১৫ বছর আগে স্টিভ জবস তিনটি নতুন পণ্যের ঘোষণা দিয়েছিলেন। একটি ছিল মিউজিক প্লেয়ার, একটি মোবাইল ফোন ও আরেকটি ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগের যন্ত্র। মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান অ্যাপলের তখনকার প্রধান স্টিভ জবস যখন নতুন পণ্যের বিষয়টি দর্শকদের সামনে হাজির করলেন, লোকজন তখন চমকে গেল। দর্শকেরা ধীরে ধীরে যখন বুঝতে পারলেন স্টিভ জবসের ঘোষণা দেওয়া তিনটি পণ্য আসলে মাত্র একটি পণ্য; আর সে পণ্যটি হলো আইফোন। দর্শকের করতালি আর স্টিভ জবসের হাত ধরে ঘুরে গেল স্মার্টফোনের জগৎ। নতুন প্রযুক্তির যুগ শুরু হলো।
কম্পিউটার–সংক্রান্ত কাজের ক্ষেত্রে ডেস্কটপ কম্পিউটারের জায়গা নিল স্মার্টফোন।
স্টিভ জবস আর নেই। মোবাইল প্রযুক্তির বিবর্তনকারী আইফোনের উদ্ভাবক স্টিভ জবস দীর্ঘদিন ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে ২০১১ সালে মাত্র ৫৬ বছর বয়সে মারা যান। তিনি বেঁচে থাকলে তাঁর উদ্ভাবিত নানা কাজের এই স্মার্টফোনের ব্যবহার দেখে নিশ্চয়ই আশ্চর্য হতেন। ছোট্ট পর্দার এই যন্ত্রের মাধ্যমেই এখনকার ব্যাংকিং সেবা, নেটওয়ার্কিং বা যোগাযোগ, ম্যাপ বা মানচিত্রের ব্যবহার, গেম খেলার মতো নানা ধরনের কাজ করা হচ্ছে। অ্যাপলসহ বিশ্বের স্মার্টফোন নির্মাতাদের হাতেই এখনকার প্রযুক্তিজগতের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। তারা হার্ডওয়্যার বিক্রির পাশাপাশি স্মার্টফোনের উপযোগী নানা সফটওয়্যার তৈরি করছেন। গত বছর স্মার্টফোনের হার্ডওয়্যার বিক্রি হয়েছে ৫৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। এর বাইরে স্মার্টফোন বিক্রেতাদের হাতে রয়েছে এই প্ল্যাটফর্ম নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিও। তাদের তৈরি অ্যাপ স্টোর থেকে গত বছর ১৩৫ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে। এ ছাড়া স্মার্টফোন প্ল্যাটফর্মের যে বিজ্ঞাপন, তার বাজারও ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
তবে স্মার্টফোনের এত ব্যবসা দেখলেও এর যুগ যে ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসছে, তার প্রমাণও কিন্তু দেখা দিতে শুরু করেছে। ২০১৬ সাল থেকে ধীরে ধীরে ফোন বিক্রি কমছে। কারণ, স্মার্টফোন প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বড় ধরনের কোনো হালনাগাদ আসেনি।
মানুষ তাই স্মার্টফোন হালনাগাদ করা কমিয়ে দিয়েছে। ধনী দেশগুলোতে এখন প্রায় সব মানুষের হাতেই পৌঁছে গেছে স্মার্টফোন। অর্থাৎ নতুন স্মার্টফোন বিক্রির জায়গা কমে গেছে। ফলে প্রযুক্তি খাতের উদ্ভাবকদের এখন অন্য চিন্তাভাবনা করতে হচ্ছে।
তাঁরা পরবর্তী প্রজন্মের কোনো বড় আবিষ্কারের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাঁরা শুধু আকর্ষণীয় হার্ডওয়্যার বাজার দখলের বদলে এমন একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরির কথা ভাবছেন, যেখান থেকে মানুষের প্রয়োজনীয় সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ এক প্ল্যাটফর্মেই সারা যায়। এর আগে স্মার্টফোনের মাধ্যমে যেটা সম্ভব হয়েছিল, সে রকমই নতুন কোনো প্ল্যাটফর্মের আশায় রয়েছেন উদ্ভাবকেরা।
এই মুহূর্তে পরবর্তী সম্ভাবনাময় প্রযুক্তি ধারণা হচ্ছে ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি (ভিআর) হেডসেট। করোনা মহামারির সময় এই প্রযুক্তি ধারণার বিষয়টি বড় আকারে সামনে এসেছে। তবে আরও আশাব্যঞ্জক হয়ে উঠেছে অগমেন্টেড রিয়েলিটি (এআর) অভিজ্ঞতা পাওয়ার জন্য বিশেষ চশমা। এ চশমার মাধ্যমে বাস্তব জগতের সঙ্গে কম্পিউটার গ্রাফিক যুক্ত হলে নতুন অভিজ্ঞতা পাওয়া যায়। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্যবহারকারী কম্পিউটার সফটওয়্যারের মাধ্যমে বাস্তব জগতের বস্তু ও মানুষের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে পারে। চশমার মাধ্যমে কথোপকথন চালানো ছাড়াও প্রয়োজনীয় নানা কাজ সারা যাবে। কিন্তু এ ধরনের চশমা বাজারে আসতে আরও কিছুদিন দেরি হতে পারে।
অ্যাপল, গুগল, মেটা ও মাইক্রোসফটের মতো যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ভিআর বা এআর হেডসেট তৈরি বা বিক্রিতে কাজ করছে। এর বাইরে এশিয়ার প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান হিসেবে টিকটকের মূল প্রতিষ্ঠান বাইটড্যান্স ও সনি এ ধরনের প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে। বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, এখন পর্যন্ত ভিআর বা এআর হেডসেটের বাজারটি সুনির্দিষ্ট পণ্যের বাজার হিসেবেই পরিচিত। তবে শিগগিরই এ বাজার মূলধারার বাজার হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।
পরবর্তী বড় প্ল্যাটফর্ম আবিষ্কার করার যেকোনো দাবি সতর্কতার চোখে দেখতে হবে। কারণ, এর আগে অনেক উদ্ভাবনই সম্ভাবনাময় বলে দাবি করার পরও তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এ ধরনের পণ্য বাজারে টিকতে পারেনি এবং মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। স্মার্টফোনের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাবি করা হয়েছিল ট্যাবলেট কম্পিউটারকে।
কিন্তু এখন পর্যন্ত অ্যাপল তাদের তৈরি আইপ্যাডের তুলনায় ছয় গুণের বেশি অর্থ আয় করে থাকে আইফোন বিক্রি থেকে। স্মার্টহোম বা স্মার্টবাড়িকেও সম্ভাবনাময় বড় প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দেখা হচ্ছিল। কিন্তু স্মার্টহোমের জন্য তৈরি অ্যালেক্সা বা করটানার মতো সফটওয়্যারগুলো এখনো কৌতুক বা সময় কাটানোর প্রোগ্রাম হিসেবেই রয়ে গেছে। অন্যদিকে গাড়ির প্রযুক্তি হলো আরেকটি প্ল্যাটফর্ম, যা দরকারি এবং মূল্যবান হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু এখনো ডিজিটাল জীবনের কেন্দ্রে পরিণত হওয়ার মতো তেমন প্রভাব তৈরি করতে পারেনি। হেডসেটের ক্ষেত্রেও বিষয়টি কল্পনা করা সহজ। এখন পর্যন্ত গেমের ক্ষেত্রে হেডসেটের ব্যবহার বেশি দেখা যাচ্ছে, তাই এটি এ ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতার বেড়াজালে আটকে গেছে।
তবে সামনে যা আসছে তা মূলত নতুন পরিধানযোগ্য যন্ত্রগুলোর প্রতি মানুষের ক্রমেই অভ্যস্ত হওয়ার বিষয়টি। এর মধ্যে রয়েছে কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে চালু করার সুবিধাযুক্ত হেডফোন। এর মাধ্যমে কল করা, বার্তা পাঠানো বা পড়া যাবে। এর বাইরে রয়েছে স্মার্টওয়াচ। এর সাহায্য কাজের সময়সীমা ঠিক করা, পথ চলার দিক নির্দেশ পাওয়া ও শরীর ঠিক রাখার বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায়। স্বাস্থ্যপ্রযুক্তি খাতেও বেশি কিছু নতুন পণ্য এসেছে, যার মাধ্যমে রক্তে চিনি মাপা, ঘুমের ধরন পরীক্ষা, রক্তচাপ মাপাসহ নানা কাজ করা যায়। যুক্তরাষ্ট্রে ইতিমধ্যে এ ধরনের পরিধানযোগ্য প্রযুক্তিপণ্যের বিক্রি স্মার্টফোনের কাছাকাছি চলে এসেছে।
তবে এ ধরনের ছোট যন্ত্রগুলো আসলে স্মার্টফোনের জায়গা নেওয়ার পরিবর্তে এর আনুষঙ্গিক হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে যেহেতু এখনকার কম্পিউটিং প্রযুক্তি পকেট থেকে বের হয়ে কবজি বা কানের দিকে এগোচ্ছে, তাতে গ্রাহকের মনোযোগও সরে যাচ্ছে। তারা এখন ফোনের পেছনে অর্থ খরচ করা কমিয়ে দিচ্ছে। এ সময় ভিআর ও এআর চশমাগুলো আরও হালকা হতে সাশ্রয়ী হতে শুরু করেছে। পরিধানযোগ্য প্রযুক্তিপণ্যের ক্ষেত্রে তাই এর বাজার আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে খুব বেশি সময় লাগবে না।
তবে কি ফোন একেবারেই শেষ? এর উত্তর হচ্ছে, না। এখনই মোবাইল ফোন বা স্মার্টফোন থেকে সরে যাবে না মানুষ। এক দশক আগে মানুষ যেভাবে ল্যাপটপ থেকে সরে এসে মোবাইল ফোনকে আঁকড়ে ধরেছিল, এখন তা হবে না। কিন্তু এখন যেহেতু মানুষ এয়ারফোনে প্রায়ই কথা বলেন বা শিগগিরই হয়তো চশমার সাহায্যে যোগাযোগ করবেন, তখন স্মার্টফোনটি তাঁদের ব্যাক অফিস বা বাড়ির যন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
তখন স্মার্টফোনটি হবে সব যন্ত্রের সমন্বয় মাধ্যম বা প্রসেসিং শক্তির আধার। তবে যেহেতু প্রসেসর বা চিপসেট দিন দিন আরও ছোট হয়ে যাচ্ছে, একসময় স্মার্টফোনও আর দরকার হবে না।
তবে এসব সম্ভাবনার কথা। এখনই সবকিছু পরিবর্তন হয়ে যাবে, এমনটা আশা করা বোকামি হবে। ইন্টারনেট সুবিধাযুক্ত ফোন নব্বইয়ের দশকে উদ্বোধন করা হলেও তা অফিসের বাইরে ব্যবহার করার মতো উপযোগী হতে ব্যর্থ হয়েছিল। এখনকার এআর হেডসেটের মতো ভারী, দামি ও কেবল বিশেষ কাজের উপযোগী হেডসেটও এখন সে অবস্থায় রয়েছে। তবে যখন প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের চাহিদার সময়টিকে ধরা যাবে, তখন পরিবর্তন দ্রুত হবে। স্টিভ জবস যখন আইফোনের সঙ্গে বিশ্বকে পরিচয় করিয়ে দেন, তার চার বছর পর গিয়ে ল্যাপটপ ও ডেস্কটপ বিক্রিকে ছাড়িয়ে যায় স্মার্টফোন।
যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালির সর্বশেষ প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের যে আশা, তা এখনো উন্নয়নের পথে রয়েছে। কিন্তু যখন সঠিক পণ্যটি সঠিক সময়ে মানুষের কাছে চলে আসবে, তখন ভবিষ্যৎ পরিবর্তনটিও অতিদ্রুতই ঘটে যাবে।