দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় রাজনীতিতে দৃশ্যমান তৎপরতায় নেই জামায়াতে ইসলামী। দলীয় সূত্রগুলো বলছে, ‘বৈরী পরিস্থিতি’র কারণে তারা প্রকাশ্যে নেই। এই মুহূর্তে প্রকাশ্য তৎপরতার চেয়ে অভ্যন্তরীণ সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি করার দিকেই তাদের মনোযোগ। বর্তমানে দলের গ্রামভিত্তিক কমিটি গঠনের কাজ চলছে।
জামায়াতের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাঠের রাজনীতিতে নীরব থাকলেও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নজর রয়েছে তাঁদের। তাঁরা বলছেন, দেশে একটি নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্যের চেষ্টা করছে। এ লক্ষ্যে রাজপথে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে নতুন কোনো ‘কৌশল’ ও ‘কর্মসূচিতে’ বৃহত্তর ঐক্য হলে তাতে মাঠে সক্রিয় ভূমিকায় থাকবে জামায়াত।
বর্তমানে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্কে কিছুটা টানাপোড়েন চলছে। দল দুটির যোগাযোগও আগের মতো ঘনিষ্ঠ নয়। যদিও ২০-দলীয় জোটের শরিক হিসেবে জামায়াত এখনো বিএনপির সঙ্গেই আছে। তবে সামনে নির্বাচনকেন্দ্রিক আন্দোলন ও নির্বাচনে দল দুটির সম্পর্ক কেমন হবে, তা নিয়ে দুই দলের মধ্যেই নানা আলোচনা রয়েছে।
জামায়াতের নেতারা বলছেন, জামায়াত ও বিএনপির লক্ষ্য একই—এই সরকারের পতন। এ লক্ষ্যে রাজপথে বড় আন্দোলন গড়তে বিরোধী জোট যদি আরও বিস্তৃত হয়, কিংবা ২০–দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে নিষ্ক্রিয় রেখে সবাই যার যার মতো করে যুগপৎ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেয়, তাতে সমর্থন থাকবে জামায়াতের। অর্থাৎ নিরপেক্ষ সরকারের অধীন নির্বাচনের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বিরোধী দলগুলোর যেকোনো ‘কৌশল’ ও ‘কর্মসূচি’ গ্রহণে তারা নীতিগতভাবে একমত।
এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, একটি আন্দোলন হবে—এটি নিশ্চিত। তবে কোন প্রক্রিয়ায়, কীভাবে হবে, তা কৌশলগত বিষয়। ২০-দলীয় জোটও আরও বড় হতে পারে, সবাই যুগপৎ আন্দোলন করবে, সেটাও হতে পারে। জামায়াত দল হিসেবে যেকোনো কর্মসূচি ও কৌশল গ্রহণ করতে প্রস্তুত।
আগামী নির্বাচন প্রশ্নে জামায়াতের মূল্যায়ন হচ্ছে, ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো আরেকটা জাতীয় নির্বাচন ‘বহন করার’ ক্ষমতা বাংলাদেশ রাখে না। দলের নেতারা মনে করছেন, দেশি ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আগামী সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে বাধ্য। কারণ, এই নির্বাচনের ওপর নিরূপিত হবে দেশের ভবিষ্যৎ। এ ছাড়া ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এবং বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াতের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী, সেটিও নির্ধারিত হবে আগামী নির্বাচনের মধ্য দিয়ে।
জামায়াতের নেতাদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতা হারায়, তাহলে দলটিকে ‘দুঃশাসনের জন্য’ কঠিন জবাবদিহির মধ্যে পড়তে হবে। অন্যদিকে বিএনপির জন্য আগামী নির্বাচন অনেকটা শেষ লড়াইয়ের মতো। কারণ, এ নির্বাচনের পর বয়সের কারণে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের একটি প্রজন্ম রাজনীতি থেকে বিদায় নেবে। একই পরিস্থিতি জামায়াতেরও। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব হারানো জামায়াতের জন্য আগামী নির্বাচন অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইও। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়েই দলটির নীতিনির্ধারকেরা সারা দেশে সংগঠন গোছানোর দিকে বেশি মনোযোগী হয়েছেন। এর মধ্যেও গণমাধ্যমে নিয়মিত বিবৃতি এবং মাঝেমধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে রাজধানীতে ঝটিকা মিছিলেও বের হয় জামায়াত।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের একজন সদস্য বলেন, ‘আমাদের ৮০ থেকে ৯০ ভাগই ইন্টারনাল ওয়ার্ক। অর্থাৎ সাংগঠনিক কাজ বা সংগঠন বিস্তৃত করার কাজ। এ কারণে দেশে যখন রাজনীতি থাকে না, তখনো আমাদের সাংগঠনিক কাজ করতে সমস্যা হয় না। এখন আমরা গ্রামভিত্তিক কমিটি করছি।’
ভবিষ্যতে বিরোধী দলগুলোর যেকোনো ‘কৌশল ও কর্মসূচিতে’ ভূমিকা রাখার চিন্তা করলেও দলটিকে নিয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের পরিকল্পনা এখনো স্পষ্ট নয়। জামায়াতকে শামিল করে জোটবদ্ধভাবে আন্দোলন ও নির্বাচন করা নিয়ে বিএনপিতে মতবিরোধ রয়েছে। গণমাধ্যমে এমন খবরও বেরিয়েছে যে জোটবদ্ধ আন্দোলনের ব্যাপারে জামায়াতকে না করে দেওয়া হয়েছে।
তবে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জামায়াতকে না করার খবর নাকচ করে দিয়ে বলেন, এসব গণমাধ্যমের মনগড়া খবর। তিনি বলেন, পরিস্থিতি যুগপৎ আন্দোলনের দিকেই যাচ্ছে। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথাবার্তা চলছে, এখনো চূড়ান্ত কিছু হয়নি।
অবশ্য বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের একটি অংশ এখনই জামায়াত থেকে আলাদা হতে চায়। এ নিয়ে অনেকে গণমাধ্যমে প্রকাশ্যে কথাও বলছেন। তাঁরা মনে করেন, জামায়াতের নেতিবাচক ভাবমূর্তির কারণে বহির্বিশ্বে বিএনপিও বিতর্কে পড়েছে। এ অবস্থা থেকে বের হওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। যদিও দলের আরেকটি অংশ ভোটের হিসাব-নিকাশের কারণে এখনই জামায়াতকে হাতছাড়া করতে রাজি নয়।
সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘সবাই নিজ নিজ প্রয়োজনেই জোটে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কিন্তু জোটের শরিক জামায়াতকে নিয়ে বিএনপির নেতারা যা বলেন, সেটা অনেক ক্ষেত্রে অপমানজনক। হয়তো এটা তাঁদের দলীয় সংস্কৃতিতে এতটা বেমানান নয়। কিন্তু জোট ভাঙা, বেরিয়ে যাওয়া, আমাদের দিক থেকে আমরা কোনো ভূমিকা নেব না, এটা পরিষ্কার।’
বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকারবিরোধী বৃহত্তর ঐক্যে তাঁরা কোনো দলকে বাদ দিয়ে নয়, সমমনা সব দলের সঙ্গে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে যুগপৎ আন্দোলনকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। কারণ, সবারই মূল লক্ষ্য একটা, সেটা হলো এই সরকারের পতন।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ঐক্যের কাজ এগোচ্ছে, সবার সঙ্গে কথা হচ্ছে। সরকারের পতন এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীন নির্বাচনের ব্যাপারে সবাই একমত আছে। সবাই যুগপৎভাবে যার যার অবস্থান থেকে আন্দোলন শুরু করবে, এরপর চলার পথে যখন যা প্রয়োজন হবে, সেটাই করা হবে।