জালেম জুলুম করে আর মজলুম সে জুলুমের শিকার হয়। জুলুমের সবচেয়ে কঠিনতম একটি হলো দুনিয়ার কোনো শক্তিশালী ব্যক্তির রোষানলে পতিত হওয়া। আর সে শক্তিশালী যদি শাসক হয় তাহলে জীবনে কতটা দুঃখ আর কষ্টের হয় তা কাউকে ভেঙ্গে বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
বর্তমানে কত মানুষ কতভাবে জালেমের রোষনলে পড়ে। কোনো অন্যায় ছাড়াই বিভিন্ন কারণে প্রশাসনের হাতে হেনস্তার শিকার হওয়া তো এখন খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয়। কারো মিথ্যা মামলায় বা সন্দেহের জের ধরে একবার আইনের গ্যাঁড়াকলে পড়লে জীবনের দুঃখ কষ্টের আর সীমা থাকে না। শুধু প্রশাসনই নয়, স্থানীয় কত শক্তিশালীদের হাতে কত শত জুলুমের শিকার হয় কত মানুষ। ধরে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার আর ঘুম-খুনের ঘটনা তো নিত্যদিন আমরা দেখতে পাচ্ছি হারহামেশা। এছাড়াও সময়ে সময়ে কত জালেমের হাত থেকে বাঁচতে কত পেরেশানিতে নিপাতিত থাকতে হয়, ঘর ছাড়া হয়ে জীবন কাটাতে হচ্ছে কত শত যুবকের তার পূর্ণ খবরএ আমরা জানিনা।
জালেমের এমন কষ্টের হাত থেকে বাঁচতে কুরআনের কয়েকটি আয়াত হতে পারে একজন মজলুমের অনেক বড় একটি হাতিয়ার। যুগে যুগে এই আয়াত পড়ে উপকার পেয়েছেন অসংখ্য মানুষ! আয়াতগুলো হয়েছেন জালেমের হাত থেকে বাঁচার জন্য তাদের বিশাল হাতিয়ার। যা তাদেরকে রক্ষা করেছেন দুনিয়াবি আসবাব-উপকরনের উর্ধ্বে উঠে। যখন আর কোন আসবাব অবলম্ভন করে আর কিছুই সম্ভব হচ্ছিলো না, ঠিক তখনই এই আয়াতগুলো তাদেরকে রক্ষা করেছে আল্লাহর ইচ্ছায়। আসুন সে আয়াতগুলো জানা যাক।
আচ্ছা, তার আগে ঘটনাগুলো একটু শুনে নেই, যাতে আয়াতগুলোর বাস্তবতা আরো ভালোভাবে আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়।
প্রথমেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ঘটা একটি ঘটনা শুনুন। সূরা লাহাব অবতীর্ন হয়। সেখানে আবু লাহাব ও তার স্ত্রীকে চূড়ান্ত পর্যায়ের অভিশপ্ত ঘোষণা করা হয়। এই সূরার খবর শূনে তো আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামিল আরওয়া বিনতে হারব বেজায় রাগান্বিত হয়ে যায়। সে একটি পাথর নিয়ে বের হয় মুহাম্মদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) খোঁজে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু বকর রা.কে নিয়ে মসজিদে বসে ছিলেন। এমন সময় দূর থেকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালি দিতে দিতে সে মহিলা আসতে লাগলো। তাকে আসতে দেখে আবু বকর রা. ভয় পেয়ে গেলেন। জানেন, মহিলাটি রাসুলকে দেখলেই কষ্ট দিবে। তাই বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! বিনতে হারব তো আসছে। সে আপনাকে দেখে ফেলবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শান্তভাবেই বসে রইলে। আবু বকরের পেরেশানি দেখে বললেন, আবু বকর! সে কিছুতেই আমাকে দেখবে না। এটা বলেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআনের একটি আয়াত পড়ে সেখানেই অবস্থান করলেন। আরওয়া বিনতে হারব আবু বকরের সামনে এসে দাঁড়ালো। কিন্তু রাসূলকে দেখতে পেলো না! রাসূলকে না পেয়ে আবু বকরকে উদ্দেশ্য করে বললো, তোমার সাথী আমাকে নিয়ে ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ করেছে, আমি তোমাকে জানিয়ে রাখলাম (এটার পরিনাম কিন্তু ভালো হবে না)। আবু বকর রা. বললেন, কাবার রবের কসম, তিনি তোমাকে নিয়ে ব্যাঙ্গ করেননি। হযরত আবু বকররের উত্তর শুনে রাগে-ক্ষোভে আবু লাহাবের স্ত্রী এই কথা বলতে বলতে সেখান থেকে চলে গেলো, ‘পুরো কুরাইশ জানে আমি সর্দারের মেয়ে!-মুসনাদে আবি ইয়ালা : ৫৩; মুসতাদরাকে হাকেম : ৩৩৭৬; আরো দেখুন তাফসিরে বাগাবী ৫/৯৭, দারে তাইয়িবা; তাফসিরে ইবনে কাসির ৩/৬৩, মুস্তফা আলখন তাহকিককৃত নুসখা (১)
এবার একজন সাহাবীর অভিজ্ঞতা কথা শূনে নেওয়া যাক। হযরত কা’ব রা. শামের একজন লোককে সেই আয়াতগুলোর কার্যকরিকতা সম্পর্কে বললেন। সে লোক রাতে গোপনে রোমে গেলো। এবং সেখানে কিছুদিন অবস্থান করলো। একদিন সে ধরা খেয়ে গেলো। আর সেখান থেকে পলায়ন করলো। তাকে ধরতে রোমের সেনাবাহিনী ধাওয়া করলো। একসময় লোকটিকে সেনাবাহিনী ঘেরাওতে ফেলে দিলো। লোকটি সেই আয়াতগুলো পড়তে লাগলেন। এবং সেনাবিনীর ঘেরাও থেকে বের হয়ে গেলেন কিন্তু তাকে তারা দেখতে পারলো না। -তাফসিরে ছালাবি ১৬/৩৫৩, দারুত তাফসির জেদ্দা।
কালবি রহ. বলেন, আমি এই আয়াতগুলো ফাজায়েল রায় শহরের এক লোককে বলি। সে রাতের গোপনে দাইলাম শহরে যায়। সেখানে স্থানীয় প্রশাসনের হাতে ধরা পড়ে যায়। তাকে খুঁজতে প্রশাসনের লোকেরা আসলে সে আয়াতগুলো পড়তে লাগলো। প্রশাসনের বাহিনী তাকে খুঁজতে খুঁজতে এতটাই নিকটে চলে আসলো যে, লোকটির শরীরের কাপড় আর বাহিনীর লোকের কাপড় একটি অপরটির সাথে স্পর্শ করতে লাগলো, কিন্তু প্রশাসনের লোকেরা তাকে দেখতে পেলো না! -তাফসিরে ছালাবি ১৬/৩৫৩, দারুত তাফসির জেদ্দা।(২)
আয়াতটি কী? খুবই সংক্ষিপ্ত ও ছোট একটি আয়াত। এক বসায় মুখস্থ করে ফেলা যায়। একদম সহজ। আয়াতটি হলো সূরা বানী ইসরাঈলের।
وَإِذَا قَرَأۡتَ ٱلۡقُرۡءَانَ جَعَلۡنَا بَيۡنَكَ وَبَيۡنَ ٱلَّذِينَ لَا يُؤۡمِنُونَ بِٱلۡأٓخِرَةِ حِجَابٗا مَّسۡتُورٗا
যখন তুমি কুরআন পড়ো, তখন আমি তোমার মাঝে ও যারা আখেরাতে ঈমান রাখে না তাদের মাঝে এক অদৃশ্য পর্দা রেখে দেই। -সূরা বানী ইসরাঈল : ৪৫
খুবই সংক্ষিপ্ত না। তবে এই আমলটি আরো বেশি কার্যকর করার জন্য সাথে আরোপ কয়েকটি সহজ আয়াত যুক্ত করে নিলে ফল বেশি পাওয়া যাবে। সে আয়াতগুলো হলো সূরা ইয়াসীনের প্রথম নয়টি আয়াত। একদম সহজ। বহু মানুষই পারি। অথবা ছোট বেলায় মক্তবে মুখস্ত করেছিলাম। হয়তো ভুলে গেছি। এখন একবার চাইলেই মুখস্ত করে ফেলা যাবে। আর আগে না থাকলে এখন একদম সহজে মুখস্থ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। আচ্ছা মুখস্ত করার আগে একজন মহান ইমামের মুখেই সে ঘটনাটি শুনুন।
ইমাম কুরতুবি রহ. (মৃত্যু : ৬৭১ হি.)। নিজ যুগের একজন মহান ব্যক্তিত্ব। যার ইলমি খিদমত থেকে তার যুগ থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত কোটি কোটি মুসলিম উপকৃত হচ্ছে। তিনি উপরে যে শেষের দুটো ঘটনা উল্লেখ করেছি তা উল্লেখ করে নিজ জীবনের একটি বাস্তব অভিজ্ঞতা লেখেন। তিনি বলেন, আমি তখন কর্ডোবার মানসুর কেল্লায় অবস্থান করছিলাম। সেখানে একদল শত্রু যারা আমার ক্ষতি করতে চাচ্ছিলো আমি তাদের থেকে পালাচ্ছিলাম। তাদের রোষানল থেকে বাঁচতে আমি দৌঁড় দিয়ে কেল্লায় এক কোনায় গিয়ে আত্মগোপন করলাম। একটু পড়েই দুজন শত্রুপক্ষের দুজন ঘোরসওয়ার আমার দিকে লক্ষ্য করে ছুটে আসছে। আমি তখন অনুভব করলাম যেখানে আমি আত্মগোপনে এসে দাঁড়িয়েছি তা একদম খোলা আকাশের নীচে! আমার আর সওয়ারিদের মাঝে কোনো প্রতিবন্ধক হবে এমন কিছুই নেই।
এই মুহুর্তে আমি কুরআনের কিছু আয়াত পড়া শুরু করি। সাওয়ারি দুজন আমায় অতিক্রম করে সামনে গেলো। এদিকসেদিক কিছুক্ষণ খুঁজে আমায় না পেয়ে তাদের নিজ স্থানে ফিরে গেলো। যেতে যেতে একজন বলতে লাগলো, দেখলাম তো এখানেই ছিলো। এখন নেই! একদম গায়েব হয়ে গেলো কীভাবে!! এই লোকটা ‘দাইবালাহ’ (উন্দুলুসে শয়তানকে বলা হতো) ছাড়া কিছুই না।
ঘটনার আকস্মিকতা কিছুটা হকচকিয়ে গেলাম। পরে বুঝতে পারলাম। সেই আয়াতগুলোর বদৌলতে আল্লাহ এই জালিমদের চোখকে অন্ধ করে দিয়েছে। তাই তারা আমায় দেখতে পায়নি। সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্যই। – তাফসিরে কুরতুবী ১০/২৬৯, দারুল কুতুব আল মিসরিয়্যাহ, (৩)
সূরা ইয়াসীনের প্রথম নয় আয়াত হলো,
يسٓ ١ وَٱلۡقُرۡءَانِ ٱلۡحَكِيمِ ٢ إِنَّكَ لَمِنَ ٱلۡمُرۡسَلِينَ ٣ عَلَىٰ صِرَٰطٖ مُّسۡتَقِيمٖ ٤ تَنزِيلَ ٱلۡعَزِيزِ ٱلرَّحِيمِ ٥ لِتُنذِرَ قَوۡمٗا مَّآ أُنذِرَ ءَابَآؤُهُمۡ فَهُمۡ غَٰفِلُونَ ٦ لَقَدۡ حَقَّ ٱلۡقَوۡلُ عَلَىٰٓ أَكۡثَرِهِمۡ فَهُمۡ لَا يُؤۡمِنُونَ ٧ إِنَّا جَعَلۡنَا فِيٓ أَعۡنَٰقِهِمۡ أَغۡلَٰلٗا فَهِيَ إِلَى ٱلۡأَذۡقَانِ فَهُم مُّقۡمَحُونَ ٨ وَجَعَلۡنَا مِنۢ بَيۡنِ أَيۡدِيهِمۡ سَدّٗا وَمِنۡ خَلۡفِهِمۡ سَدّٗا فَأَغۡشَيۡنَٰهُمۡ فَهُمۡ لَا يُبۡصِرُونَ ٩
এই সামান্যকিছু আয়াত আমরা মুখস্ত করে নিতে পারি। জীবনে কখন কী কাজে লেগে যায় বলা যায় না। যদি আয়াতের বদৌলতে আল্লাহ বড় কোনো বিপদ থেকে রক্ষা করে তাহলে ক্ষতি কী!
বি.দ্র.
১) আয়াত পড়লেই আপনি গায়েব হয়ে যাবেন এমন নয়। এটা অনেকটা আপনার ইমানের উপর নির্ভরশীল। আল্লাহর উপর আপনার ইমান যদি সেরকম অর্জন হয় তাহলে আপনিও উপকারিতা পাবেন। এটা আল্লাহর ওয়াদা।
২) কোনো দোয়া পড়া বা জানার অর্থ এই নয় যে, জালেম আসতে থাকবে আর আপনি দোয়া পড়ে বসে থাকবেন। দুনিয়ার আসবাব ইখতিয়ার করার পর আল্লাহর উপর ভরসা করার নামই তাওয়াক্কুল, উসুলটি মনে রাখা চাই।
৩) সমস্ত আসবাব ইখতিয়ার করার পর এই দোয়া পড়েও যদি কেউ উপকার না পায় তারমানে দোয়ার কমজোরি নয়, সেটাই আল্লাহর সিন্ধান্ত। আল্লাহর সিন্ধান্ত মেনে নেওয়াই ইমানের অংশ।
টীকা :
১] হাদিসটি উল্লেখ করার পর হাকেম রহ. লেখেন,
«هَذَا حَدِيثٌ صَحِيحُ الْإِسْنَادِ وَلَمْ يُخْرِجَاهُ، (قال الذهبي : صحيح)
হাদিসের সনদ সহিহ।
২] দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঘটনাটি তাফসিরে ছালাবিতে সনদসহ বর্ণিত হয়েছে। তবে সনদটি বেশ দূর্বল।
৩] আরো দেখুন, মুফতি শফী রহ. রচিত মাআরিফুল কুরআন থেকে সূরা বানী ইসরাইলের ৪৫ নং আয়াতের অধীনে।
©ABB