আমাদের দেশে দোতলা সেতু এই প্রথম। নিউইয়র্কে দেখেছি দোতলা সেতু। কিন্তু সেখানে একতলা ও দোতলা, দুই সেতুতেই শুধু গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা। অন্যদিকে, আমাদের পদ্মা সেতুতে একতলায় চলবে রেলগাড়ি আর দোতলায় বাস-ট্রাক-ব্যক্তিগত গাড়ি। এই দ্বৈত ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে একটি উদ্ভাবনী উদ্যোগ।
আমাদের দেশে রেল ও বাস চলাচলের এমন চমৎকার ব্যবস্থার গুরুত্ব খুব বেশি। কারণ, ঈদ ও অন্যান্য উৎসব বা বড় ছুটির সময় রেল-বাস-গাড়ির চাহিদা এত বেড়ে যায় যে সামাল দেওয়া কঠিন। তাই পদ্মা সেতু যোগাযোগব্যবস্থা ও সেই সঙ্গে দেশের অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখবে। সেতুতে নিচে চলবে রেলগাড়ি আর ওপরের স্তরে রাস্তায় চলবে যানবাহন। এখানে স্বভাবতই জানার ইচ্ছা হয়, রেলপথ কেন সেতুর নিচের স্তরে আর গাড়ির রাস্তা কেন ওপরে? উল্টোটাও তো হতে পারত?
রেললাইন সেতুর নিচে হলে কিছু বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়। মূল সুবিধা হলো নির্মাণের ব্যয় কমানো সম্ভব হয়। পদ্মার মতো স্রোতস্বিনী নদীর পানির উচ্চতা বর্ষাকালে বেশ বাড়ে। তাই সেতুর নিচে নদীতে যেন নৌযানগুলো অনায়াসে চলাচল করতে পারে, সে বিষয়ে লক্ষ রাখতে হয়। পদ্মা নদীর ক্ষেত্রে এ জন্য প্রায় ৬০ ফুট ক্লিয়ারেন্স রাখতে হয়েছে।
আরও একটি বিষয় হিসাব করার প্রয়োজন হয়। ধরা যাক, প্রায় ১০০ বছরের জন্য সেতুটি নির্মাণ করা হলো। তাহলে এর নিচ দিয়ে কী পরিমাণ পানি প্রবাহিত হবে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। পদ্মা নদীর ক্ষেত্রে প্রতি সেকেন্ডে ১ লাখ ৪০ হাজার ঘনমিটার পানির প্রবাহ বজায় রাখা প্রয়োজন, যা গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের পানিকে বঙ্গোপসাগরে পৌঁছে দেবে। আমাজন নদীর পরে এটিই বিশ্বের সর্বোচ্চ প্রবাহ।
ওই হিসাব থেকেই সেতুর নিচের পিলারগুলোর অবস্থান ঠিক করতে হয়েছে, যেখানে এটি প্রায় ১৫০ মিটার দূরত্বে। এর চেয়ে কম হলে পিলার বেশি লাগছে, আবার বেশি হলে পাইলের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে।
এ ছাড়া সেতুর নিচ দিয়ে যেন জাহাজ চলাচল করতে পারে, সে জন্য পর্যাপ্ত ক্লিয়ারেন্স রাখতে হয়। এ কারণে সেতুর নিচের এ উচ্চতা নিশ্চিত করতে এর কাঠামোর তলদেশ উঁচু করতে হয় এবং এর জন্য যে অ্যাপ্রোচ স্লোপ করা হয়, সে উচ্চতার কথাও মাথায় রাখতে হয়।
‘আমরা সেতুর অ্যাপ্রোচে সাধারণ গাড়িতে প্রায় ৫ শতাংশ পর্যন্ত ঢালু সামলাতে পারি। অর্থাৎ কোনো গাড়ি ১০০ মিটার গেলে ৫ মিটার ওপরে উঠবে। অন্যদিকে, ট্রেনে এটি মাত্র দশমিক ৫০ শতাংশ ঢাল সামলানো যায়। তাই হিসাব করলে বোঝা যায়, ট্রেনকে এভাবে ব্রিজে তুলতে হলে আমাকে প্রায় ৩ হাজার মিটার দূর থেকেই রাস্তার ঢাল উঁচু করে ট্রেনকে সেতুতে ওঠার ব্যবস্থা করতে হবে, যা অনেক ব্যয়সাপেক্ষ। তবে আমরা যদি সেতুর নিচের অংশে ট্রেন চলাচল এবং ওপরের অংশে অন্য যানবাহন চলার ব্যবস্থা করি, তাহলে রেললাইনের উচ্চতা কম লাগবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও যেসব সেতুতে মোটর ও রেল চলাচল করে; তাতে মোটরযানকে ওপরে ও রেলপথ নিচে দিয়ে নেওয়া হয়। এতে ব্যয়ভার কমে আসে। একই পদ্ধতি ভারত ও জাপানে সেতুর নিচের অংশেই করা হয়েছে এসব বিষয় চিন্তা করে।’
ওপরে ওঠার সময় রেললাইনের ঢালের বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। অনেক আগে একবার আমি মাইক্রোবাসে শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি পাশেই পাহাড়ি রেললাইন ধরে একটি টয়ট্রেন ওপরে উঠতে পারছে না; এ অবস্থায় ব্রেক করে ধীরে ধীরে নিচের দিকে নামছে। খুবই ভয়ের ব্যাপার। কিন্তু আমাদের মাইক্রোবাসের যাত্রীরা হাসছেন। বলছেন, এ রকম প্রায়ই হয়। কারণ, ঢাল এত উঁচু যে ওপরে ওঠা কঠিন। এখন কিছু নিচে নেমে আবার বেশি গতিতে ওপরে উঠবে। অর্থাৎ পাহাড়ি রাস্তায় ট্রেনে ওপরে ওঠা বেশ কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ। এখন অবশ্য ট্রেনে দার্জিলিং যাওয়া-আসা স্থগিত রেখে শুধু দার্জিলিং-ঘুম লাইনে টয়ট্রেন চলাচল করে। অবশ্য সম্প্রতি হয়তো জলপাইগুড়ি-দার্জিলিং টয়ট্রেন আবার চলছে।
পদ্মা সেতু কতটা ভূমিকম্পসহনীয়
পদ্মা সেতুকে ভূমিকম্পসহনীয় করতে অনেক কাজ করা হয়েছে। ভূমিকম্প প্রতিরোধ করতে একটি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ভূমিকম্পের সময় মাটির যে কম্পন, তার সবটা যেন সেতুর উপরিকাঠামোয় যেতে না পারে, তার জন্য ব্যবহার করা হয় ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং। এটি ব্যবহার করলে ভূমিকম্পের সময় সেতুর পাইলিং নড়াচড়া করলেও মূল সেতুর কাঠামোয় এটি কোনো প্রভাব ফেলবে না। এ প্রযুক্তি বানানো হয়ে গেলেও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য অপেক্ষায় ছিল। সম্প্রতি পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। ডিজাইন অনুসারে, এটি প্রায় ১০ হাজার টন লোড সামলাতে সক্ষম। কিন্তু বিশ্বে এ ধরনের পরীক্ষায় আমরা মাত্র ৮ হাজার টন লোডের জন্য পরীক্ষা করতে পারি। বাকি অংশ স্কেল মডেলে পরীক্ষা করার কথা। এ প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে আমাদের খরচ প্রায় ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার কমে গেছে। না হলে আমাদের প্রতি পিলারে ৬টির বদলে ৮টি করে পাইলিংয়ের দরকার পড়ত।
পদ্মা সেতুটি যদি আমরা ওপর থেকে দেখি, তাহলে বোঝা যায়, সেতুটি ডাবলি কার্ভড। অর্থাৎ ডানে-বাঁয়ে দুবার সামান্য বাঁকানো। এটি মূলত করা হয় চালকদের কথা চিন্তা করে।
একদম সোজা সেতু হলে চালকেরা সেতুতে উঠে আর ড্রাইভিংয়ে নজর রাখেন না। ঝিমুনি আসে। এতে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বাড়ে। কিন্তু একটু বাঁকানো হলে চালকদের এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হয়। যুক্তরাষ্ট্র, চীন কিংবা জাপানে বিভিন্ন দীর্ঘ মহাসড়ক এভাবে বাঁকিয়ে বানানো।
এ কারণে স্টিল ট্রাসগুলো প্রতিটি ভিন্নভাবে বাঁকা করে বানানো হয়েছে। তাই এটি কম্পিউটার দিয়ে নিখুঁত হিসাব করে জোড়া লাগাতে হয়। আবার আমরা যখন এর ওপর কংক্রিটের স্তর বসাব, তখন তো সেতুটি আরও একটু বাঁকা হবে। এ জন্য আগে থেকে হিসাব করে ট্রাস বাঁকাভাবে বানানো হয়, যেন কংক্রিটের স্তর বসানোর পর অংশটি বসানো যায়।