ঢাকা ওয়াসার কাছে সরকারের বকেয়া পাওনা মাত্র চার বছরের ব্যবধানে বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এ বকেয়া এখন ২৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। মূলত সংস্থাটির বাস্তবায়নকৃত ও চলমান প্রকল্পের জন্য স্থানীয় এবং বৈদেশিক ঋণ বাবদ নেওয়া হয়েছে বিপুল অঙ্কের এই অর্থ।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা ওয়াসার একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বিদেশি ঋণে প্রকল্প নিলেও ওয়াসার অদক্ষতায় সেগুলোর সুফল মিলছে না। ডলারে এসব ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হয়। তাই চাপ পড়ছে দেশের অর্থনীতিতে, দায় চাপছে জনগণের কাঁধে। কিস্তি পরিশোধে ওয়াসাকে এখন বেশি টাকা পরিশোধ করতে হওয়ায় পানির দামও বাড়াতে হচ্ছে।
বিদেশি ঋণে প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও প্রতিষ্ঠানটির অদক্ষতায় সেগুলোর সুফল মিলছে না। ডলারে এসব ঋণের কিস্তি পরিশোধ করার কারণে চাপ পড়ছে দেশের অর্থনীতিতে।
স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্র বলছে, গত ২২ জানুয়ারি ঢাকা ওয়াসার বকেয়ার বিষয়ে অর্থ বিভাগ থেকে স্থানীয় সরকার বিভাগে চিঠি পাঠানো হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বকেয়া টাকা জমা দেওয়ার বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ।
চিঠিতে বলা হয়, সরকার বিভিন্ন সময়ে যে ঋণ দেয়, তা পরিশোধসূচি অনুযায়ী ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের পরিশোধ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সূচি অনুযায়ী ঋণের অর্থ পরিশোধ না করলে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সরকারের বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়। ঢাকা ওয়াসার সঙ্গে অর্থ বিভাগের স্বাক্ষরিত লোন অ্যাগ্রিমেন্ট বা এলএ (ঋণচুক্তি) ও সাবসিডিয়ারি লোন অ্যাগ্রিমেন্ট বা এসএলএ (সম্পূরক ঋণচুক্তি) অনুযায়ী, বকেয়ার পরিমাণ ২৪ হাজার ৩৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।
ওয়াসাকে দেওয়া এ চিঠিতে স্থানীয় এবং বৈদেশিক ঋণের আসল ও সুদ (ডিএসএল) নির্ধারিত অর্থনৈতিক কোডে জমা দিতে বলা হয়।
উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থের উৎস দুটি—বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন ও উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে পাওয়া প্রকল্প সহায়তা বা ঋণ। বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে পাওয়া প্রকল্প সহায়তা/ঋণ গ্রহণকারী সংস্থার অনুকূলে বাংলাদেশ সরকার বিনিয়োগ করে। এ ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষে অর্থ বিভাগ ও ঋণ গ্রহণকারী সংস্থার মধ্যে একটি চুক্তি হয়, যা সম্পূরক ঋণচুক্তি নামে পরিচিত।
অন্যদিকে সরকারের নিজস্ব সম্পদ থেকে স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ দেওয়ার সময় অর্থ বিভাগের সঙ্গে ঋণ গ্রহণকারী সংস্থার যে চুক্তি হয়, সেটি ঋণচুক্তি হিসেবে পরিচিত। আর ঋণ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো চুক্তি অনুযায়ী সরকারকে কিস্তির টাকা বাবদ যে অর্থ পরিশোধ করে, তা পরিচিত ডেট সার্ভিস লায়াবিলিটি (ডিএসএল) হিসেবে।
এক যুগ আগেও ঢাকা ওয়াসার ঋণ ছিল শূন্যের কোঠায়। অর্থ বিভাগের ডিএসএল হিসাব বিবরণীর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরেও প্রতিষ্ঠানটির ডিএসএলের পরিমাণ ছিল ১২ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। এখন তা ২৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ চার বছরে ঢাকা ওয়াসার কাছে সরকারের পাওনা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
বকেয়া পাওনার বিষয়ে জানতে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খানের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছিল। তবে তাঁর সাড়া পাওয়া যায়নি।
বকেয়ার বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার উপপ্রধান জনতথ্য কর্মকর্তা এ এম মোস্তফা তারেক বলেন, চিঠিতে বকেয়ার যে তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে, তা সঠিক নয়। ঢাকা ওয়াসা নিয়মিত ডিএসএল পরিশোধ করে আসছে।
ঋণ নিলেও মিলছে না সুফল
ঋণের টাকায় বাস্তবায়ন করা ওয়াসার প্রকল্পের সুফল মিলছে না। যেমন পদ্মা নদীর পানি পরিশোধন করে রাজধানীতে সরবরাহ করতে বাস্তবায়ন করা হয়েছে একটি প্রকল্প। চালুর তিন বছর পরও শোধনাগারের সক্ষমতার এক-তৃতীয়াংশের বেশি অব্যবহৃত থাকছে।
আরেকটি প্রকল্পের অধীন দাশেরকান্দি এলাকায় পয়ঃশোধনাগার নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু নির্ধারিত এলাকা (ক্যাচমেন্ট এরিয়া) থেকে পয়ঃবর্জ্য শোধনাগার পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য এখন পর্যন্ত পাইপলাইন তৈরির (নেটওয়ার্ক) কাজ শুরু হয়নি।
এ ছাড়া ঢাকা ওয়াসার বাস্তবায়নাধীন অধিকাংশ প্রকল্পই নির্ধারিত সময় ও খরচে শেষ হচ্ছে না। একাধিকবার প্রকল্পের মেয়াদ ও বরাদ্দের অর্থ বাড়ানোর পরও কাজ অসমাপ্ত থাকছে।
গত ১৩ বছরে ১৪ বার ঢাকায় পানির দাম বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে আরেক দফা পানির দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে ঋণ পরিশোধের বিষয়টি সামনে আনে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। সংস্থাটি বলে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ওয়াসার বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধের পরিমাণ বেড়ে গেছে।
ঢাকা ওয়াসার অদক্ষতার কারণে প্রকল্পগুলো থেকে কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া যাচ্ছে না বলে মনে করেন নগর গবেষণা ও নীতি বিশ্লেষণকারী প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান।
আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, পরিকল্পনাগত ও অর্থনৈতিক বিবেচনায় বাস্তবসম্মত ও টেকসই না হওয়া সত্ত্বেও বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক ঋণে একের পর এক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এ ধরনের প্রকল্প দেশের সার্বিক অর্থনীতির ওপর চাপ ফেলেছে, যা এখন দৃশ্যমান হচ্ছে। ফলে পানির দামও বাড়াতে হয়েছে।