নেবুলার ব্যাপারে কথা বলতে পারে যেগুলো বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন? এগুলো একটি দিকেই নির্দেশ করে, কুরআন কোন মনুষ্যরচিত বাণী নয় বরং এটি এসেছে এক প্রজ্ঞাময় স্রষ্টার পক্ষ থেকে যিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের ব্যাপারে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জ্ঞাত রয়েছেন।
সৃষ্টির সূচনা কিভাবে হয়েছে তা কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। কুরআনে এসেছে যে, আল্লাহ আসমান ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। হাদিসে এ ব্যাপারে আরও বিশদভাবে এসেছে।
وَ لَقَدۡ خَلَقۡنَا السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ وَ مَا بَیۡنَهُمَا فِیۡ سِتَّۃِ اَیَّامٍ ٭ۖ وَّ مَا مَسَّنَا مِنۡ لُّغُوۡبٍ ﴿۳۸﴾
আর অবশ্যই আমি আসমানসমূহ ও যমীন এবং এতদোভয়ের মধ্যস্থিত সবকিছু ছয় দিনে সৃষ্টি করেছি। আর আমাকে কোনরূপ ক্লান্তি স্পর্শ করেনি। [সুরা কাফঃ ৩৮]
اِنَّ رَبَّکُمُ اللّٰهُ الَّذِیۡ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ فِیۡ سِتَّۃِ اَیَّامٍ ثُمَّ اسۡتَوٰی عَلَی الۡعَرۡشِ ۟ یُغۡشِی الَّیۡلَ النَّهَارَ یَطۡلُبُهٗ حَثِیۡثًا ۙ وَّ الشَّمۡسَ وَ الۡقَمَرَ وَ النُّجُوۡمَ مُسَخَّرٰتٍۭ بِاَمۡرِهٖ ؕ اَلَا لَهُ الۡخَلۡقُ وَ الۡاَمۡرُ ؕ تَبٰرَکَ اللّٰهُ رَبُّ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿۵۴﴾
নিশ্চয় তোমাদের রব আসমানসমূহ ও যমীন ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আরশে উঠেছেন। তিনি রাত দ্বারা দিনকে ঢেকে দেন। প্রত্যেকটি একে অপরকে দ্রুত অনুসরণ করে। আর (সৃষ্টি করেছেন) সূর্য, চাঁদ ও তারকারাজী, যা তাঁর নির্দেশে নিয়োজিত। জেনে রাখ, সৃষ্টি ও নির্দেশ তাঁরই। আল্লাহ মহান, যিনি সকল সৃষ্টির রব। [সুরা আরাফঃ ৫৪]
হাদিস অনুযায়ী আল্লাহ প্রথমে আলো, তারপর অন্ধকার, তারপর বায়ু, তারপর পানি, তারপর পৃথিবী, তারপর আসমান সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি ফেরেশতা, জিন ও মানুষ সৃষ্টি করেছেন।
কুররানে আরও বলা হয়েছে, আল্লাহ আদম আলায়হিস সালামকে মাটি থেকে এবং হাওয়া আলায়হিস সালামকে আদম আলায়হিস সালামের পাঁজর থেকে সৃষ্টি করেছেন। আদম ও হাওয়া আলায়হিস সালাম জান্নাতে বসবাস করছিলেন। কিন্তু তারা আল্লাহর অবাধ্য হলে তাদেরকে পৃথিবীতে নামিয়ে দেওয়া হয়
সৃষ্টির রহস্য ইসলামে যেভাবে উপস্থাপিত হয়েছে তা বেশ সরল এবং যে কারো জন্যই বোধগম্য। এটি বিস্ময়কর এক টপিকও বটে। মুসলিমদের জন্য এটি প্রশান্তি ও অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করে। আমরা দুনিয়া এবং দুনিয়ায় আমাদের অবস্থান কেমন হবে তার একটা ফ্রেইমওয়ার্কও পেয়ে যাই এসব জানার দ্বারা।