উন্নত দেশগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকলেও বাংলাদেশে তা নেই। যেমন কানাডার আইনে বলা আছে, গভর্নরের অবশ্যই আর্থিক বাজার ও অর্থনীতি নিয়ে সম্পূর্ণ ধারণা থাকতে হবে। অভিজ্ঞতা থাকতে হবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা ও অর্থায়নব্যবস্থা নিয়েও।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হতে হলে কী কী যোগ্যতা থাকতে হবে, তার উল্লেখ নেই দেশের কোথাও। বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিচালিত হয় বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ১৯৭২ অনুযায়ী। এখানে বলা আছে, সরকার গভর্নর পদে নিয়োগ দেবে এবং এর মেয়াদ হবে চার বছর। সরকার চাইলে মেয়াদ বাড়াতে পারবে। তবে বয়স হতে হবে ৬৫ বছরের মধ্যে। বর্তমান গভর্নর ফজলে কবিরকে দ্বিতীয় দফায় নিয়োগ দিতে দুই বছর আগে আইন সংশোধন করে গভর্নরের বয়স বাড়িয়ে ৬৭ বছর করা হয়।
সরকার মানে এখানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। বর্তমান গভর্নর ফজলে কবিরের মেয়াদ আরও তিন সপ্তাহ বাকি থাকতেই আজ শনিবার ছুটির দিনে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বাদশ গভর্নর নিয়োগ দিয়েছে বর্তমান অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদারকে। অর্থসচিবের চাকরি আছে ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত। বর্তমান চাকরি থেকে অগ্রিম অবসরে গিয়ে আগামী ৪ জুলাই তাঁকে গভর্নর পদে যোগ দিতে বলা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর পদটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। দেশের মুদ্রা সরবরাহ কত হবে, টাকার মান কতটা বাড়বে, মূল্যস্ফীতির হার কত রাখা হবে, এ সবই ঠিক করেন গভর্নর। দেশের প্রতিটি মানুষের জীবনযাপনের মান, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান তাঁর সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার মূল ব্যক্তি তাই কীভাবে নিয়োগ পাবেন, কী যোগ্যতাই-বা থাকতে হবে তাঁর, তা প্রায় সব দেশই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে।
বেশির ভাগ দেশে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকলেও আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থাপনা ও ব্যাংকিংয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিকেই বেছে নেওয়া হয়। কোনো দেশই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর পদের জন্য রাজনৈতিক পরিচয় বা সমর্থনকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয় না, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকেই বিবেচনা করা হয়।
স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ১২ জন গভর্নর নিয়োগ দিয়েছে সরকার। তাঁদের বেশির ভাগই আমলা। প্রথম গভর্নর ছিলেন আ ন ম হামিদুল্লাহ। আ ন ম হামিদুল্লাহ (১৯৭২-৭৪) ছিলেন একজন ব্যাংকার। গভর্নর হওয়ার আগে পাকিস্তানের ইস্টার্ন ব্যাংকিং করপোরেশনের (পরে এটি উত্তরা ব্যাংক হয়েছে) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন।
দ্বিতীয় গভর্নর এ কে নাজিরউদ্দীন আহমেদ। তিনি গভর্নর ছিলেন ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত। স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের নির্বাহী পরিচালক, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক অব পাকিস্তানের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন তিনি। এ ছাড়া তিনি বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) কাজ করেছেন।
দেশের সবচেয়ে বেশি সময় গভর্নর ছিলেন এম নূরুল ইসলাম। তিনি তৃতীয় গভর্নর। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত টানা ১১ বছর গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তিনিই বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রথম আমলা গভর্নর। তিনি পাকিস্তান সেন্ট্রাল সার্ভিস কমিশনের (সিএসপি) কর্মকর্তা ছিলেন।
চতুর্থ গভর্নর আরেক আমলা শেফ্তা বখ্ত চৌধুরী (১৯৮৭-৯২)। তিনি কর ক্যাডারের কর্মকর্তা ছিলেন। পঞ্চম গভর্নর হন এম খোরশেদ আলম (১৯৯২-৯৬)। তিনিও ছিলেন একজন সিএসপি কর্মকর্তা।
এর পরে ষষ্ঠ গভর্নর হন লুৎফর রহমান সরকার (১৯৯৬-৯৮)। তিনি ছিলেন একজন ব্যাংকার, সোনালী ব্যাংকসহ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন তিনি।
সপ্তম গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন (১৯৯৮-২০০১)। তিনি অর্থনীতির শিক্ষক ছিলেন, আবার আমলাও ছিলেন।
অষ্টম গভর্নর ফখরুদ্দীন আহমদও (২০০১-২০০৫) একাধারে অর্থনীতির শিক্ষক, আমলা ও বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তা ছিলেন।
নবম গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদও (২০০৫-২০০৯) ছিলেন তাই। তিন সরকার (বিএনপি, তত্ত্বাবধায়ক ও আওয়ামী লীগ) আমলের গভর্নর তিনি।
দশম গভর্নর আতিউর রহমান (২০০৯-১৬) একজন অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষক। বিদায়ী গভর্নর ফজলে কবির (২০১৬-২০২২) একজন সাবেক আমলা। তিনি অর্থসচিব ছিলেন এবং গভর্নর পদে নিয়োগ পাওয়ার আগে ছিলেন সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান।
ভিনদেশি গভর্নরের উদাহরণ ইংল্যান্ডে
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগে ব্যতিক্রম ঘটনা আছে ইংল্যান্ডে। ২০০৮ থেকে ২০১৩ সময় পর্যন্ত মার্ক কার্নে ছিলেন ব্যাংক অব কানাডার (কানাডার কেন্দ্রীয় ব্যাংক) গভর্নর। তিনি একজন বিনিয়োগ ব্যাংকার এবং কানাডার নাগরিক। ২০০৭-২০০৮ সময়ে বিশ্বমন্দা দেখা দিলে ওই মন্দার হাত থেকে কানাডাকে সফলভাবে রক্ষা করেন মার্ক কার্নে—এ ব্যাপারে তাঁর বিশ্বখ্যাতি হয়। ব্রিটিশ সরকার ভিনদেশি মার্ক কার্নেকে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নর পদে নিয়োগ দেয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালনার জন্য ৮ থেকে ৯ সদস্যের একটি পরিচালনা পর্ষদ থাকে, পদাধিকারবলে গভর্নর এ পর্ষদের চেয়ারম্যান। সদস্য থাকেন একজন ডেপুটি গভর্নর। এ ছাড়া অর্থসচিব, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান পদাধিকারবলে সদস্য হন।
বাকিদের নেওয়া হয় বাইরে থেকে। যেমন, বর্তমানে আছেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আফতাব উল ইসলাম, সাবেক অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ ও সাবেক ডেপুটি গভর্নর নজরুল হুদা। গবেষক হিসেবে একজন থাকার কথা থাকলেও বর্তমান পর্ষদে গবেষক নেই।
১৯৯৬ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার একটি ব্যাংক সংস্কার কমিটি গঠন করেছিল। ১৯৯৯ সালে সেই কমিটির প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংক, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গভর্নর, ডেপুটি গভর্নর, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরিচালকদের তালিকা তৈরির জন্য একটি জাতীয় ব্যাংকিং উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের সুপারিশ ছিল।
গভর্নরের সর্বোচ্চ মেয়াদ পাঁচ বছর এবং তা আর না বাড়ানোর সুপারিশও করা হয়েছিল সেখানে। গভর্নরের পদমর্যাদা সুপ্রিম কোর্টের বিচারকের সমান হবে, সে কথাও বলা হয়েছিল। ওই সরকার এবং এর পরের কোনো সরকারই তা মানেনি।