নতুন পাঠ্যপুস্তকে যেসব বিষাক্ত চিন্তা ও বিকৃত ইতিহাস ঢুকানো হয়েছে, এর প্রধান আঘাতটা পড়বে আমাদের সন্তানদের আত্মপরিচয়ের উপর। কতভাবে তাদের আত্মপরিচয়ে আঘাত হানা হয়েছে, তার কিছু দিক পয়েন্ট আকারে বলছিঃ
১) বিবর্তনবাদের মাধ্যমে আল্লাহর সরাসরি সৃষ্টি হিসেবে যে আমরা মানুষ- এই পরিচয়কে আঘাত করা হয়েছে।
২) এই অঞ্চলের ইতিহাস থেকে ইসলামী শাসন ও কালচারকে ক্রিমিনালাইজ করে আমাদের সোনালী ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। অথচ কোন জাতির আত্মপরিচয় গঠনের অন্যতন একটি উপাদানই হল ইতিহাস।
৩) পৌত্তলিক নেতা, নিদর্শন ও সংস্কৃতিকে মহান ও প্রধান হিসেবে চিত্রিত করে মুসলিম আত্মপরিচয়ের স্বকীয়তাকে আঘাত করা হয়েছে। মুসলিমদের ভিতর পৌত্তলিক চিন্তা ও সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ তৈরি করা নিশ্চিতভাবে তাদের দ্বীনি স্বকীয়তা বিনষ্ট করে দেয়।
৪) কথিত মানবতাবাদ ও জাতীয়তাবাদের নামে ধর্মীয় পরিচয়ের উর্ধ্বে আঞ্চলিক ও মানুষ পরিচয়কে রাখার সবক দেয়া হয়েছে। এটাও মুসলিম আত্মপরিচয়ের উপর আঘাত। সবার আগে আমরা মুসলিম। মুসলিম আর আল্লাহর বান্দা মানুষ হওয়ার মাঝে কোন দ্বন্দ্ব নেই।
৫) মুসলিম পরিচয়ের অধীনে মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে আরো দুটি পরিচয় দিয়েছেন। পুরুষ ও নারী। এটি আমাদের লিঙ্গগত পরিচয়। এর বাইরে আল্লাহ তায়ালা লিঙ্গগত আর কোন পরিচয় দেননি। এলজিবিটি আর ট্রান্সজেন্ডারের চিন্তার মাধ্যমে আমাদের লিঙ্গগত পরিচয়ে আঘাত হেনেছে।
আত্মপরিচয়ই একটি জাতির মূল জিনিস। আত্মপরিচয় হারিয়ে গেলে কিংবা এটা নিয়ে সংকটে পড়ে গেলে সে জাতির ধ্বংস অনিবার্য। এজন্য আমাদের জন্য জরুরী হল, আগত প্রজন্মকে সঠিক আত্মপরিচয়ের ভিত্তিতে গড়ে তোলা এবং তাদের ভিতর মুসলিম পরিচয়ের চেতনা সদা জাগ্রত রাখা।
নতুন পাঠ্যপুস্তক ও অভিভাবক সমীপে কিছু কথাঃ
আমাদের বর্তমান প্রজন্ম ও তাদের অভিভাবকরা ক্যারিয়ারকে ধর্মের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দেয়। অভিভাবকরা সন্তানদের ক্যারিয়ার নিয়ে বেশ চিন্তিত থাকলেও তাদের দ্বীনদারি নিয়ে সামান্য মাথাব্যথা নেই। এটা আসলে পুঁজিবাদী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রভাব। আমরা বর্তমানে যেই শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে আছি সেখানে পুঁজিই সব। দ্বীন ও নৈতিকতার কোন মূল্য নেই এখানে। আমাদের এমন পুঁজিবাদী মানসিকতার সুযোগ নিয়ে কিছু লিবারেল মিশনারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি তরুণদের দ্বীনি বিশ্বাসকে নষ্ট করে দিচ্ছে।
আমাদের অভিভাবকদের মনে রাখতে হবে, মহান আল্লাহ তায়ালা আপনাকে সন্তান দিয়েছেন আমানতস্বরূপ। তার সুস্থ-সঠিক প্রতিপালন আপনার দায়িত্ব। আপনার সন্তানকে যদি অন্ধের মত পার্থিব ক্যারিয়ারের পিছনে ছেড়ে দিয়ে তার দ্বীনকে নষ্টের পথে ঠেলে দেন, ওয়াল্লাহি আপনি আল্লাহর দরবারে কখনোই ছাড় পাবেন না। মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে এরজন্য আপনি পাকড়াও হবেনই।
হাদীস শরীফে এসেছে,
প্রতিটি শিশুই আল্লাহর ফিতরাহ তথা ইসলামের উপর জন্মগ্রহণ করে থাকে। পরবর্তীতে পিতা-মাতা তাকে ইহুদি, খ্রিষ্টান কিংবা হিন্দু হিসেবে গড়ে তুলে।
( সহিহ বুখারি ও মুসলিম )
এই হাদিস থেকে সুস্পষ্ট, সন্তানের বিপথগামীতার দায়বদ্ধতা অভিভাবকদের উপর বর্তায়। সন্তানদের ফিতরাত ও ইসলামকে রক্ষা, সন্তানকে এর উপর প্রতিপালন করা এবং সন্তানের জন্য যথাসম্ভব নিরাপদ পরিবেশের ব্যবস্থাপনা করা পিতামাতার উপর আবশ্যিক দায়িত্ব। আপনার সন্তানকে কারা পড়াচ্ছে, কি পড়াচ্ছে এসব খোঁজ রাখা আপনার দায়িত্ব।
আপনার সন্তান নতুন বছরে নতুন ক্লাসে উত্তীর্ণ হয়েছে। নতুন পাঠ্যপুস্তকের ঘ্রাণে আপনার সন্তান মুগ্ধ ও আনন্দিত। কিন্তু আপনি হয়ত জানেনই না, আপনার সন্তানের হাতে বইয়ের নামে বিষাক্ত উপাদান তুলে দেয়া হয়েছে। যেই উপাদানের পয়জন আপনার সন্তানের মুসলিম পরিচয়কে নির্মূল করতে থাকবে, আপনার সন্তানের মনে তার জেন্ডার আইডেন্টি নিয়ে সংশয়ের বীজ বপন করবে, আপনার সন্তানকে বিকৃত যৌনাচারের দিকে ধাবিত করবে, পৌত্তলিকতার প্রতি আপনার সন্তানকে মোহগ্রস্ত বানিয়ে তুলবে।
আপনি জানেন এই পাঠ্যপুস্তক আপনার সন্তানকে কি শিখাচ্ছে? এই পাঠ্যপুস্তক শিখাচ্ছে, পর্দা একটি কুসংস্কার প্রথা ও ধর্মীয় গোঁড়ামি [১],
সমকামিতা- যেই পাপের জন্য মহান আল্লাহ তায়ালা লুত আলাইহিস সালামের কওমকে ধ্বংস করে দিয়েছেন, সেটি নাকি স্বাভাবিক ব্যাপার। এই পাঠ্যপুস্তক আরো শিখাচ্ছে, আল্লাহ যাকে পুরুষ কিংবা নারী হিসেবে সৃষ্টি করেছেন, সে তার মানসিক সমস্যার কারণে অপারেশন করে লিঙ্গ পরিবর্তন করে নারী কিংবা পুরুষ হতে পারে, এতে কোন সমস্যা নেই। [২]
অথচ মহান আল্লাহ তায়ালা কোন বান্দাকে তার সৃষ্টির কোনরূপ পরিবর্তন করার অধিকার দেননি।
এই পাঠ্যপুস্তক আপনার সন্তান আপনার সন্তানের সামনে মুসলিম শাসনামলকে কালোঅধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত করছে। ব্রিটিশ শাসনকে আশির্বাদ হিসেবে উপস্থাপন করছে। উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের অবদান ও ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে আলেম ওয়ালা ও মুসলিম নেতাদের ভূমিকাকে মাইনাস করে হি ন্দু নেতাদের অবদানকে মহান করে তুলছে। [৩]
আপনি কি বুঝতে পারছেন, আপনার সন্তানের উপর এই শিক্ষাগুলোর প্রভাব কেমন হবে? এই শিক্ষা আপনার সন্তানের দ্বীনি বোধ, বিশ্বাস ও জীবনাচারকে নষ্ট করবে না কেবল, বরং আপনার সন্তানকে যৌন বিকৃতি ও উচ্ছৃঙ্খলতার দিকে ঠেলে দিবে। আপনার সন্তানের পূর্ণ বিকাশকে বাঁধাগ্রস্ত করবে। আপনার সন্তানের পারিবারিক জীবন, দাম্পত্য জীবন ও যৌন জীবনকে অস্থির করে দিবে। আপনার সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্যকে ধ্বংস করে দিবে। পুরুষ কিংবা নারী হিসেবে পূর্ণ বিকশিত করার পরিবর্তে আপনার সন্তানকে লিঙ্গপরিচয়ের সংকটচক্রে আটকে দিবে। সর্বোপরি সমাজ পাবে মানসিকভাবে অস্থির, যৌনচিন্তায় উচ্ছৃঙ্খল ও বিকৃত, পুরুষ কিংবা নারী হিসেবে অপূর্ণাঙ্গ বিকাশিত, দায়িত্বভারে অক্ষম একটি প্রজন্ম।
আপনি জানেন, আপনার পক্ষ থেকে আপনার সন্তানের জন্য সবচেয়ে উত্তম উপহার কি? আপনি তাকে অঢেল সম্পদ কামানোর পথ দেখাচ্ছেন কিংবা নিশ্চিত ক্যারিয়ারের জন্য সবকিছুতে ছাড় দিচ্ছেন, এটা আপনার সন্তানের জন্য সর্বোত্তম উপহার না।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
কোন পিতা তার সন্তানকে উত্তম প্রতিপালনের চেয়ে উত্তম কোন উপহার দিতে পারে না।
( সুনানে তিরমিযি )
উত্তম প্রতিপালন হল, সন্তানকে দ্বীনের উপর গড়ে তোলা। উত্তম প্রতিপালনের দায়িত্ব হিসেবেই, পাঠ্যপুস্তকের এসব জঘন্য মিথ্যাচার আর প্রোপাগান্ডা সম্পর্কে আপনার সচেতন হতে হবে। আপনার সন্তানকেও সচেতন করতে হবে। পাঠ্যপুস্তক থেকে এসব বিকৃত পাঠ ও পক্ষপাতমূলম ইতিহাসকে বাদ দেয়ার জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দায়ের করতে হবে।
সর্বোপরি আপনার সন্তানের দ্বীন রক্ষা করা আপনার জন্য ওয়াজিব। তাই তার নৈতিক শিক্ষার ভার এসব প্রতিষ্ঠানের উপর ছেড়ে না দিয়ে নিজের হাতে তুলে নিন। সন্তানের জন্য দ্বীনের মৌলিক শিক্ষা অর্জনের ব্যবস্থা করা আপনার উপর আবশ্যক।
১) ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান (অনুশীলন ৭ম শ্রেণি ), পৃষ্ঠা ৫ ও ১২১।
২) ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, ৫১ পৃষ্ঠা
৩) প্রাগুক্ত, ৫ পৃষ্ঠা।
পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণীর বইগুলোর বিভিন্ন অধ্যায়ে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বাংলার বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের কথা আনা হয়েছে। কিন্তু এসব আলোচনাতে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে ইসলামী আন্দোলনগুলোকে। শহীদ তিতুমীর এবং ফরায়েজী আন্দোলনের কথা একেবারেই অনুপস্থিত। কোথাও কোন উল্লেখ নেই ১৮৫৭ সালের বিপ্লবে আলিমগণের ভূমিকা এবং আত্মত্যাগের।
অন্যদিকে বিভিন্ন শ্রেনীর বইতে বারবার কলকাতাকেন্দ্রিক বেঙ্গল রেনেসাঁ (নবজাগরণ), স্বদেশী আন্দোলন এবং ক্ষুদিরাম-সূর্যসেনদের সশস্ত্র আন্দোলনের কথা এসেছে।তিতুমীর ও ফরায়েজি আন্দোলনের কথা একটা পাঠে ছোট করে আসলেও সেগুলো হি ন্দু নেতাদের আন্দোলনের মত গুরুত্ব পায়নি।
– মুহতারাম ইফতেখার সিফাত হাফিজাহুল্লাহ