কৃষিতে ভর্তুকি দেওয়া থেকে ধীরে ধীরে সরকারের সরে আসা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তিনি বলেন, খাদ্যনিরাপত্তার জন্য এ মুহূর্তে অবশ্যই কৃষি ভর্তুকি অব্যাহত রাখা দরকার; কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এ ভর্তুকির পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে।
শনিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারের সিএ ভবনে সামষ্টিক অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা নিয়ে আয়োজিত এক গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। যৌথভাবে এ গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করে দ্য ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি) ও ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ)।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘আমি নিজে কৃষকের সন্তান। আমাদের সবার আত্মীয়স্বজনের মাঝেও কৃষক আছেন। বর্তমানে গ্রামেগঞ্জে যাঁরা কৃষিজমির মালিক, তাঁদের মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে। তাঁদের বাড়িঘরের রূপ বদলে গেছে, খাওয়া-পরার বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন হয়ে গেছে, ছেলেমেয়ের শিক্ষার পরিবর্তন হয়েছে। সুতরাং তাঁদের যথেষ্ট উদ্বৃত্ত আছে। আর এ উদ্বৃত্ত রাষ্ট্রের ভর্তুকির কারণে হয়েছে। তাই এখানে মনে হয়, সামনে আর না এগিয়ে আস্তে আস্তে একটু ব্যাকওয়ার্ড চিন্তা করা উচিত। ধীরে ধীরে ভর্তুকি দেওয়া থেকে সরে আসা উচিত। তবে সেটা করতে গিয়ে শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি যেন তৈরি না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।’
একই সঙ্গে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় বিভিন্ন প্রকল্পে অপচয় কমানোর উদ্যোগ নেওয়ার কথাও জানান পরিকল্পনামন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক কালে আমাদের মাঝে নতুন ধনী হওয়ার মনোভাব চলে এসেছিল। সেইটার ওপরে একটা হ্রাস টানার চেষ্টা চলছে। কেনাকাটা, চলাফেরাসহ সব ব্যাপারে আমাদের অপচয় রোধ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীও বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছেন এ বিষয়ে। আমাদের কাছে যে ১ হাজার ৮০০ প্রকল্পের তালিকা আছে, সেগুলোর অগ্রাধিকার পুনর্মূল্যায়ন করছি। কোনটা আগে প্রয়োজন, আর কোনটা পরে প্রয়োজন, সেটা ঠিক করতে হবে।’
সারের ভর্তুকি কমানোর বিষয়ে কথা বলেছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরও। তিনি বলেন, ‘আমাদের একটু কষ্ট হলেও ভর্তুকি কমাতে হবে। যখন সারের দাম ৩৫ টাকা ছিল, তখন ভর্তুকি দেওয়া যেত; কিন্তু আমরা এখন ১১০ টাকায় সার কিনে ১৫ টাকায় বিক্রি করতে পারি কি না, তা ভাবতে হবে। আবার ধানের দামও এখন ৬০০ টাকা নয়, ১ হাজার ২০০ টাকার বেশি।’
তবে কৃষিতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিনায়ক সেন ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সাবেক সচিব মো. ইউনুসুর রহমান। গোলটেবিল আলোচনায় বিনায়ক সেন বলেন, ‘রপ্তানি ও কৃষি খাতকে যেভাবেই হোক, যতভাবেই হোক, আমাদের সহযোগিতা করতে হবে। অন্যান্য ভর্তুকি বিভিন্নভাবে সমন্বয় করা হলেও সারের ভর্তুকির বিষয়ে ছাড় নয়। এটা কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার নয়; কারণ, এটা আমাদের প্রাণ।’ পাশাপাশি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের জন্য রেশনিংয়ের ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ।
সাবেক সচিব ইউনুসুর রহমান বলেন, ‘খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে আমাদের কোনোভাবেই অবহেলা করা উচিত হবে না।’ কৃষিতে ভর্তুকি পুরোপুরি অব্যাহত রাখা দরকার, বরং বর্তমান ভর্তুকি আরও বাড়ানো যেতে পারে বলে মনে করেন সাবেক এই সচিব।
এদিকে অর্থনৈতিক সংকট থাকলেও দেশের বর্তমান অবস্থা নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই বলে আলোচনায় মন্তব্য করেছেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন। তিনি বলেন, কৃষি, রপ্তানি, উৎপাদন খাত ও প্রবাসী আয়—অর্থনীতির এ প্রধান চার সূচকের মধ্যে প্রথম তিনটি সূচকই ভালো অবস্থানে আছে। আর প্রবাসী আয়ও ভবিষ্যতে আবার বাড়বে। তাহলে এসব নিয়ে এত কথা কেন বলা হচ্ছে।
চরম দারিদ্র্যের তথ্য নিয়েও উষ্মা প্রকাশ করেন বিনায়ক সেন। তিনি বলেন, ‘চার কোটি চরম দারিদ্র্য নিয়ে যেসব জরিপের তথ্য বলা হচ্ছে, তা সঠিকভাবে করা হয়নি। প্রকৃত তথ্যের জন্য আমাদের পরবর্তী খানা আয় ও ব্যয় জরিপের তথ্যের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তবে আমি গত তিন বছরে উপার্জন কমেছে এমন কাউকে পাইনি।’
অন্যদিকে, দেশ বর্তমানে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে এই সংকটের পেছনে প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতাকে দায়ী বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। গোলটেবিল আলোচনায় তিনি বলেন, ‘দেশের অর্থনীতি যেভাবে চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, এ রকম পরিস্থিতি অতীতে কখনোই ছিল না। আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রধান অন্তরায় হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা। এটা দূর করতে হবে। এ খাতে বিনিয়োগ করে প্রতিষ্ঠানগুলোকে আগে উপযোগী করতে হবে।’
পদ্মা সেতু প্রসঙ্গে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পদ্মা সেতু শুধু পরিবহন করিডর নয়, এটাকে অর্থনৈতিক করিডর ভাবতে হবে। পদ্মা সেতু ঘিরে ১৭টি অর্থনৈতিক অঞ্চল করার কথা। কিন্তু এর জন্য সমান্তরাল অন্যান্য প্রকল্প হচ্ছে না। এসব প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে হবে। এ জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করবে, তাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
আলোচনায় জ্বালানি খরচ না বাড়ানোর পক্ষে মত দেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান। তিনি বলেন, দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্তিশালী আছে, এটা নিয়ে বিতর্ক নেই; কিন্তু সংকটও আছে। ব্যবসার পরিবেশ ঠিক রাখতে হলে কোনোভাবেই জ্বালানি খরচ বাড়ানো যাবে না। এ খাতে ভর্তুকি দিতেই হবে।
অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় স্বল্পমেয়াদি উদ্যোগ হিসেবে সরকারের ব্যয় কমিয়ে ডলার সরবরাহ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ। তিনি বলেন, ১করোনা মহামারি ও বর্তমান ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি, খাদ্যসংকট ও সরবরাহব্যবস্থায় অস্থিরতা চলছে। এ পরিস্থিতি মাথায় রেখে বাজেট পরিকল্পনা করতে হবে।’ পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ হিসেবে রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ, মুক্তবাণিজ্য চুক্তি ও সরকারের অর্থনৈতিক নীতি সংস্কারের পরামর্শ দেন তিনি।
গোলটেবিল আলোচনার শুরুতে স্বাগত বক্তব্য দেন আইসিএবির সভাপতি মো. শাহাদাৎ হোসেন ও ইআরএফের সভাপতি শারমীন রিনভী। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন আইসিএবির সাবেক সভাপতি মো. হুমায়ুন কবির।