জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কারাগারে আটক বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১ শিক্ষার্থীকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করেছে। এই ১১ শিক্ষার্থী কারাগারে আছেন কেন? তাঁদের বিরুদ্ধে ‘সরকারবিরোধী অপতৎপরতা ও আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো’র অভিযোগ এনেছে পুলিশ। কোনো আদালত তাঁদের ইতিমধ্যে আইনি প্রক্রিয়ায় দোষী সাব্যস্ত করেননি, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে একধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে। কর্তৃপক্ষ বলেছে, একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ঘটনা বিভিন্ন কারণেই আমাদের মনোযোগ দাবি করে।
পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব শিক্ষার্থী ‘নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে’ এক মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন, যে মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছেন ছাত্রশিবিরের এক নেতা। সেই সূত্রে তাঁদের শিবির নেতা মিকদাত হোসেনের সঙ্গে একটি বাড়ি থেকে আটক করা হয়েছে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে সরকারিভাবে ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়নি। কিন্তু কার্যত ২০১১ সাল থেকেই ‘শিবির’ করার অভিযোগে আটকের ঘটনা নিয়মিতভাবেই ঘটে। সাংগঠনিকভাবে ২০১৩ সালে এবং অন্যান্য সময় বিভিন্ন ধরনের সহিংস ঘটনায় শিবিরকর্মীদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ও প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু এ কারণে সংগঠনের সব সদস্যকে সব সময় এ অভিযোগে অভিযুক্ত করা যাবে না। এটি যে কেবল এ সংগঠনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, তা নয়। সাংগঠনিক অবস্থানের জন্য যদি সব কর্মীকে অভিযুক্ত করা হয়, তাহলে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের কর্মীদের জন্য এক ভয়াবহ বিপদের সূচনা হবে। কিন্তু তার চেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে, দেশের প্রচলিত আইন তা বলে না। প্রত্যেক নাগরিকের আইনের আশ্রয় পাওয়ার অধিকার রয়েছে। ব্যক্তির অপরাধের দায় এবং তার শাস্তি তাঁকেই ভোগ করতে হবে।
কিন্তু প্রায় এক দশক ধরেই আমরা দেখতে পাই যে সন্দেহ হওয়াই নির্যাতিত এবং আটক হওয়ার জন্য যথেষ্ট বলে বিবেচিত হচ্ছে। এ কথা ভোলার অবকাশ নেই যে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকেও ‘সন্দেহের’ অজুহাতে ছাত্রাবাসের ভেতর পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর আবরারের মৃতদেহ আবিষ্কারের পর জানা যায়, কীভাবে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। এটা নিয়ে সারা দেশে ব্যাপক বিক্ষোভের ঘটনা ঘটে, কিন্তু অবস্থার কোনো ধরনের পরিবর্তন হয়নি। সে বছরের ১২ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লেখালেখির কারণে ছাত্রশিবিরের নেতা বলে ছাত্রলীগের কাছে ‘সন্দেহভাজন’ মনে হয়। ফলে তাঁকে মারধরের শিকার হতে হয় (আমাদের সময়, ১২ ডিসেম্বর ২০১৯)। পরের মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষার্থীকে একই ধরনের অভিযোগে ছাত্রলীগের কর্মীরা মারধর করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এসব শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। ১২ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করার পর তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল (বিবিসি ২২ জানুয়ারি ২০২০)। এ ধরনের ঘটনার তালিকা দীর্ঘ। শুধু এসব ঘটনায়ই নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে ছাত্রলীগ কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেই শিক্ষার্থীকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বক্তব্য আরও বেশি উদ্বেগজনক। প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে প্রক্টরের বক্তব্য। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মোস্তফা কামাল বলেন, অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে নানা অপতৎপরতার অভিযোগ পাওয়া গেছে, যা সরকারবিরোধী। এমন অপতৎপরতায় যদি তাঁরা যুক্ত থাকেন, তবে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে। ( রংপুর ডেইলীকে ৪ এপ্রিল ২০২২)। সরকারবিরোধিতা কি তাহলে বাংলাদেশে অপরাধ বলে বিবেচিত হচ্ছে? বাংলাদেশের আইনে কোথাও সরকারবিরোধী তৎপরতাকে অপরাধ হিসেবে বর্ণনা করা হয়নি। যে দেশ নিজেকে গণতান্ত্রিক বলে দাবি করবে, সে দেশে সরকারবিরোধিতাকে অপরাধ বলে বিবেচনার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের সংবিধান প্রত্যেক নাগরিককে সেই অধিকার দিয়েছে।
সব ধরনের পেশাজীবী প্রতিষ্ঠান তাদের নির্বাচন করে, কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন তাঁদের সংসদের নির্বাচন করতে পারবেন না, সেটা কেউ বলতে পারেন না। বিরাজনীতিকরণের এক ভয়াবহ প্রক্রিয়ার মধ্যে তরুণদের ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এ প্রক্রিয়ার আশু সুবিধা ভোগ করছেন ক্ষমতাসীনেরা, কিন্তু এ অবস্থা দীর্ঘ মেয়াদে দেশের জন্য তো নয়ই, এমনকি তাঁদের জন্যও ইতিবাচক নয়বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে আমাদের স্মরণ করতেই হবে, শিক্ষার্থীদের সরকারবিরোধিতাই গণতন্ত্রের আন্দোলনকে বেগবান করেছে। নাগরিকের এ অধিকারচর্চা কোনো প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়। শিক্ষার্থীদের রাজনীতি কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করবে, সেটা বোধগম্য নয়। একদিকে শিক্ষামন্ত্রী বলছেন শিক্ষার্থীদের রাজনীতিসচেতন হতে হবে। রাজনীতিসচেতন না হয়ে সফল মানুষ হওয়া যায় না, সুনাগরিক হওয়া যায় না; অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, সরকারবিরোধী রাজনীতি অপরাধতুল্য, এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। এ কথার অর্থ দাঁড়ায়, একমাত্র সরকারের সমর্থক রাজনীতিই গ্রহণযোগ্য।
ইতিমধ্যে সরকার এবং সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠনের আচরণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্ররাজনীতি বিষয়ে ভীতি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে নিয়মিতভাবেই সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের হাতে লাঞ্ছিত হচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে কথিত গণরুমের নামে যে অবস্থা বছরের পর বছর অব্যাহত আছে, তা সবার জানা। কিন্তু এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের মাথাব্যথা নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্বশীল সংসদ অনুপস্থিত। ২৮ বছর পর ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আশা করা হয়েছিল, এরপর অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সংসদ নির্বাচন হবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষ সে পথে পা বাড়ায়নি। এ নিয়ে কোনো ব্যাখ্যাও পাওয়া যায় না।
দেশে সব ধরনের নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারের উৎসাহের ঘাটতি নেই, সেসব নির্বাচন সুষ্ঠু হোক অথবা না হোক। সব ধরনের পেশাজীবী প্রতিষ্ঠান তাদের নির্বাচন করে, কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন তাঁদের সংসদের নির্বাচন করতে পারবেন না, সেটা কেউ বলতে পারেন না। বিরাজনীতিকরণের এক ভয়াবহ প্রক্রিয়ার মধ্যে তরুণদের ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এ প্রক্রিয়ার আশু সুবিধা ভোগ করছেন ক্ষমতাসীনেরা, কিন্তু এ অবস্থা দীর্ঘ মেয়াদে দেশের জন্য তো নয়ই, এমনকি তাঁদের জন্যও ইতিবাচক নয়।আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট