একবার ধবধবে সাদা পাঞ্জাবিতে হাত ফসকে এক কাপ গরম চা পড়ে গেল। মুহূর্তেই সাদা পাঞ্জাবির উপর গাঢ় বাদামি রঙের মানচিত্র তৈরি হয়ে গেল। যার পাঞ্জাবি তিনি শান্তভাবে পাঞ্জাবিটা আজলা করে ধরে বাথরুমে চলে গেলেন। এবং সাবান পানি দিয়ে পরিষ্কার করতে থাকলেন এক মনে। যে স্ত্রী চা ফেলে দিয়েছে, সে কাঠগড়ার আসামীর মত বাথরুমের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। স্ত্রীর বেগতিক অবস্থা দেখে ভেতর থেকে তাকে আশ্বস্ত করা হলো, “ধুর এটা কোন ব্যাপার না!”
যতই এই স্ত্রীর হাত থেকে জিনিস পরে ভেঙে যাক না কেন, এই হাজব্যান্ড কখনো বিচলিত হোন না। অস্থির হন না। রেগে যান না। বারাকাল্লাহু ফিক এই ব্যাপারে তিনি ফ্রিজের বরফের মতোই ঠান্ডা থাকেন। এই কৃতিত্বের একটা ক্রেডিট এই বোন তার শ্বশুর আব্বাকে দিলেন। তিনি সারা জীবন আব্বাকে দেখেছেন, হাত থেকে কিছু পড়ে গেল ছোট খাটো বিষয় নিয়ে মাতামাতি না করতে।
এই টপিকে তার ছোটবেলার একটা গল্প এখনো স্পষ্ট মনে আছে। সে তখন ক্লাস ফাইভ অথবা সিক্সে পড়তো। বাসায় অনেক মানুষের দাওয়াত! এবং সে হন্যে হয়ে কোন কারনে আব্বাকে খুঁজছেন। খুঁজতে খুঁজতে সাইডে রাখা একটা টেবিলে ধাক্কা খেয়ে সেখানকার গ্লাস, প্লেট গুলো একটা একটা করে সব মাটিতে পড়ে ভেঙে যায়। সে তখন একদম ছোট, ঘর সুদ্ধ মানুষের সামনে তাকে অপমান করলে এটা যে তার মানসিক বিকাশের ক্ষতিকর হতে পারে, সেজন্য আব্বা মাথা ঠান্ডা রেখে খাদেমদেরকে ডেকে জায়গাটা পরিষ্কার করিয়ে দিলেন! গ্লাস, প্লেট ভেঙে গিয়েছে, অনিচ্ছাকৃতভাবে ভেঙেছে, সেটা আরো দুইটা হয়তো কিনে নেওয়া যাবে! কিন্তু একটা ছোট বাচ্চার মন ভেঙে দিলে, সেটা সহজে ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না।
এই ঘটনা নাকি তার এখনো মনে আছে! সুবহান আল্লাহ!
সে আজো আব্বাকে অ্যাপ্রিশিয়েট করেন, যে আব্বা ঐ দিন তাকে ঘর ভর্তি মানুষের সামনে অপমান করেননি। এবং এই ব্যাপারগুলো তার মানসিক বিকাশে এমন সাহায্য করেছে যে, যার জন্য হয়তো আজ অনেক বছর পরেও সে বিভিন্ন বিষয়ে আত্মবিশ্বাসের একটা জায়গা খুঁজে পায়, আলহামদুলিল্লাহ! তো দেখা যাচ্ছে, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার জন্য এই ব্যাপারগুলোতে মাথা ঠান্ডা রাখা সহজ করে দিয়েছেন!
অপরদিকে আমার নিজের ছোটবেলার চিত্রটা অন্যরকম। খেলতে খেলতে হাত থেকে কিছু পড়ে গেলে বাসায় মোটামুটি মাথা নষ্ট অবস্থা! “আল্লাহ !! এত সুন্দর জিনিসটা ভেঙে ফেললা ??!” মাথা গরম হত, এরপর হয়তো হালকা পাতলা মার খেতে হতো।
এবং আমি অনেক পরে গিয়ে জেনেছি, যে ব্যক্তি এরকম ব্যবহার করতেন, তার নিজের শৈশবটাও খুব সুখকর ছিল না। সে ছোটবেলায় ঘরের সব কাজ গুছিয়ে করত, কিন্তু তারপরও অনেক আজেবাজে কথা তাকে শুনতে হতো। তিনি ছোটবেলায় ভালোবাসা এবং মমতা কম পেয়েছেন। যার জন্য ছোট বিষয়েও অস্থির হয়ে যান। কারণ তিনি ছোট থাকতে তার ছোট বিষয়গুলোতেও অন্যরা অস্থিরতা, অসন্তোষ দেখাতো। তাহলে দেখা যাচ্ছে উনার জন্য অস্থির হওয়ার পথটা সুগম এবং অন্য পথটা কঠিন।
তাহলে কি দাঁড়াচ্ছে ? আসলে আল্লাহ কোন একটা কাজ আমার জন্য সহজ করে দিতে পারেন। আল্লাহর কুদরতে আমাকে এমন অভিজ্ঞতা, ঘটনা এবং শক্তির সম্মুখীন করেন যে কিছু কাজ আমার জন্য সহজ হয়ে যায়।
যেমন: ছোটবেলা থেকে সাজগোজের প্রতি আমার খুব একটা আগ্রহ ছিল না। তাই আমি যখন পর্দা শুরু করি, আমার জন্য এটা তুলনামূলক অনেক সহজ ছিল আলহামদুল্লিলাহ। অপরদিকে আমি এমন মানুষ দেখেছি, যার সাজগোজের প্রতি ঝোঁকে একদম পাগল প্রায় অবস্থা! তার জন্য পর্দার মধ্যে আসাটা জিহাদের সমতুল্য! সেই একই পর্দা আমার জন্য আল্লাহ অনেক সহজ করেছেন আলহামদুলিল্লাহ!
এটাতে আমার কিন্তু কৃতিত্ব নেই। আবার অন্য আরেকজনের জন্য সেই একই কাজ অনেক কঠিন, তার মানে এই না যে, অজুহাত দেখিয়ে আমরা এখন খারাপ পথ বেছে নিব। কারো পূর্ব অভিজ্ঞতার জন্য কাউকে গুনাহ করার লাইসেন্স দেয়া হয় না। উপরে যে ব্যক্তির উদাহরণ দিয়েছি তিনি প্রতিনিয়ত আল্লাহর আরো কাছে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। হয়তো আমার থেকে তার চেষ্টার মূল্যায়ন আল্লাহর কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ! কারণ আমার জন্য এটা সহজ, আমি এটা নিয়ে তেমন স্ট্রাগল করছি না। কিন্তু তার আন্তরিক সংগ্রাম আল্লাহর কাছে হয়তো অনেক প্রিয়!
এবং তার মানে আরো এই যে, আরেকজন যখন আমার মত একটা কাজ করতে পারে না, আমার তার প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার কথা। আমি তো জানি না কে কীসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং গিয়েছে। Empathy নিয়ে আসার কথা ভ্রু কুচকানোর আগে। কোন একটা নেকির কাজ যদি আমাকে অহংকারী বানিয়ে দেয়, তার থেকে কোন একটা গুনাহ –যেটা আমার অন্তর নরম করে আমাকে তাওবাকারী বানিয়ে আল্লাহর আরো কাছে নিয়ে যাবে, সেটা উত্তম!
এক জুমার খুতবাতে এই কথাগুলো শুনেছিলাম।
অন্তরে গেঁথে গেল,
Perhaps a sin that humbles you is better than a good deed that makes you arrogant!
SubhanAllah! আত্মার পরিশুদ্ধি যে কি দারুণ একটা প্রক্রিয়া, প্রতিটা পদে পদে সেটা মনে হয়। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকাটাই জীবনের একটা সাফল্য আলহামদুলিল্লাহ।
~শারিন সফি অদ্রিতা