রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর পূর্ণ হওয়ার পথে। দীর্ঘ এই সময়ে ইউক্রেনীয়দের নেতৃত্ব দিয়ে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি।
এরই মধ্যে এবার নতুন এক যুদ্ধে জড়ালেন তিনি। যুদ্ধটা দুর্নীতির বিরুদ্ধে। আর এই দুর্নীতির অভিযোগগুলো উঠছে তাঁরই প্রশাসনের সব রাঘববোয়ালের বিরুদ্ধে।
জেলেনস্কির দুর্নীতিবিরোধী লড়াইয়ের শুরু গত সপ্তাহে; ইউক্রেনের সংবাদমাধ্যম ‘জেডএন ডট ইউএ’র একটি প্রতিবেদন প্রকাশের মধ্য দিয়ে। সেখানে দেশটির সামরিক বাহিনীর খাদ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও লুটপাটের চিত্র তুলে ধরা হয়। বলা হয়, কিয়েভের বাজারে খাদ্যপণ্যের যে দাম, তার চেয়ে তিন গুণ বেশি দাম দিয়ে খাবার কেনা হচ্ছে সামরিক বাহিনীর জন্য।
ওই প্রতিবেদনের শিরোনামটি ছিল ‘প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পেছনের সারির ইঁদুরগুলো এখন সামরিক বাহিনী থেকে আরও খাবার চুরি করছে’। শিরোনামে, এমনকি প্রতিবেদনে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওপর দুর্নীতির দায় চাপানো হলেও, নিজেদের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেকসি রেজনিকভ। তাঁর ভাষ্যমতে, যুদ্ধক্ষেত্রে সম্মুখসারির সেনাদের কাছে খাদ্য সরবরাহে নানা বাধাবিপত্তির কারণেই দামে এই বাড়াবাড়ি।
ইউক্রেনের গণমাধ্যমে আরও একটি গুঞ্জন ছড়িয়েছে, প্রধানমন্ত্রী ডেনিস শ্যামিহালসহ আরও তিন মন্ত্রী পদচ্যুত হওয়ার চিঠি পেতে পারেন।
যা–ই হোক না কেন, দুর্নীতির দায় সরাসরি এড়িয়ে গিয়ে নিজের পদ এখনো ধরে রেখেছেন রেজনিকভ। তবে গত রোববার থেকে ইউক্রেন সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে চাকরিচ্যুত হওয়া ও পদত্যাগের যেন হিড়িক পড়েছে। এই কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন প্রতিরক্ষা উপমন্ত্রীসহ আরও তিনজন উপমন্ত্রী, প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের উপপ্রধান, পাঁচজন গভর্নর, পাঁচজন সরকারি কৌঁসুলি এবং সরকারের দুটি সংস্থার প্রধান।
ইউক্রেনের দুর্নীতি দমন কর্তৃপক্ষ ও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের তথ্য অনুযায়ী, এই কর্মকর্তাদের ছয়জন দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। গণমাধ্যমে আরও একটি গুঞ্জন ছড়িয়েছে, প্রধানমন্ত্রী ডেনিস শ্যামিহালসহ আরও তিন মন্ত্রী পদচ্যুত হওয়ার চিঠি পেতে পারেন।
এসব থেকে এটাই পরিষ্কার যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে রয়েছেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। গত রোববার টেলিভিশনে দেওয়া বক্তব্যে এমন ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমি এটা খোলাখুলিভাবে বলতে চাই, এত দিন যা হয়েছে, তা আর এখন হবে না।’
এদিকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই শুরুর পর যুদ্ধক্ষেত্রেও বড় অগ্রগতি পেয়েছে ইউক্রেন। বহুদিন ধরে জল ঘোলা করার পর গত মঙ্গলবার কিয়েভকে ১৪টি অত্যাধুনিক লেপার্ড–২ ট্যাংক দিতে রাজি হয়েছেন জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ। এমনকি বলেছেন, জার্মানি থেকে কেনা লেপার্ড–২ ট্যাংক অন্য কোনো দেশ ইউক্রেনকে দিতে চাইলেও আপত্তি নেই তাঁর।
গত ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরু পর থেকেই রাশিয়া ও ইউক্রেন—দুই পক্ষই সেকেলে সোভিয়েত আমলের ট্যাংক ব্যবহার করছে। এমন পরিস্থিতিতে গত কয়েক মাস ধরে পশ্চিমা মিত্রদের কাছে লেপার্ড–২–সহ ভারী ট্যাংক ও সাঁজোয়া যানের দাবি করছিল কিয়েভ। এই যেমন গত ডিসেম্বরে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল ভারেলি জালুঝনি বলেছিলেন, রুশ সেনাদের ইউক্রেন থেকে তাড়াতে তাঁর ৩০০টি ট্যাংক, ৬০০ থেকে ৭০০টি সাঁজোয়া যান ও ৫০০টি হোইৎজার কামান লাগবে।
জেলেনস্কির দুর্নীতিবিরোধী যুদ্ধ শুরুর পরপরই জার্মানির ট্যাংক দিতে রাজি হওয়া কাকতালীয় কোনো ঘটনা নয় বলে মনে করছেন জার্মানির ব্রেমেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ নিকোলে মিত্রখিন।
জার্মানির মন গলার পেছনে দুর্নীতিবিরোধী যুদ্ধ?
জেলেনস্কির দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরুর পরপরই জার্মানির ট্যাংক দিতে রাজি হওয়া কাকতালীয় কোনো ঘটনা নয় বলে মনে করছেন জার্মানির ব্রেমেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ নিকোলে মিত্রখিন। তাঁর ভাষ্যমতে, ২০ জানুয়ারি জার্মানির রামস্টেইন সামরিক ঘাঁটিতে ইউক্রেনের মিত্রদেশগুলো আলোচনায় বসেছিল। সেখানে অনেক দেশই কিয়েভকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তবে বার্লিন ট্যাংক দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে যায়। এতে করে ইউক্রেন ও তার মিত্রদেশগুলো বড় ধাক্কা খেয়েছিল।
নিকোলে মিত্রখিন বলেন, এরপরই একটি সংবাদমাধ্যমের খবরের ধাক্কায় ইউক্রেনের বড় বড় অনেক কর্মকর্তার পতন শুরু হলো। তখন থেকে বদলে যায় সবকিছু। ইউক্রেনকে ট্যাংক দিতে মিত্রদেশগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাল। এমনকি যে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম দিকে তাদের ট্যাংক দিতে চাচ্ছিল না, তারাও মত বদল করে গত মঙ্গলবার এম–১ আব্রাম ট্যাংক দিতে রাজি হয়েছে।
জার্মান সরকারের বড় কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে উল্লেখ করে নিকোলে মিত্রখিন বলেন, জার্মানি যেসব কারণে ট্যাংক দিতে রাজি হয়েছে, তার মধ্যে ইউক্রেনে দুর্নীতিবিরোধী যুদ্ধ শুরুর কোনো ভূমিকা নেই, তা কেউ জোর গলায় বলতে পারবে না।
তবে এমন ধারণা মানতে নারাজ ইউক্রেনের অনেক বিশেষজ্ঞ। তাঁদের একজন কিয়েভভিত্তিক বিশ্লেষক ইগার তিশকেভিচ। তিনি বলেন, ট্যাংক সরবরাহে জার্মানির রাজি হওয়ার পেছনে ইউক্রেনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের পদত্যাগ বা চাকরিচ্যুতি কোনো কারণ নয়। পদত্যাগ বা চাকরিচ্যুতি করা হচ্ছে ওই কর্মকর্তাদের কাজে অদক্ষতা ও দুর্নীতির অভিযোগের ভিত্তিতে। কিয়েভভিত্তিক আরেক বিশ্লেষক আলেকসে কুশচের অভিমতও হুবহু একই। তিনি বলেন, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে এই পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি বহু আগে থেকেই ইউক্রেনের জনগণ ও পশ্চিমা মিত্রদের ছিল।
তবে ইউক্রেনে এমন দুর্নীতি প্রকাশ্যে আসার ঘটনা আগেও ঘটেছে। ইউক্রেনের অস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ‘ইউক্রোবোরোনপ্রম’ দুর্নীতিতে জড়িত থাকার তথ্য সামনে এসেছিল। বর্তমানে সংগঠনটিতে বড় ধরনের সংস্কার আনা হচ্ছে।
এর আগে ২০১৯ সালে তদন্তে উঠে আসে ইউক্রেনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পেত্রো পোরোশেঙ্কোর ছেলের বন্ধু ওলেহ হ্লাদকোভস্কি রাশিয়া থেকে পুরোনো সামরিক সরঞ্জাম এনে দুই থেকে তিন গুণ বেশি দামে ইউক্রেন সেনাবাহিনীর কাছে বিক্রি করেছিলেন। সে বছরেই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ছিল। ছেলের বন্ধুর দুর্নীতির ঘটনা সামনে আসায় নির্বাচনের আগে পেত্রো পোরোশেঙ্কোর জনসমর্থনে বড় ধস নেমেছিল।
আল–জাজিরা থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদকৃত।