‘কারাগারে সময় যেন কাটছিল না। প্রতিটা দিন নামাজ পড়ে কেঁদেছি। আর বলেছি, আল্লাহ আমাকে মুক্ত করো। তবে আমার বিশ্বাস ছিল, আমি যেহেতু কোনো অপরাধ করিনি, আমাকে আল্লাহ বেশি দিন কারাগারে রাখবেন না।’
বিনা অপরাধে ১০ দিন কারাভোগ করে মুক্ত হওয়ার পর এমন অনুভূতি ব্যক্ত করেন সীতাকুণ্ডের আলমারি ব্যবসায়ী মো. লিটন। তবে তিনি এখনো ট্রমায় ভুগছেন। ৯ ডিসেম্বর শুধু নামের মিল থাকায় পুলিশ প্রকৃত আসামির পরিবর্তে নিরপরাধ লিটনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায় সীতাকুণ্ড থানা-পুলিশ। লিটনের বাড়ি উপজেলার বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের ভায়েরখীল আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকায়। তাঁর এক ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে।
১৫ ডিসেম্বর লিটন নিরপরাধ বলে আদালতে বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ তুলে ধরেন তাঁর আইনজীবী সুলতা নাথ। মামলার আসামি লিটন ও কারাভোগকারী লিটন একই ব্যক্তি কি না, তা তদন্ত করে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তোফায়েল আহমেদককে (ওসি) নির্দেশ দেন আদালত। গতকাল সোমবার পুলিশের পক্ষ থেকে লিটন নিরপরাধ বলে আদালতে একটি প্রতিবেদন দেওয়া হয় এবং বিষয়টি ভুল হয়েছে বলে ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়। ভবিষ্যতে আর এ ধরনের ভুল হবে না, গ্রেপ্তারের বিষয়ে আরও সতর্ক থাকার অঙ্গীকার করা হয়।
এ ঘটনায় গত শনিবার প্রথম আলো অনলাইন সংস্করণে ‘শুধু নামের মিলের কারণে জেল খাটছেন লিটন’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়।
গতকাল শুনানি শেষে লিটন নিরপরাধ হওয়ায় মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে দ্রুত কারামুক্ত করার নির্দেশ দেন আদালত। আজ বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কারামুক্ত হন তিনি। দুপুরে বাড়ি ফেরেন।
আজ সন্ধ্যায় উপজেলার শুকলালহাট বাজারে তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বিপরীতে একটি দোকানে বসে কারাগারে থাকার ১০ দিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন লিটন। এ সময় তিনি কেঁদে ফেলেন।
যেভাবে গ্রেপ্তার হলেন
৯ ডিসেম্বর শুক্রবার ছিল। সেদিন বেলা ১১টার দিকে অচেনা নম্বর থেকে সীতাকুণ্ড থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মোতাব্বির হোসেন তাঁকে ফোন করেন বলেন, তিনি বাসা পরিবর্তন করবেন। তাই বাসায় কিছু আলমারি মেরামত ও রং করাতে চান। এসআই মোতাব্বিরকে কোথায় আসতে হবে সেটা জিজ্ঞেস করেন লিটন। পরে এসআই মোতাব্বির সীতাকুণ্ড পৌর সদরের গোডাউন রোড এলাকায় যেতে বলেন। তিনিও সাড়ে ১১ দিকে গোডাউন রোডে যান এবং তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। তখনো তিনি জানতেন না, পুলিশের ফাঁদে পড়েছেন। কারণ, মোতাব্বিরকে তিনি চিনতেন না। পরে কথা বলতে বলতে তাঁকে থানায় ডেকে নেওয়া হয়। এরপর তাঁকে জানানো হয়, তাঁকে একটি ডাকাতির মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গতকাল সোমবার পুলিশের পক্ষ থেকে লিটন নিরপরাধ বলে আদালতে একটি প্রতিবেদন দেওয়া হয় এবং বিষয়টি ভুল হয়েছে বলে ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়।
কথা শুনে তাঁর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। পরিবারের সদস্যদের ফোন করে বিষয়টা জানাতে বলার পর তিনি তাঁর স্ত্রীকে ফোন করেন। এ সময় তিনি কান্না ধরে রাখতে পারছিলেন না। থানার দোতলায় তাঁকে প্রাথমিক কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এ সময় জাতীয় পরিচয়পত্র দেখানোর চেষ্টা করলেও পুলিশ দেখতে চায়নি। পরে দুই ঘণ্টার মধ্যে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়।
লিটন বলেন, কারাগারে গিয়ে তিনি যেন এক অন্ধকার জগতে ঢুকে পড়লেন। বিশাল এক দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন তিনি। বাইরে কী হচ্ছে, তা তিনি জানেন না। তখন নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে কাঁদা ছাড়া তার আর কিছুই করার ছিল না। অনিশ্চয়তায় কেটে গেল সাত দিন। ১৫ ডিসেম্বর তিনি জানতে পারেন, তাঁকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। পরে কয়েকজন কর্মকর্তা এসে তাঁকে বিভিন্ন বিষয় জিজ্ঞাসা করেন।
গত রোববার তিনি নিশ্চিত হন, তিনি মুক্তি পাচ্ছেন। ছেলে নুর উদ্দিন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসার পর জানতে পারেন, দু-এক দিনের মধ্যে মুক্তি পাচ্ছেন। পুলিশের পক্ষ থেকে ভুল স্বীকার করা হচ্ছে। এই কথা শোনার পর তাঁর সময় যেন আর কাটছিল না। কবে শুনানি হবে আর কবে বের হবেন—এ চিন্তায় তাঁর রাত যেন ফুরোয় না। গতকাল তাঁকে আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। শুনানি শেষে তাঁকে কেন এত দিন কারাগারে রেখেছেন, আদালত জিজ্ঞাসা করেন। পরে আদালত তাঁকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে মুক্তির আদেশ দেন।
লিটন বলেন, আদেশ পাওয়ার পর আর যেন এক মুহূর্ত জেলে থাকতে মন চাইছিল না। রাত পোহাচ্ছিল না কোনোমতেই। সারা রাত ঘুম হয়নি। গতকাল বেলা ১১টার দিকে তিনি কারাগার থেকে বের হন।
বাড়ি থেকে তাঁর ছেলে এবং স্বজনেরা প্রাইভেট কার নিয়ে তাঁকে কারাগার থেকে আনতে যান। কারাগার থেকে বের হয়ে স্বজনদের দেখে তিনি আনন্দে হাউমাউ করে কাঁদেন। এরপর বাড়িতে ঢুকতেই তাঁর দুই মেয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। তিনিও কেঁদেছেন। এ সময় আত্মীয়স্বজন দেখা করতে আসেন।
লিটন বলেন, ‘আমার ব্যবসার প্রচুর ক্ষতি হলো। অনেকগুলো আলমারির অর্ডার বাতিল হয়ে গেল। মন বসাতে পারছি না। কবে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চালু করতে পারব তা জানি না।’
লিটন আরও বলেন, ‘সোমবার আদালতে পুলিশের এসআই মোতাব্বির তাঁর ভুলের জন্য ক্ষমা চান এবং আমাকে সব ধরনের সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন। তবু যেন পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তির আবেদন না করি। আমি পুলিশের বিরুদ্ধে শাস্তির আবেদন করিনি ঠিকই, কিন্তু পুলিশ যদি আমাকে অন্য কোনোভাবে ফাঁসিয়ে দেয়, সেই ভয় আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।’