‘‘বন্ধু কিংবা প্রিয়জন
কেউ কখনো হয় না আপন।
পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি,
আঁধার রাতের আলোর মতন।
দিন শেষে এই বিশাল ভুবনে,
তোমার তুমিটাই আসল অর্জন।’’
একটা দীর্ঘশ্বাস আপনার বুকের শূন্যস্থানে পুনরায় শক্তি সঞ্চার করে দিল। চোখ নামিয়ে আপনি একাই পথ ধরলেন। আপনি হাঁটছেন মসজিদের দিকে। রাস্তার ধারে আরও কতশত অপরিচিত মুখ। তারা সবাই তাদের নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। আপনি দেখলেন, একটি সভ্যতা, একটি সমাজ— যেখানে গরীব আর ধনীদের বিস্তর ব্যবধান। আপনি এগিয়ে যাচ্ছেন এই মনগড়া সমাজকে উপেক্ষা করে। একটা সময় আপনি মসজিদে গিয়ে পৌঁছালেন।
অযু সেরে আপনি মসজিদে প্রবেশ করলেন। সালাত শুরু হয়ে গিয়েছে। আপনি সালাতে দাঁড়ানোর পর নিজেকে ভিন্ন এক ‘আমি’তে খুঁজে পেলেন । ইমাম সাহেব যখন বলা শুরু করলেন—
‘আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন, আর রাহমানির রাহিম…।
আপনার সব একাকিত্ব, ক্লান্তি, কষ্ট যেন নিমিষেই ফুরিয়ে গেল। আপনি যখন সিজদাহতে ঝুঁকে গিয়ে আপনার রবের পবিত্রতা এবং শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা দিলেন, আপনি অনুভব করলেন— আপনার ভেতরটা যে অপার শূন্যতায় ঠাঁসা ছিল, সেটা যেন পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছে । যখন শেষ বৈঠকে আপনি শাহাদাত আঙুল উঁচু করে আপনার রবের একাত্মবাদের সাক্ষী দিলেন, স্বীকার করে নিলেন বিনা দ্বিধায় যে, তিনি ছাড়া আর কোনো সত্য ইলাহ নেই এবং ঠিক তার পরেই যখন আপনি আপনার সমস্ত অহমিকা, গড়িমা ভুলে বিনা সংকোচে নিজের করা সকল অপরাধগুলো মাথা পেতে নিলেন, আর বললেন— ‘ইয়া রব, আমি আমার নিজ আত্মার ওপর বড়ই অত্যাচার করেছি, জুলুম করেছি। গুনাহ মাফকারী একমাত্র আপনি। অতএব, আপনি নিজ অনুগ্রহে আমাকে সম্পূর্ণ ক্ষমা করুন এবং আমার প্রতি দয়া করুন । নিশ্চয়ই আপনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু ।’ এরপর আপনি অনুভব করলেন, আপনার রব আপনাকে পরম মমতায় গ্রহণ করে নিয়েছেন।
সালাত শেষ হবার পর আপনি হিসেব করে দেখলেন, এই এতটা দূর পথ আসতে গিয়ে আপনি যাদেরকে হারালেন, যা কিছু হারালেন,তার থেকে অনেক অনেকগুণ বেশি কিছু পেলেন। আপনি অর্জন করলেন এক মহান পবিত্র সত্তার অনুগ্রহ, তার ভালোবাসা, তার অভিভাবকত্ব যে, এখন আপনার কাছে মনে হচ্ছে শূন্যতাই যেন সবকিছু। আপনি আবিষ্কার করলেন, ‘শূন্যতাই পৃথিবীর সব চাইতে বড় উপহার। কেননা আপনি এই শূন্যতা অনুভব না করলে আপনার রবের অস্তিত্ব কীভাবে উপলব্ধি করতেন?’
এবার ফেরার পালা। আপনি উঠে দাঁড়ালেন।মসজিদের জানালা দিয়ে বাইরে দেখলেন একটি ভিন্ন জগৎ। যেখানে হাজারো কোলাহল, ব্যস্ততা, ভেদাভেদ। কিন্তু এতক্ষণ আপনি যেখানে ছিলেন, যাদের সাথে কাতারবন্দি হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সালাত আদায় করলেন, তাদের মধ্যেও ছিল ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, মুচি, মেথর, চাকর সুইপার, ড্রাইভার, বাদামওয়ালা কিংবা রিকশাওয়ালা। অথচ এখানে তাদের মধ্যে কারোর থেকে কারোর মর্যাদা কম কিংবা বেশি ছিল না। এখানে ফাস্ট ক্লাস কিংবা সেকেন্ড ক্লাসের কোনো অপশন নেই। এখানে স্যুট-কোটের কদর মুচি-মেথরের থেকে বেশি নয়। এখানে সবাই সমান। এখানে সবাই প্রজা আর তাদের রাজা, তাদের সুলতান একমাত্র মহামহিম আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা।
আপনি একবার জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখছেন, আর একবার ভেতরে। যেন দুটি ভিন্ন পৃথিবীর সংযোগস্থলে আপনি দাঁড়িয়ে আছেন।
কিছুটা সময় আপনি সেখানে থাকার পরে আপনার মনে হলো, সবাই মসজিদ থেকে বেরিয়ে চলে যাচ্ছে। আপনি বাইরে বেরিয়ে এলেন। ভেতরের নির্মল বাতাসে যে পবিত্রতার স্নিগ্ধ সুষমায় আপনি ডুবে ছিলেন, তা ক্রমশ হাল্কা হচ্ছে। আপনি যাত্রা শুরু করলেন সেই চেনা রাস্তা, রোড লাইট, নিয়ন আলোর ক্যানভাসে আঁকা নিরেট কংক্রিটের প্রাচীর ঘেঁষে। আপনি প্রবেশ করলেন সেই প্রাচীরে। আবারও মিশে গেলেন এই শহরে ব্যস্ততায়। কিন্তু এখন আর আপনার খারাপ লাগছে না। কোনো যুগলবন্দী প্রেমিক-প্রেমিকা অথবা গিটার হাতে গানে বিভোর সেই বন্ধুদের দল আপনাকে আর ভাবাচ্ছে না। কারণ আপনি আপনার বেঁচে থাকার রসদ খুঁজে পেয়েছেন। ইতোমধ্যেই জ্ঞাত হয়েছেন শূন্যতার আসল মানে কী। আপনি জেনে গিয়েছেন, আপনি মোটেই একা নন।’
লেখাটা এখানেই শেষ। নাফি অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে আছে মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে। স্ক্রল করে আর লেখা পাচ্ছে না। এই এত বড় একটা লেখা পড়তে গিয়ে তার একবারও বোরিং লাগল না। উলটো কেমন যেন একটা ঘোর লেগেছিল তার চোখেমুখে । যেন শেষ হয়েও হলো না শেষ।
নাফির আগ্রহ বেড়ে যায়। সে তার বন্ধুর প্রোফাইলে প্রবেশ করে এরকম আরও কোনো লেখা আছে কি না তা চেক করার জন্য।
তার এই বন্ধুটির নাম জামিল। ফেসবুক অ্যাকাউন্টের নাম জামিল আকন্দ। ছেলেটা ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ-তে পড়ছে। বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে হলেও আদরটা ভাগ্যে জোটেনি তার। তাই তো ছোট বেলায় ক্লাস ফোরে গণিত আর ইংরেজিতে ফেল করায় বাবা-মা লজ্জায় গ্রামে নানা-নানুর কাছে পাঠিয়ে দিয়ে গ্রামের স্কুলে নতুন করে ভর্তি করিয়ে দেয়। এরপর আস্তে আস্তে অন্য সবার মতন নাফির সাথেও ভাব জমে। সে কত বছর আগের কথা! নাফির মনে পড়ে যায় ফেলে আসা সেইসব অতীতের কথা। আবেগাপ্লুত হয়ে যায় সে।
বই: রিফলেকশন [ বিবেকের দর্পণে হিদায়াতের প্রতিফলন]
লেখক: এনামুল হক ইবনে ইউসুফ
ধরন: ইসলামিক উপন্যাস
প্রকাশনা: আল ইখলাছ পাবলিকেশন
সম্পাদক: Tanjil Arefin Adnan (হাফি.)
প্রচ্ছদ: Moshiur Hridoy
প্রকাশকাল: ১৬ জানুয়ারি ২০২২ইং
(রিভিউ সংগ্রহীত)