সদাকা কীভাবে বিপদ থেকে রক্ষা করে তার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ।মুসাফিরের ডায়েরী পর্ব ১

Writing-Therapy🌻:
এয়ারপোর্টে সবেমাত্র লাগেজ চেক-ইন করেছি। সামনে লম্বা সফর! এমন সময় মনে হলো, প্লেনে ওঠার আগে একটু ফ্রেশ অজু করে নেই। এটা বছর দুয়েক আগের ঘটনা।

অজু করতে এয়ারপোর্ট ওয়াশরুমে গেলেই বরাবরের মতো কিছু খাদেমা আপাদেরকে সেখানে দেখা যায়। ঢুকতেই আপা খুব সুন্দর করে আমাকে সালাম দিল, কেমন আছি, কোথায় যাচ্ছি সব জিজ্ঞেস করল মিষ্টি করে।‌ ওযু শেষ হওয়ার সাথে সাথে আমাকে টিস্যু এগিয়ে দিল মুখ মোছার জন্য। বুঝতে পারছি যে, আপু বকশিশের জন্য আশা করে আছেন। খেটে খাওয়া মানুষদেরকে কিছু দিতে পারলে নিজেরও ভালো লাগে। কিন্তু আমার সাথে পার্স নিয়ে আসিনি। আর বেশি সময়ও আসলে হাতে নেই, ইমিগ্রেশন লাইনে দাঁড়াতে হবে। বের হওয়ার সময় খুব আস্তে করে খাদেমা আপা বলল, “ম্যাডাম, একটু বকশিশ?”

আহারে মায়া লাগলো! ওনাকে বললাম, “আপা আমার হাতে আসলেই সময় কম, পার্স নিয়েও আসিনি। যদি পারি, পরে এসে দিয়ে যাব ইনশাআল্লাহ! না পারলে দুঃখিত।” বলেই আমি দৌড়ে দৌড়ে ইমিগ্রেশনের দরজার কাছে আসলাম। দরজা দিয়ে ঢুকতে যাবো ইমিগ্রেশনের জন্য, তখন ঘটল বিপত্তি! শার্ট প্যান্ট পরা, গলায় আইডি ঝুলানো এক লোক আমাকে আর আমার হাসবেন্ডকে আটকে দিল!

সে খুব জোরে জোরে বলতে লাগল, “আপনাদের হ্যান্ডব্যাগ গুলো দেখি? অনেক ভারী! এরকম ভারী ব্যাগ নিয়ে কিছুতেই যাওয়া যাবে না!” কিছু বোঝার আগেই আমাদের থেকে হ্যান্ড ব্যাগগুলো নিয়ে কোণায় রাখা একটা ওয়েট মেশিনে মাপা শুরু করল। মাপা শেষ করে মাথা নাড়তে নাড়তে বলছে, “না না আপনারা এভাবে যেতে পারবেন না।”

একদম ইমিগ্রেশনের দরজার সামনে এই ঘটনা! আমরা দুইজন ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুক্ষণ ধরে শুধু প্রসেস করলাম, “হচ্ছেটা কী!” লাগেজ চেক-ইন করে এসেছি ইতিমধ্যে কাউন্টার থেকে। এই এয়ারপোর্ট দিয়ে কত ট্রাভেল করলাম, এভাবে দরজার সামনে হ্যান্ডব্যাগ মাপার কোন নিয়ম আছে বলে আমরা কখনো জানি নাই! ঠিক আছে আমরা তাকে বললাম, যদি ভারের জন্য নেওয়া নাই যায়, তাহলে আমরা কাউন্টার থেকে প্রোপার ওয়েতে এক্সট্রা পে করে নিচ্ছি। ওমা কাউন্টারে গিয়ে ভদ্রলোক বলল, এভাবে নাকি হবে না! ওই লোকটার সাথেই বোঝাপড়া করে নিতে হবে। এরা কি সবাই একই সিন্ডিকেটের সদস্য? আল্লাহই ভাল জানেন।

ওইদিকে সময় চলে যাচ্ছে! ইমিগ্রেশন পাড়ি দিতে হবে এবং ফ্লাইটে উঠতে হবে। এদিকে আমরা হ্যান্ডব্যাগ খুলে ভাবছি কোন জিনিসটা ফালাবো। আমার হাজব্যান্ড বলছে “এগুলো সব ফেলে দাও!” আমার খুব শখ করে সংগ্রহ করা বইগুলো হাতে ধরে আছি। বইগুলো ফেলে দিতে হবে চিন্তা করেই বুকে ব্যথা শুরু হয়ে গেল। ভাবছি এই টাওয়াল আর কাপড় গুলো বরং ফেলি। স্বামীকে জিজ্ঞেস করলাম, “এই এয়ারপোর্টের মাঝখানে এগুলো কোথায় ফেলবো?”  তিনি নিজেও টেনশনে পড়ে গেলেন। ফোন করার চেষ্টা করছেন, ফোনেও পাচ্ছেননা কাউকে। সফরে বের হয়ে যাচ্ছি দেখে আমাদের হাতে বাংলাদেশী টাকাও তেমন রাখিনি। আমাদের সামনে আরো কিছু ফ্যামিলি ইমিগ্রেশন দরজা দিয়ে ঢুকে গেল। অথচ ওই লোকটা আমাদেরকে কিছুতেই ঢুকতে দিবে না। তার ডিমান্ড কত আল্লাহই জানেন।

খুব একটা অস্থির অবস্থায় ঝুলে আছি। দুয়া ইউনুস পড়ছি, আল্লাহকে বলছি, আল্লাহ রহম করলে একমাত্র বিপদ থেকে উদ্ধার পাবো। হঠাৎ আমার ওয়াশরুমের ওই খাদেমা আপার কথা মনে পড়ে গেল! আমি দৃঢ় মনে বিশ্বাস করি যে, সাদাকার বরকতে আল্লাহ বিশ্বাসীদের জন্য বিপদ দূর করে দেন, এটা আমার প্রিয় রাসূলের (স) শিখিয়ে দেওয়া মূলনীতি। মাটি থেকে পার্সটা নিয়ে কিছু পুরাতন নোট খুঁজে পেলাম, সেটা নিয়েই দৌড় দিলাম ওয়াশরুমের উদ্দেশ্যে। ঢুকে দেখি সেই খাদেমা আপা ঠিক তার মতই চুপচাপ বসে আছেন হাতে একটা ঝাড়ু নিয়ে। তার হাতে নোট ধরিয়ে দিয়ে বললাম, “আপনি এটা দিয়ে চা খেয়ে নিয়েন। ফীআমানিল্লাহ আপা!” তিনি প্রচন্ড খুশি হলেন। প্রতি উত্তরে কি বলেছিলেন আমার মনে নেই।

যাক্ দিতে পেরে মনটা শান্তি শান্তি লাগছিল। ভাবছি দুনিয়ার কিছু জিনিসের প্রতি কি প্রচন্ড মায়া এই অন্তরের। কয়েকটা জিনিস বেজায়গায় ফেলে দিতে হবে, চিন্তা করলেই কেমন লাগে! অথচ পুরো দুনিয়াটাই ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে হবে একদিন! ফ্লাইট না হয় একটা মিস হয়েই গেল, কি আছে আর জীবনে!

ওয়াশরুম থেকে ফিরে এসে দেখি হাজবেন্ড আমার দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে হাত নাড়ছে। বলছে, “তাড়াতাড়ি ইমিগ্রেশন লাইনে দাঁড়াও, চলো চলো, আমাদেরকে যেতে দিয়েছে!”

আল্লাহু আকবার!
ওয়াও সুবহানআল্লাহ! আমার মনে হয় হাত পা হালকা হালকা কাঁপা শুরু হয়ে গেল।

এত তাড়াতাড়ি কবুল হয়ে গেল? এত পাওয়ারফুল ছোট্ট একটু সাদাকার প্রতিদান?

প্রচন্ড ঘাড় ত্যারা ঐ লোকটা কীভাবে আমাদেরকে যেতে দিল?! আমি জানি কীভাবে দিয়েছেন! যিনি অন্তর পরিবর্তনের মালিক, তাঁর জন্য এটা খুব সহজ। যিনি মহাবিশ্বের স্রষ্টা, তিনি “কুন ফায়াকুন” বললেই হয়ে যায়! আলহামদুলিল্লাহি রব্বিল আলামিন।

সফরের খুঁটিনাটি কষ্ট গুলো অন্যরকম, মুসাফিরদের দুয়া কবুল হওয়ার একটা সুযোগ এজন্যই মনে হয় আল্লাহ বাড়িয়ে দিয়েছেন, সুবহান আল্লাহ!

[ ছবিগুলো বাংলাদেশ ঢাকা এয়ারপোর্টের মহিলাদের নামাজের স্থানের ছবি! এয়ারপোর্টে আমার প্রিয় জায়গা ]
___

মুসাফিরের ডায়েরী পর্ব ১
সফর ১৪৪৪
September 2022

©শারিন শফি

Leave a Comment