আমরা এখানে সংক্ষেপে ইসলামি ওয়ার্ল্ডভিউয়ের মৌলিক উপাদান ও মূল্যবোধের কিছু উদাহরণ তুলে ধরছি। এই মৌলিক উপাদান ও মূল্যবোধগুলোকে ইসলামি জীবনব্যবস্থার অক্ষ ধরা যেতে পারে।
.
১) মহান আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত সব বিষয় স্থায়ী ও অপরিবর্তনীয়। এ সবকিছুর আছে সুনির্দিষ্ট এবং অপরিবর্তনীয় অর্থ। এখানে পরিবর্তনের সুযোগ নেই। মহান আল্লাহর অস্তিত্ব, তাঁর চিরস্থায়ী হওয়া, তাঁর একত্ব, সৃষ্টির ওপর তাঁর ক্ষমতা ও রাজত্ব, তাঁর সার্বভৌমত্বসহ অন্যান্য বৈশিষ্ট্যসমূহ এই স্থায়ী বাস্তবতাগুলোর অন্তর্ভুক্ত।
.
২) আরেকটি স্থায়ী এবং অপরিবর্তনীয় সত্য হলো—মহাবিশ্ব এবং এর মাঝে থাকা সব বস্তু ও প্রাণী মহান আল্লাহর সৃষ্টি। তিনিই এগুলোর উদ্ভাবক। আল্লাহ তাআলা চেয়েছেন বলেই এ সবকিছু অস্তিত্বে এসেছে। সৃষ্টির ক্ষেত্রে আর কারও, আর কোনোকিছুর অংশীদারত্ব নেই। মহান আল্লাহর কোনো শরীক নেই মহাবিশ্বের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কোনো অংশের নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যবস্থাপনাতেও। মহান আল্লাহ তাঁর পবিত্র বৈশিষ্ট্যগুলোতে একক।
.
৩) ইবাদাত শুধু আল্লাহর জন্য। বস্তু, প্রাণী এবং নবি-রাসূলগণসহ সব মানুষ মহান আল্লাহর দাস। মালিক তিনি একাই। মহান আল্লাহর সৃষ্টি হিসেবে সবাই এবং সবকিছু তাঁর গোলাম। মহান আল্লাহর সাথে সৃষ্টিজগতের সম্পর্ক দাসত্বের।
.
৪) ঈমান ছাড়া কাজ অর্থহীন, ঠিক যেমন আমল ছাড়া ঈমান হয়ে পড়ে নিস্তেজ, নিষ্প্রভ। নেক আমলের শর্ত হলো আল্লাহ, ফেরেশতাগণ, আসমানি কিতাবসমূহ, রাসূলগণ, কিয়ামাত এবং তাকদীরে বিশ্বাস। কোনো কাজ মহান আল্লাহর দরবারে গৃহীত হবার শর্ত ঈমান। ঈমান ছাড়া কাজ অর্থহীন, মূল্যহীন, প্রত্যাখ্যাত।
.
৫) মহান আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য একমাত্র দ্বীন হলো ইসলাম। ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো বিশ্বাস কিংবা জীবনব্যবস্থা আল্লাহ গ্রহণ করবেন না। ইসলামের অর্থ এক আল্লাহর ইবাদাত করা, মহান আল্লাহর পবিত্র বৈশিষ্ট্যগুলো কেবল তাঁরই জন্য নির্দিষ্ট করা, সন্তুষ্ট মনে তাঁর হুকুমের সামনে নিজেকে সমর্পণ করা এবং মানবজীবনের সব দিক পরিচালিত করা তাঁর নির্ধারিত শরীয়াহ অনুযায়ী। মহান আল্লাহ ইসলাম এবং শুধু ইসলামকেই মানবজাতির জন্য নির্ধারণ করেছেন।
.
৬) পৃথিবীর সব প্রাণীর মধ্যে মানুষ শ্রেষ্ঠ, কারণ তাকে পৃথিবীতে মহান আল্লাহর প্রতিনিধির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। পৃথিবী ও এর মাঝে যা কিছু আছে সেগুলো মানুষের অনুগত করা হয়েছে। পৃথিবীতে এমন কিছু নেই, যার বস্তুগত মূল্য মানুষের চেয়ে বেশি। এমন কিছু নেই, যার জন্য মানুষকে বিসর্জন দেওয়া যায়।
.
৭) সব মানুষ একই উৎস থেকে এসেছে, এ দিক থেকে সব মানুষ সমান। মানুষের মধ্যে সম্মান ও অবস্থানের পার্থক্য হয় ঈমান, তাকওয়া এবং নেক আমলের ভিত্তিতে। সম্পদ, জাতীয়তা, শ্রেণি, সামাজিক অবস্থান, বর্ণ কিংবা জন্মস্থানের মতো বিষয়গুলোর কারণে কেউ কারও ওপর প্রাধান্য পাবে না।
.
৮) মানুষের অস্তিত্বের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য মহান আল্লাহর ইবাদাত করা। ইবাদাত করার অর্থ মহান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আনুগত্য ও আত্মসমর্পণ। পূর্ণ আনুগত্যের শর্তের মধ্যে আছে জীবনের ছোট-বড় সব ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ এবং কেবল তাঁরই নির্দেশ মেনে চলা। প্রতিটি কাজ, প্রতিটি হৃদস্পন্দন তাঁর ভালোবাসায়, তাঁরই জন্য নিবেদনের চেষ্টা করা।
.
৯) মানুষের মধ্যে সম্পর্কের ভিত্তি হলো ঈমান এবং আল্লাহর নির্ধারিত পথের অনুসরণ। জাতিগোষ্ঠীগত পরিচয়, বর্ণ পরিচয়, জাতীয়তা, আঞ্চলিক পরিচয়, শ্রেণি পরিচয়, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কিংবা অন্য কোনো দুনিয়াবি উদ্দেশ্য—সম্পর্কের ভিত্তি নয়।
.
১০) দুনিয়ার জীবন হলো পরীক্ষা। এ পরীক্ষা বিশ্বাস ও আমলের। আখিরাতের জীবন হলো হিসাব ও প্রতিদানের। দুনিয়াতে কাটানো প্রতিটি মুহূর্তের হিসেব রাখা হচ্ছে। পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে প্রতিটি কাজ, প্রতিটি উচ্চারণ, ভালো-মন্দ যেকোনো ঘটনার প্রেক্ষিতে প্রতিটি প্রতিক্রিয়া। আর এ সবকিছুর হিসেব নিয়ে চূড়ান্ত ফায়সালা করবেন মহান আল্লাহ, যিনি সর্বোচ্চ বিচারক।
.
ইসলামি ওয়ার্ল্ডভিউয়ের এই সবগুলো উপাদান ও মূল্যবোধ স্থায়ী। এগুলোতে কোনো ধরনের কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয়। মানুষের জীবন ও জীবনধারা এই অপরিবর্তনীয় কাঠামোর সাপেক্ষে গতিশীল থাকবে। এই স্থায়ী উপাদান ও মূল্যবোধগুলো বাস্তবায়নের চেষ্টা করতে হবে ইসলামি সমাজের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে, সমাজের সব ধরনের সম্পর্কের মধ্যে, জীবনকে সংগঠিত করার সব প্রচেষ্টায়। এই মূল্যবোধগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে ব্যক্তি ও সামাজিক পর্যায়ে, সব ধরনের পরিবেশে, সব ধরনের প্রেক্ষাপটে।
– সাইয়্যিদ কুতুব রাহিমাহুল্লাহ