কুমিল্লা ও আশপাশের জেলাগুলো নিয়ে নতুন বিভাগ করতে যাচ্ছে সরকার। আগামী রোববার প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসসংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির (নিকার) সভায় ‘মেঘনা’ নামের এই বিভাগ অনুমোদনের প্রস্তাব আলোচ্যসূচিতে আছে। তবে কুমিল্লায় বিভাগের নাম নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। তাঁরা নদীর নামের বদলে জেলার নাম দিয়েই বিভাগ চান। কেউ কেউ বলছেন, কুমিল্লায় বিভাগ প্রতিষ্ঠা এই অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি। যে নামেই হোক তাঁরা কেবল বিভাগ বাস্তবায়ন চান।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ২৬ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে চট্টগ্রাম বিভাগকে ভেঙে কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চল নিয়ে পৃথক বিভাগ করা যায় কি না, এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরীক্ষা–নিরীক্ষার নির্দেশনা দেন। এরপর বিভাগের নাম ময়নামতি ও মেঘনা নামকরণ করার কথা বিভিন্ন সময়ে উচ্চারিত হয়। কিন্তু কুমিল্লাবাসী কুমিল্লা নামেই বিভাগের পক্ষে আন্দোলন করে।
কুমিল্লা বিভাগ বাস্তবায়নের জন্য ১৯৮৯ সালের ৫ জানুয়ারি একটি কমিটি গঠন করা হয়। কুমিল্লা গণদাবি পরিষদ নামের ওই সংগঠনের ব্যানারে বিভিন্ন সময়ে বিভাগ আন্দোলন হয়। এই সংগঠনের আহ্বায়ক প্রবীণ আইনজীবী মোখলেছুর রহমান চৌধুরী। জানতে চাইলে আজ মঙ্গলবার রাতে তিনি বলেন,‘যে নামেই বিভাগ হোক, কুমিল্লায় বিভাগ হওয়া দরকার। তিন দশক বিভাগের জন্য আন্দোলন, জনমত গঠন করেছি। এখন বিভাগটা হলে খুশি হব।’
আমার আবেগ কুমিল্লা। আমার ভালোবাসা কুমিল্লা। এটা যুদ্ধ করার বিষয় না, এটা প্রশাসনিক বিষয়। বিভাগটা হোক।’
কুমিল্লা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মফিজুর রহমান
তবে এই মতের বিপরীতে অনেকেই কুমিল্লা নামেই বিভাগ চান। তাঁদের একজন বেগম রোকেয়া পদকপ্রাপ্ত নারীনেত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা পাপড়ি বসু। তিনি বলেন, ‘এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না। কুমিল্লা নামেই বিভাগ চাই।’ সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কুমিল্লা জেলা শাখার সভাপতি শাহ মো. আলমগীর খানেরও একই মত। তিন বলেন, ‘কুমিল্লা বাংলাদেশের ঐতিহাসিক জেলা। এই জেলার নামেই আমরা বিভাগ চাই।’
মেঘনার বদলে কুমিল্লা নামের বিভাগের দাবিতে বিভিন্ন সময় সরব থাকতে দেখা গেছে কুমিল্লা-৬ (আদর্শ সদর, সিটি করপোরেশন ও সেনানিবাস এলাকা) আসনের সংসদ সদস্য ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আ ক ম বাহাউদ্দিনকে। তিনি জাতীয় সংসদে, ঢাকায়, কুমিল্লায় বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও ঘরোয়া আড্ডায় কুমিল্লা নামে বিভাগের নামের পক্ষে বক্তব্য দেন। ১৯৮৬ সালে কুমিল্লা বিভাগ বাস্তবায়ন আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তত্কালীন কুমিল্লা পৌরসভার চেয়ারম্যান বাহাউদ্দিন।
গত বছরের ২১ অক্টোবর ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের নয়তলাবিশিষ্ট নবনির্মিত অত্যাধুনিক ভবনের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিভাগের নাম কুমিল্লা করার দাবি তুলে ধরেন সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন। যদিও প্রধানমন্ত্রী তা তাৎক্ষণিক নাকচ করে দেন। সেদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘বিভাগের ব্যাপারে আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি দুইটা বিভাগ বানাব, আমার দুইটা নদীর নামে। একটা পদ্মা, একটা মেঘনা। এই দুই নামে দুইটা বিভাগ করতে চাই।’ তখন সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বলেন, ‘কুমিল্লা নামে।’ জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কু নাম দেব না আমি।’ তখন বাহাউদ্দিন বলেন, ‘না আপা, কুমিল্লা নামে। সারা কুমিল্লার মানুষ এটা চায়।’ জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি কুমিল্লা নামে দেব না। কারণ, তোমার এই নামের সাথে মোশতাকের নাম জড়িত। সেই জন্য আমি দেব না।’ তখন সংসদ সদস্য বলেন, ‘আপা মোশতাকের কুমিল্লা না। কুমিল্লা ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের, শচীন দেববর্মনের, নওয়াব ফয়জুন্নেছার।’ এরপর প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নো, না আমি দেব না তো বললাম? কুমিল্লা নাম নিলেই তো মোশতাকের কথা মনে ওঠে…।’
নিকারের সভায় ‘মেঘনা’ নামের বিভাগ অনুমোদনের প্রস্তাব আলোচ্যসূচিতে থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বলেন, রোববারের নিকারের সভায় বিষয়টি উঠবে কি না, তিনি জানেন না। এই প্রতিবেদকের কাছ থেকেই বিষয়টি প্রথম শুনলেন।
কুমিল্লার ইতিহাসবিদ আহসানুল কবীর বলেন, বৃহত্তর কুমিল্লা ও নোয়াখালীর ছয় জেলার মধ্যবর্তী স্থানে কুমিল্লার অবস্থান। ভৌগোলিক ও উন্নত যোগাযোগব্যবস্থার কারণে কুমিল্লা খুবই সমৃদ্ধ জনপদ। এ ছয় জেলার মানুষের সঙ্গে সড়ক, রেল ও নদীপথে যোগাযোগ অত্যন্ত মসৃণ। দাপ্তরিক বেশির ভাগ কাজেই ছয় জেলার মানুষ কুমিল্লায় জড়ো হন। এখানে দিনে এসে দিনে কাজ করে বাড়ি ফিরে যাওয়া সম্ভব। ছয় জেলার মানুষের আঞ্চলিক ভাষাও কাছাকাছি। আত্মীয়স্বজনও কুমিল্লায় থাকেন। তার ওপর প্রশাসনে যাঁরা কাজ করতে আসেন, তাঁদের বেশির ভাগই এখানে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে কুমিল্লায় বিভাগ হলে ঢাকা ও চট্টগ্রামের ওপর চাপ কমবে।
অন্য কোনো নামে বিভাগ চাই না। কুমিল্লার নাম বহির্বিশ্বেও জানে। আমরা কোনো নদীর নামে বিভাগ চাই না।
কুমিল্লা মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব ইউসুফ মোল্লা টিপু
১৯৮৯ সালে বৃহত্তর কুমিল্লার কুমিল্লা, চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং বৃহত্তর নোয়াখালীর নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুরসহ ছয়টি জেলা নিয়ে কুমিল্লা বিভাগ প্রতিষ্ঠার দাবি শুরু হয়। কুমিল্লা গণফোরাম নামের একটি সামাজিক সংগঠনের ব্যানারে ওই দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে কুমিল্লা গণদাবি পরিষদ করা হয়। বর্তমানে বৃহত্তর কুমিল্লা ও বৃহত্তর নোয়াখালীর ছয়টি জেলায় প্রায় দুই কোটি জনসংখ্যা রয়েছে। ওই ছয় জেলার আয়তন প্রায় ১৩ হাজার বর্গকিলোমিটার।
কুমিল্লা মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব ইউসুফ মোল্লা টিপু বলেন, ‘কুমিল্লা নামেই আমরা বিভাগ চাই। অন্য কোনো নামে বিভাগ চাই না। কুমিল্লার নাম বহির্বিশ্বেও জানে। আমরা কোনো নদীর নামে বিভাগ চাই না।’ জেলার নামেই বিভাগের নামকরণ হওয়া উচিত বলে মনে করেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কুমিল্লা জেলার সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা সুজাত আলীও। উদীচী কুমিল্লার সভাপতি শেখ ফরিদ বলেন, ‘কুমিল্লায় বিভাগীয় সদর দপ্তর হবে। এই জেলার নামে বিভাগ চাই।’
অবশ্য কুমিল্লা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মফিজুর রহমান বলেন, ‘আমার আবেগ কুমিল্লা। আমার ভালোবাসা কুমিল্লা। এটা যুদ্ধ করার বিষয় না, এটা প্রশাসনিক বিষয়। বিভাগটা হোক।’