২০১১ সালের ৯ এপ্রিল। সিঙ্গাপুর বন্দরের পাসির পানজাং টার্মিনাল। ওই দিন একটি খালি কনটেইনার থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের দুজন অস্থায়ী শ্রমিককে উদ্ধার করেন বন্দরকর্মীরা। এর মধ্যে দ্বীন ইসলামকে কঙ্কালসার অবস্থায় এবং আল আমিন নামের আরেক শ্রমিককে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। ২০১১ সালের ১ এপ্রিল এই দুজন একটি খালি কনটেইনারে উঠে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। এরপর কনটেইনারটি এমভি হ্যানসা ক্যালিডোনিয়া জাহাজে তোলা হয়। সিঙ্গাপুর বন্দরে নামানোর পাঁচ দিন পর কনটেইনার খুলে একজনকে জীবিত ও আরেকজনকে মৃত উদ্ধার করা হয়। এরপর তাঁদের দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।
কনটেইনারে লুকিয়ে বিদেশে যাওয়ার এটিই প্রথম ঘটনা নয়। গত শনিবারও এ ধরনের একটি ঘটনা ঘটে বলে বিষয়টি আবার সামনে এসেছে। সেদিন চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মালয়েশিয়ার পেনাং বন্দরে যাওয়া একটি কনটেইনার খুলে একটি মরদেহ উদ্ধার করেছে মালয়েশিয়ার পুলিশ। খালি কনটেইনার তিন ধাপে যাচাই-বাছাই করার পরও এভাবে বিদেশে যাওয়া ঠেকানো যাচ্ছে না। এতে দেশের ভাবমূর্তিও নষ্ট হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ।
গত শনিবারের ঘটনাসহ গত এক যুগে এমন আটটি ঘটনার কথা জানা যায়। এভাবে লুকিয়ে বিদেশে যাওয়ার সময় এ নিয়ে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। সাতজন জীবিত ফিরতে সক্ষম হয়েছেন। এই সাতজনের মধ্যে দুজনকে চট্টগ্রাম বন্দর ফটক ও জাহাজ থেকেই আটক করে নামিয়ে আনা হয়। বাকি পাঁচজনকে সিঙ্গাপুর, ভারত, মালয়েশিয়া ও ফ্রান্সশাসিত আফ্রিকার দেশ রি-ইউনিয়ন থেকে ফেরত আনা হয়।
২০১৬ সালের ১৯ অক্টোবর ভারতের বিশাখাপত্তনাম বন্দরে একটি খালি কনটেইনার থেকে রোহান হোসেন নামের এক বাংলাদেশিকে উদ্ধার করে ভারতীয় পুলিশ। খালি কনটেইনারটি চট্টগ্রামের একটি ডিপো থেকে এনে বন্দর দিয়ে এমভি সিনার বটম জাহাজে তুলে দেওয়া হয়েছিল। জাহাজটি বন্দর ছেড়ে যাওয়ার ১২ দিন পর রোহানকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। রোহানের বাড়ি মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুরে ছিল।
২০১৭ সালের ৩১ জুলাই যুক্তরাজ্যগামী পোশাকের একটি কনটেইনার থেকে বাবুল ত্রিপুরা নামের এক শ্রমিককে উদ্ধার করেন চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপত্তাকর্মীরা। কনটেইনারের ভেতর থেকে শব্দ শুনে নিরাপত্তাকর্মীরা তাঁকে উদ্ধার করেন।
বাংলাদেশ থেকে কনটেইনারে লুকিয়ে বিদেশযাত্রার প্রথম ঘটনা ধরা পড়ে ২০১০ সালে। ওই বছর ৮ জুন অবৈধভাবে বন্দরে ঢুকে সোয়েব রিপন নামের এক যুবক ‘এমভি হ্যানসা ক্যালিডোনিয়া’ জাহাজে লুকিয়ে থাকেন। সিঙ্গাপুরে যাত্রাপথে একজন নাবিক জাহাজে ওই ব্যক্তিকে শনাক্ত করেন। পরে ওই যুবককে একই জাহাজে করে চট্টগ্রামে ফেরত আনা হয়। বিনা পাসপোর্টে বিদেশভ্রমণের অপরাধে তাঁর বিরুদ্ধে ওই বছরের ১৯ জুন মামলা করে সি কনসোর্টিয়াম লিমিটেডের ব্যবস্থাপক (অপারেশন) সাইফুল ইসলাম।
গত এক যুগে এমন আটটি ঘটনার কথা জানা যায়। এভাবে লুকিয়ে বিদেশে যাওয়ার সময় এ নিয়ে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। সাতজন জীবিত ফিরতে সক্ষম হয়েছেন।
এরপর একই বছরের ৭ ডিসেম্বর বন্দরের ১৩ নম্বর জেটিতে ভেড়ানো এমভি মার্কস উইলমিংটন জাহাজে করে মালয়েশিয়ায় যান ফল বিক্রেতা মো. রিপন। মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পর কনটেইনার থেকে বেরিয়ে এলে তাঁকে আটক করেন নাবিকেরা। মালয়েশিয়ায় নামানোর অনুমতি না পেয়ে শেষ পর্যন্ত জাহাজটি যাত্রাপথে ভারত মহাসাগরের পাশে ফ্রান্সশাসিত আফ্রিকার দেশ রি-ইউনিয়নে নামিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। ২০১১ সালের ১৫ জানুয়ারি ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাঁকে ফেরত আনা হয়।
২০১১ সালের ২৬ এপ্রিল এমভি টাম্পা বে নামের শ্রীলঙ্কার কলম্বোগামী একটি জাহাজে লুকিয়ে বিদেশে যাওয়ার সময় বরিশালের আকতার আলী নামের এক ব্যক্তিকে আটক করেন বন্দরকর্মী ও নাবিকেরা। তাঁকে সে সময় পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি এমভি হ্যানসা ক্যালিডোনিয়া জাহাজে করে সিঙ্গাপুরে যাওয়ার সময় ধরা পড়েন মো. রিপন নামের আরেক ব্যক্তি। সিঙ্গাপুর বন্দর কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে একই জাহাজে তাঁকে ফিরিয়ে আনা হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি তাঁকে বন্দর থানায় হস্তান্তর করা হয়।
তবে গত শনিবার উদ্ধার হওয়া সেই লাশ কার? তিনি জীবিত অবস্থায় চট্টগ্রামের কোথা থেকে এবং কীভাবে কনটেইনারে উঠলেন, তা এখনো শনাক্ত করতে পারেনি বন্দর কর্তৃপক্ষ। খালি কনটেইনারটি নেওয়ার আগে প্রথমে ডিপো, এরপর বন্দরের ফটক দিয়ে ঢোকার সময় এবং সর্বশেষ জাহাজে তোলার আগে দরজা খুলে যাচাই করার কথা। বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষ ও বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তিন ধাপে কনটেইনার খুলে দেখা হয়েছে। তাহলে কি জাহাজে তোলার পর কনটেইনারে লুকিয়েছেন নাকি তার আগেই কনটেইনারে ছিলেন, তা নিশ্চিত করতে পারেনি বন্দর কর্তৃপক্ষ।
বিষয়টি নিয়ে মালয়েশিয়ার পুলিশ এখন তদন্ত করছে। জাহাজ ও কনটেইনারের মালিকপক্ষ কোরিয়াভিত্তিক সিনোকর শিপিং লাইনের প্রতিনিধি গ্লোব লিংক অ্যাসোসিয়েটসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মঈনুল হক চৌধুরী বলেন, ‘ঘটনাটি সম্পর্কে জানিয়ে বন্দরকে চিঠি দিয়েছি। মালয়েশিয়ার পুলিশ তদন্ত করছে, তা জানানো হয়েছে।’
বন্দর সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘বিষয়টি যাচাই করে দেখা হচ্ছে। পেনাং বন্দর কর্তৃপক্ষ আমাদের জানানোর পর আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু হবে।’
গত অর্থবছরে বন্দর দিয়ে বিদেশে পাঠানো হয় ৪ লাখ ৭৮ হাজার কনটেইনার। এ হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার ৩০৯টি কনটেইনার জাহাজে তোলা হচ্ছে। এই বিপুলসংখ্যক খালি কনটেইনার যাচাই করা হচ্ছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে।
শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, খালি কনটেইনার রপ্তানির আগে যাচাই করার যে ব্যবস্থা রয়েছে, তা পালন করা হলে কোনোভাবেই লোক প্রবেশ করার কথা নয়। এরপরও এ ঘটনা ঘটার অর্থ হলো কোথাও ঘাটতি বা অবহেলা রয়ে গেছে। এটা কঠোরভাবে দেখা উচিত। কারণ, এ ধরনের ঘটনায় বিদেশের বন্দরে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।