আমার স্বামী যখন প্রথমবার আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন, আমি না বলেছিলাম। আমার বয়স তখন ১৮। তখন ইউনিভার্সিটির নবীন ছাত্রী আর নিজেকে নারীবাদী মনে করতাম।
আলহামদুলিল্লাহ, উনি পরবর্তীতে আবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন এবং আমাদের বিয়ে হয়েছে। সে সময় আমার বয়স ছিল ২১। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ তায়ালা আমার জীবনে যেসব নিয়ামত দান করেছেন তারমধ্যে বিয়ে অন্যতম।
আমি যখন বিয়ে নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা শুরু করি তখন একজনের ছবি অনবরত আমার মাথায় ঘুরছিলো। গল্পটা বলি!
একজন মহিলার ছবি!
হাই-স্কুল থাকাকালীন সময়ে একটা ক্যাফেতে পার্টটাইম কাজ করতাম, সেখানেই তার সাথে পরিচয়। ধরে নিই ওর নাম হানান। হানান ৩২ বছর বয়সের একজন মরোক্কান বোন। তিনি ফুলটাইম ওই ক্যাফেতে কাজ করতেন, সেখানেই তার সাথে দেখা। হানানের ডান হাতের একটা আঙ্গুল বাঁকা ছিল, একদিন সে আমাকে তার বাঁকা আঙুলের কাহিনী বলল।
হানান বিয়ে করেছিল একজন কনভার্ট ল্যাটিনোকে। তাকে হানানের বেশ মজার আর রোমাঞ্চকর মনে হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের পরে দেখা গেল তার প্রত্যাশা আর বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিয়ের পর কোনো এক ঝগড়ায় স্বামী তার আঙ্গুল ভেংগে দেয়।
যাইহোক, পরে তাদের ডিভোর্স হয়। জীবনযাপনের জন্য অর্থোপার্জনের চেষ্টা করতে করতে সে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে ওই বাঁকা আঙুল ঠিক করার জন্যে কোন ডাক্তারের কাছে যাওয়া হয়নি।। খুব লোমহর্ষক গল্প!
তাই আমার মত একজন ইউনিভার্সিটির ছাত্র যখন আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় তখন হানানের ছবিই আমার মাথায় বারবার হানা দিচ্ছিল!
আপনাদের কি মনে হয় এটা ভাল? বা স্বাভাবিক? সুস্থ ?
আমি মনে করি না।
হাই স্কুল এবং ইউনিভার্সিটির প্রথম বছরগুলিতে আমি গভীরভাবে ফেইক নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করতাম। আমি ভাবতাম বিয়ে হল একটা ফাঁদ এবং মহিলাদের জন্য নিশ্চিত নির্যাতিত হওয়ার মাধ্যম!
আমি ভাবতাম পুরুষরা মূলত জানোয়ার যারা কেবল একটি জিনিস ই চায়। ভাবতাম বাচ্চাদের জন্ম দেওয়া মানে নিজের জীবন বেচে দেয়া! ভাবতাম স্ত্রী, মা হওয়া মানে মূলত দাসত্বে প্রবেশ করা!
কি অসুস্থ!! কি অসুস্থ চিন্তাভাবনা!!
নারীবাদ আমার মন-মস্তিষ্কের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে চিন্তাভাবনাকে বিকৃত করে দিয়েছিল। নির্দোষ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত সকল পুরুষকে আমার কাছে সহজাতভাবে খারাপ এবং সন্দেহযুক্ত মনে হত।
এইভাবে, নারীবাদ নারীদেরকে পুরুষদের মুখোমুখি শত্রু হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেয়। নারী পুরুষের সহজাত স্বাভাবিক সামাজিক ভূমিকাকে নষ্ট করে এবং পরিবারকে অস্থিতিশীল করে তোলে।
আলহামদুলিল্লাহ, আমি অনেকদিন আগেই আমার নারীবাদী বিভ্রম থেকে বেরিয়ে এসে একজন স্বাভাবিক, ভারসাম্যপূর্ণ মানুষ হয়েছি। আমি বুঝতে পেরেছি যে “পুরুষ মাত্রই প্রতিদ্বন্দ্বী” মানসিকতা কতটা বিকৃত আর বিভ্রান্ত!
তবে আজ, সাধারণ মুসলিম সম্প্রদায়ে এই অসুস্থতা আরও বেশি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কেউ একজন আমাকে “আইডিয়াল মুসলিমাহ” নামক একটি পেইজের সাম্প্রতিক জনপ্রিয় পোস্ট নিয়ে মতামত জানাতে বলেছিলেন। পোস্টের বিষয়বস্তু ছিল মূলত- মুসলিম পুরুষেরা নানা ভাবে অত্যাচার করে তাই মুসলিম মহিলাদের বিয়ের ব্যাপারে সতর্ক করা।
তাদের দেওয়া পরামর্শগুলো ছিল- দেরিতে বিয়ে করা আর পুরুষের মধ্যে পরকীয়া করা, প্রতিপত্তি দেখানো, কৃপণতা, মেয়েদের সাথে মেলামেশা করা, কর্তৃত্ববাদ, স্বৈরাচার , গ্যাসলাইটিং এর স্বভাব- এসবের দিকে নজর রাখা।
ওই পোস্টের লক্ষ্য হলো মূলত মুসলিমাহদের অল্প বয়সে নয় বরং দেরীতে বিয়ে করতে উত্সাহ দেয়া। বিবাহ বিচ্ছেদ এবং অবিবাহিত জীবন বেছে নেওয়া- কারন পুরুষেরা অত্যাচারী। পোস্টটিতে দুই হাজারেরও বেশি লাইক আছে। দুই হাজার মুসলিম নারী এটি পড়েছে এবং একমত হয়েছে।
নারীবাদ এটিই করে। যদিও পোস্টটির লেখক বলেছেন যে এটি নাকি নারীবাদী বা লিবেরাল লেখা নয়.. কিন্তু আমি জানি, কম বয়সে এই নারীবাদী মানসিকতায় আমিও ব্রেনওয়াশড ছিলাম।
এই নারীবাদী মানসিকতার ফলে সূক্ষভাবে অবিরত পুরুষদের দোষারোপ আর সমালোচনা করা হয় এবং নারীদের ভিক্টিম ধরে নেয়া হয়।
পুরুষ = দুর্বৃত্ত এবং অত্যাচারী
মহিলা = নির্যাতিত এবং ভুক্তভোগী
এটা অল্প বয়সী মুসলিম মেয়েদের মধ্যে এক ভয়ংকর বিপজ্জনক বিভক্তি। উপরুন্তু এটা অসত্য।
অবশ্যই কিছু অমানুষ পুরুষ আছে যাদের স্বভাব চরিত্র খারাপ, ঈমানও দুর্বল। একইভাবে কিছু অমানুষ মহিলাও আছে যাদের স্বভাব চরিত্র খারাপ এবং ঈমা্নও দূর্বল। এমন পুরুষ আছে যারা নারীদের সুবিধা নেয় এবং এমন নারী ও আছে যারা পুরুষদের সুবিধা নেয়।
বয়স বেড়েছে, জীবনে কমবেশি অনেক কিছু দেখেছি।নারীদের দ্বারা পুরুষদের নির্যাতিত, প্রতারিত এমনকি মারধরের ভয়ানক ঘটনাও দেখেছি।
এখন একটা বিশেষ গল্প বলি। এক ব্যক্তি, ধরি তার নাম তামের। সে এক মহিলাকে বিয়ে করে এবং দুই কন্যার বাবা হয়।
স্ত্রী বরাবরই স্বার্থপর, উচ্চ চাহিদাসম্পন্ন এবং একরোখা মহিলা ছিল, কিন্তু কন্যাদের স্বার্থে তামের তাকে সহ্য করতো।
মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে আক্রমণাত্মক, দুর্ব্যবহারকারী একজন মানুষের সাথে এই সংসার করে যাচ্ছিল তামের। স্ত্রীর নিপীড়ন সহ্য করে নিয়ে সে তার মেয়েদেরকে ভালোবাসা দিয়ে যেতে লাগলো।
ওদিকে তামেরের স্ত্রী নামাজ পড়া বন্ধ করে দিল, হিজাব খুলে ফেলল, নাকে প্লাস্টিক সার্জারী করালো এবং পরবর্তীতে প্রকাশ্যে ইসলাম ত্যাগ করলো।
সে পরকীয়া শুরু করলো। একাধিক পুরষের শয্যাসংগী হয়। এসব কুকর্ম হাতেনাতে ধরার পরেও সে অনতপ্ত বা লজ্জিত হল নয়া বরং মুখের উপর তামেরকে অপমান করতো।
শেষমেশ তামেরের স্ত্রী বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করে। তামের দেখলো আদালতে দাঁড়িয়ে কি সুন্দর মিথ্যা বলে যাচ্ছে তার স্ত্রী!!
তার অভিযোগ তামের তাকে মারধর করে, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে!
“ধর্মীয় নির্যাতন!” এর কথাও সে উল্লেখ করে! আরব মুসলিম তামেরকে সে সন্ত্রাসী বলেও অভিযুক্ত করে।
দুঃখভরা চোখে কুমিরের অশ্রু নিয়ে কোর্টরুমে সবার সামনে চমৎকার পারফর্ম করে সে। দুর্দান্ত অভিনয় জানে বটে!
তামের সেখানে দাঁড়িয়ে তার নাট্ক দেখে হতবাক হয়ে গেল। সে শুকনো চোখেই সব দেখলো কারন এক আরব পরিবারের পুরুষ হিসেবে সে জনসাধারণের সামনে কাঁদতে পারে না।
স্বাভাবিক ভাবেই বিচারক মহিলাকে বিশ্বাস করেছে কারণ সে একজন অসহায়, নিপীড়িত মুসলিম মহিলার ছাঁচে পুরোপুরি মিলে যায়। আর তামের মিলে যায় একজন নিপীড়ক মুসলিম পুরুষ হিসেবে।
বিবাহবিচ্ছেদের পরে, তামেরকে সে মহিলা টাকার জন্য চেপে ধরে। তামের ছোট একটা ব্যবসায়ের মালিক ছিল যা স্ত্রী তাকে বন্ধ করতে বাধ্য করছিল এবং তামেরের সমস্ত সঞ্চয় নিয়ে নিয়েছিল। এমনকি তার দামী বিবাহবিচ্ছেদ আইনজীবীর ফিস ও তামেরকে দিতে বাধ্য করেছিলো।
তবে সন্তানদের নিয়ে মহিলা যা করেছিল তার তুলনায় এগুলো কিছুই নয়। তামেরের পুরো জগত জুড়ে থাকা ভালোবাসার মেয়ে দুটির পুরো জিম্মাদারী সে আদালত থেকে পেয়েছিল। বেশ কয়েক বছর সে তাদের সাথে তামেরকে দেখা করতে দেয়নি। বড় মেয়েটা তার ভালোবাসার বাবাকে মনে রাখার মত যথেষ্ট বড় ছিল এবং সে প্রায়শই বাবার জন্য কাঁদতো, কেন বাবাকে দেখতে পাচ্ছে না এসব জিজ্ঞাসা করতো মা কে। মা নির্লিপ্ততার সাথে মিথ্যা বলে যেত, তাদেরকে বলা হতো যে বাবা তাদের পছন্দ করে না, তাদের ব্যাপারে মাথা ঘামায় না এবং আর কখনও তাদের দেখতে চায় না। মায়ের চোখের সামনে মাসের পর মাস প্রতি রাতে মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমাতো আর ধীরে ধীরে নিজেকে সব কিছু থেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করলো। তাও মায়ের মন গলেনি।
এদিকে, তামেরের রাত কাটে নির্ঘুম চোখে আর চোখের জলে। তার মেয়েরা ছিল তার জানপ্রান। তার সন্তানদের তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে আর এই ব্যাপারে তার কিচ্ছু করার ছিল না। প্রাক্তন স্ত্রী ইচ্ছাকৃতভাবে তার জীবনের একমাত্র আলো কেড়ে নিয়েছিল, যে কন্যাগুলির জন্যই এতদিন সে বেঁচে ছিল। কেবল তামেরকে আরও যন্ত্রণা দেওয়ার জন্য, প্রাক্তন স্ত্রী তাকে ডেকে দম্ভভরে জানালো যে সে তার কন্যাদের ব্যাপটিজম করিয়েছে এবং সে তার নতুন খ্রিস্টান স্বামী টমির সাথে রবিবার তাদেরকে গির্জায় নিয়ে যাবে।
এখনকার প্রতিটি হানানের জন্য রয়েছে একটি করে তামের।। তবে তামেররা প্রকাশ্যে কাঁদে না এবং তারা তাদের গল্প সহজে শেয়ারও করে না। হানানরা তাদের গল্প শেয়ার করে । তাই আমরা হানানদের দেখতে পাই আর ভাবি তামেরদের কোন অস্তিত্ব নেই….
সত্য হল বিয়ে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এবং নারী-পুরুষ প্রত্যেকেরই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিয়ে করা উচিত। জীবনসঙ্গী বাছাই করার আগে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করুন এবং আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করুন।
হ্যাঁ, বিয়ে যে কোন সময় যে কোন দিকে মোড় নিতে পারে এবং স্বামী ও স্ত্রী উভয়েই খারাপ লোক হতে পারে, সবকিছুর মধ্যেই তো ঝুঁকি থাকে, তাই না? বাড়ি থেকে বের হলে আমাকে কেউ অপহরণ করতে পারে, এটা চিন্তা করে কি আমরা ঘরে বসে থাকি?
যদি রাস্তা পেরোতে গিয়ে যদি বাসের সাথে ধাক্কা খাই এই চিন্তা করে কি বাইরে যাওয়া বন্ধ করি?
আল্লাহ আমাদের বিষয়গুলো সংশোধন করার তৌফিক দিন এবং আমাদের প্রত্যেককে তাক্বওয়াবান স্বামী / স্ত্রী হিসেবে কবুল করুন। সাথে দুনিয়ায় একটা সুন্দর পরিবার যেন গড়ে তুলতে পারি সেই তৌফিক দান করুন, আমীন।
– উম্মে খালিদ