এ বছর সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন ফরাসি লেখক আনি এরনো। পুরস্কার ঘোষণার সময় রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি বলেছে, ৮২ বছর বয়সী আনি এরনোকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে তাঁর ৪০ বছরের ‘আপসহীন’ লেখার জন্য, যেখানে লিঙ্গ, ভাষা ও শ্রেণিগত কারণে বিপুল বৈষম্যের শিকার হওয়া জীবনকে তিনি তুলে ধরেছেন অনমনীয় ঋজুতায় এবং দ্ব্যর্থহীনভাবে। আনি এরনো ব্যক্তিগত স্মৃতির গহনে পুঞ্জিভূত হয়ে থাকা অবদমন আর বিচ্ছিন্নতাবোধ উন্মোচনে সিদ্ধহস্ত; শেকড় খোঁড়ার সাহসিকতা তাঁর শিখরতুল্য।
আনি এরনোর বেশ কয়েকটি বিখ্যাত উপন্যাস রয়েছে। অনেকগুলোই আধা–আত্মজীবনীমূলক। ১৯৭৪ সালে তাঁর লেখা প্রথম বই ‘লে আখঁমখে ভিদ’ প্রকাশিত হয়। ১৯৯০ সালে ‘ক্লিনড আউট’ নামে বইটির ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ১৯৮৩ সালে আনি এরনোর উপন্যাস ‘লা প্লাস’ প্রকাশিত হয়। ১৯৯২ সালে এর ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় ‘আ ম্যানস প্যালেস’ শিরোনামে। এই উপন্যাস বিপুল পাঠকপ্রিয়তা পায়। প্রখ্যাত লেখক হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন আনি এরনো।
নোবেল পুরস্কার পাওয়াকে অত্যন্ত সম্মানের বলেছেন আনি এরনো। নোবেল কমিটির চেয়ারপারসন অধ্যাপক কার্ল–হেনরিক হেলডিন বলেছেন, তাঁর কাজ সত্যিই প্রশংসনীয়, সেগুলো টিকে থাকবে।
আনি এরনো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সব খুঁটিয়ে দেখে অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে আত্মজীবনীমূলক গল্পগুলো বলেছেন। এসব গল্পে তিনি সামাজিক অভিজ্ঞতার দ্বন্দ্বগুলো তুলে ধরেছেন।
সাহিত্যে নোবেল পাওয়া প্রথম ফরাসি নারী আনি এরনো। সুইডিশ সম্প্রচারমাধ্যম এসভিটিকে তিনি বলেছেন, লেখালেখি ছিল একটি দায়িত্ব। আনি এরনো বলেন, ‘আমি খুবই বিস্মিত হয়েছিলাম…আমি কখনো ভাবিনি একজন লেখক হিসেবে আমার পরিচয় গড়ে উঠবে। এটা একটি গুরু দায়িত্ব…সবকিছু তুলে ধরা, তা শুধু আমার লেখার ক্ষেত্রেই নয়, বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কের বিচারে ন্যায়পরায়ণতা ও যথার্থতার নিরিখে উপস্থাপন করাটা।’
আনি এরনোর ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, এই লেখকের জন্ম ১৯৪০ সালে ফ্রান্সের উত্তরাঞ্চলের নরমান্ডিতে। তিনি যে পরিবেশে শৈশব কাটিয়েছেন, তা ছিল দারিদ্র্যপীড়িত তবে উচ্চাভিলাষী। তাঁর মা–বাবা একটি ক্যাফে ও মুদিদোকান চালাতেন। যখন তিনি মধ্যবিত্ত শ্রেণির মেয়েদের মুখোমুখি হতেন, সে সময় খেটে খাওয়া শ্রেণির মা–বাবা ও নিজেদের পরিবেশের জন্য তাঁকে লজ্জা দেওয়া হতো।
আনি এরনো পরবর্তী সময়ে নিজের উপন্যাসগুলোতে এসব অভিজ্ঞতা তুলে এনেছেন। তাঁর আত্মজীবনীতে বলা হয়েছে, আনি এরনোর লেখালেখির মূল প্রতিপাদ্য ছিল—শরীর ও যৌনতা; অন্তরঙ্গ সম্পর্ক; সামাজিক অসমতা ও শিক্ষার মাধ্যমে শ্রেণি পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা; সময় ও স্মৃতি; এবং এসব জীবনাভিজ্ঞতা কীভাবে লিখতে হয়, সে প্রশ্ন।
এরনো সাহিত্যে পড়াশোনা করেছেন। লন্ডনে শিশু লালনপালনের কাজও করেছেন তিনি। বিবাহিত এরনো দুই সন্তানের মা। ১৯৭৪ সালে যখন তাঁর প্রথম বই প্রকাশিত হয়, সে সময় একটি ফরাসি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াতেন এরনো।
আনি এরনো ১৯৬৪ সালে গর্ভপাত করেছিলেন। সে সময় তাঁর দেশে গর্ভপাত নিষিদ্ধ ছিল। পরিবারের কাছ থেকেও বিষয়টি গোপন করেছিলেন তিনি। এই অভিজ্ঞতার আলোকেই তিনি লিখেছিলেন প্রথম উপন্যাস ‘ক্লিনড আউট’। এর ২৫ বছর পর তাঁর বই হ্যাপেনিং লেখার সময়ও ওই অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতা তুলে আনেন তিনি। তাঁর এই বই নিয়ে একই নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছিল। গত বছর ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে সেটি শীর্ষ পুরস্কার পায়।
অধ্যাপক কার্ল-হেনরিক হেলডিন বলেছেন, আনি এরনো লেখার স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন। তাঁর কাজ আপসহীন, তাঁর লেখার ভাষা সহজ–সাবলীল।
আশির দশকের শুরুর দিকে বিবাহবিচ্ছেদ হয় আনি এরনোর। ২০০০ সালে শিক্ষকতা থেকে অবসর নিয়ে পুরোদমে লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন তিনি।
এরনোর বই ‘দ্য ইয়ার্স’ ২০০৮ সালে ফ্রান্সের প্রি রেনোদোঁ এবং ২০১৬ সালে ইতালির প্রিমিও স্ট্রেজা পুরস্কার পায়। এর পরের বছর মার্গারেটে ইয়োরকেনার পুরস্কার লাভ করেন আনি এরনো।
২০১৯ সালে ম্যান বুকার পুরস্কারের জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকায় ছিল ‘দ্য ইয়ার্স’। এই গ্রন্থকে ফরাসি জীবনের স্মৃতিচারণার ‘মাস্টারপিস’ বলেন সাহিত্য সমালোচকেরা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাময়িকী দ্য নিউইয়র্কার ২০২০ সালে লিখেছিল, আনি এরনো তাঁর ২০টির বেশি বইয়ে শুধু একটি কাজ করেছেন: নিজের জীবনের খুঁটিনাটি তুলে আনা।