মাহাথির মোহাম্মদ সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী ছিলেন। পরিচিত ছিলেন ক্যারিশম্যাটিক, উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও সংস্কারপন্থী রাজনীতিক হিসেবে। ভাবা হয়ে থাকে, মালয়েশিয়ার আজকের উন্নয়নের পেছনে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। তাঁকে ভাবা হতো মাহাথিরের উত্তরসূরি। কিন্তু ১৯৯৮ সালে তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে বরখাস্ত করেন মাহাথির। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও সমকামিতার অভিযোগে মামলা হয়।
তখন অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন, তাঁর রাজনৈতিক জীবন শেষ হয়ে গেল। কিন্তু রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। তিনি আবার ফিরে এলেন। যিনি তাঁর জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিলেন, তাঁকে কারাগারে পুরে রেখেছিলেন, তাঁর রাজনৈতিক জীবনই শেষ করে দিচ্ছিলেন, সেই মাহাথিরের সঙ্গে গত নির্বাচনে জোট বেঁধেছিলেন। জোটের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, তাঁদের সরকারের আমলে মাহাথির ও তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ ভাগাভাগি করে থাকার ছিল। কিন্তু মাহাথির প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে আবার তাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন ভেস্তে যায়। এত কিছুর পরও তিনি ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। ২৫ বছরের দীর্ঘ অপেক্ষা আর সংগ্রামের পর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। সেই তিনি আনোয়ার ইব্রাহিম।
এবারও আনোয়ার ইব্রাহিমের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথ মসৃণ ছিল না। কোনো দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় অনিশ্চয়তার দোলাচলে ঘুরপাক খাচ্ছিল মালয়েশিয়ার রাজনীতি। সাধারণ নির্বাচনের পর রাজার হস্তক্ষেপে টানা পাঁচ দিনের অচলাবস্থার কেটেছে। আজ বৃহস্পতিবার দেশটির দশম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন তিনি।
মালয়েশিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন আনোয়ার ইব্রাহিম। ১৯৫৭ সালে দেশটির স্বাধীনতার পর থেকে মালয়েশিয়ার পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণে ব্যর্থ হওয়ার এমন ঘটনা আর ঘটেনি। গত শনিবার জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এতে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই জোটের কেউই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। নির্বাচনে আনোয়ার ইব্রাহিমের পাকাতান হারাপান (পিএইচ) জোট সর্বোচ্চ ৮২টি আসনে জয় পায়। আর মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের নেতৃত্বাধীন মালয়–মুসলিম পেরিকাতান ন্যাসিওনাল (পিএন) পায় ৭৩টি আসন। কোনো জোটই ২২২ আসনের পার্লামেন্টে সরকার গঠনে প্রয়োজনীয় ১১২ আসন পায়নি।
বর্তমান ক্ষমতাসীন জোট বারিসান ন্যাসিওনাল নির্বাচনে ৩০টি আসন পায়। কিন্তু তারা কোনো জোটকে সমর্থন না দেওয়ায় বিপত্তি বেধেছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক অচলাবস্থা অবসানের দায়িত্ব পড়ে রাজার ওপর। তিনি দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে বসে জোট সরকার গঠনের প্রস্তাব দেন। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের বিষয়ে আগের সরকারপ্রধানদের পরামর্শ নেন। কিন্তু তাতেও বিষয়টির সুরাহা হয়নি। আজ বৃহস্পতিবার রাজা আবার দেশটির রাজকীয় সুলতানদের সঙ্গে বৈঠক করে আনোয়ার ইব্রাহিমকে সরকার গঠন করতে বলেন।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পেয়ে আনোয়ার ইব্রাহিমের দুই দশকের বেশি সময়ের প্রতীক্ষার অবসান হতে যাচ্ছে। ৭৫ বছর বয়সী এই নেতা বছরের পর বছর খুব কাছাকাছি এসেও প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। তিনি ১৯৯০ সালে উপপ্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। মাহাথিরের সঙ্গে নির্বাচনী জোটের চুক্তি অনুযায়ী ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন তিনি।
আজ শপথ গ্রহণের পর মালয়েশিয়ার ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরা আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর আমি সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করব। আমি মালয়েশিয়ার প্রতি আমার সত্যিকারের আনুগত্য প্রকাশ করব।’
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর আনোয়ার ইব্রাহিমকে বেশ কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। প্রথম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করাও তাঁর সামনে চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া গোষ্ঠীগত উদ্বেগ কমাতেও কাজ করতে হবে তাঁকে। তবে তাঁর সামনে এখন বড় বিষয় হচ্ছে আগামী বছরের বাজেট। নির্বাচনের আগেই এ বাজেট উত্থাপন করা হলেও তা পাস হয়নি। এ ছাড়া পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণে অন্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে চুক্তিতে আসতে হবে তাঁকে।
দেশটির রাজধানী কুয়ালালামপুরে আনোয়ারের সমর্থকেরা আনন্দ উদ্যাপন করছেন। ৩৬ বছর বয়সী নরহাফিজাহ আশরাফ হাসান বলছেন, ‘আমি শিহরিত। প্রধানমন্ত্রী হতে তিনি কঠোর পরিশ্রম করেছেন। আমি আশা করি, তিনি ভালো করবেন এবং তাঁর যোগ্যতা প্রমাণ করবেন।’ মোহাম্মদ তৌফিক জামরি বলেন, ‘অনুভূতি ভাষায় প্রকাশের মতো নয়।’
সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের আহ্বান মুহিউদ্দিনের
দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিন প্রতিদ্বন্দ্বী আনোয়ার ইব্রাহিমকে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের আহ্বান জানিয়েছেন। গতকাল তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সুলতান নিয়োগ দেওয়ার পর মুহিউদ্দিন এ আহ্বান জানান।
বারিসান দলের পক্ষ থেকে গতকাল বলা হয়েছে, তারা মুহিউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন সরকারকে সমর্থন করবে না। তবে আনোয়ারের সরকারকে সমর্থনের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি দলটি।
রাজনৈতিক অস্থিরতার ঝুঁকি
মালয়েশিয়া কয়েক বছর ধরেই রাজনৈতিক অস্থিরতার মুখে। কয়েক বছরের মধ্যে তিনজন প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে মালয়েশিয়া। সম্প্রতি দেশটিতে ‘স্থিতিশীলতা’ ফেরানোর লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী ইসমাইল সাবরি ইয়াকুব আগাম নির্বাচনের ডাক দেন। নির্বাচন–পরবর্তী গোলযোগের কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়। করোনা মহামারি–পরবর্তী অর্থনৈতিক অবস্থা পুনরুদ্ধারে প্রয়োজনীয় নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঝুঁকিও বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে আনোয়ার ইব্রাহিম প্রগতিশীল ও মুহিউদ্দিন রক্ষণশীল জোটের নেতৃত্ব দিয়ে নির্বাচনে অংশ নেন।
আনোয়ার নির্বাচনের আগে একটি সাক্ষাত্কারে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়বেন এবং দেশকে বর্ণবাদ ও ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে মুক্ত করবেন। মুহিউদ্দিনের জোটে এবার বড় ধরনের উত্থান ঘটেছে ইসলামিক পার্টির। ইসলামপন্থীদের উত্থান নিয়ে মালয়েশিয়ায় বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। মালয়েশিয়ার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের জাতি ও ধর্ম নিয়ে উসকানিমূলক পোস্ট দেওয়ার বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছে পুলিশ।