এক স্কুলে দুই প্রধান শিক্ষক

পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলা সদরস্থ সুবিদখালী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় এক যুগ ধরে দুই জন প্রধান শিক্ষক দায়িত্ব পালন করছেন। এ নিয়ে বিদ্যালয়টিতে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বিদ্যালয়ে ম্যনেজিং কমিটি থাকলেও এর কোনো সুরাহা হচ্ছে না। এর মধ্যে একজন প্রধান শিক্ষকের বেতন বন্ধ রয়েছে প্রায় ১২ বছর ধরে। সকল মামলার রায় থাকলেও বেতন পাচ্ছেন না প্রধান শিক্ষক কাজী মোঃ মনিরুজ্জামান। এমনকি প্রাথমিকের শিক্ষক/শিক্ষিকার তথ্যেও সুবিদখালী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কাজী মোঃ মনিরুজ্জামানের নাম রয়েছে।

১৯৯৬ সালের ১৫ জুলাই পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার উত্তর মাধবখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন কাজী মোঃ মনিরুজ্জামান। এরপর আলাদা নিয়োগে ২০০০ সালের ১ নভেম্বর প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

২০১০ সালের ১২ এপ্রিলে পটুয়াখালী জেলা শিক্ষা অফিসারের (স্মারক নং-৬৯৭/০৪) বদলির আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ওই মাসের ১৫ তারিখে যোগদান করেন বদলিকৃত প্রতিষ্ঠান সুবিদখালী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯ এপ্রিল রামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শূণ্য পদে নতুন প্রধান শিক্ষক মোঃ জাকির হোসেনকে বদলি আদেশ দেন উপজেলা শিক্ষা অফিস। পরবর্তীতে উক্ত বিদ্যালয় থেকে বদলিকৃত প্রধান শিক্ষক মোঃ মনিরুজ্জামান (মামুন) দক্ষিণ চালিতাবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান না করে এবং কর্তৃপক্ষের নিদের্শ অমান্য করে একজন সরকারি কর্মচারী হিসেবে বিনা অনুমতিতে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে তার বদলির আদেশের বিরুদ্ধে রিট পিটিশন মামলা দাখিল করেন। পিটিশন নং-৩০৩২/২০১০।

উক্ত রিট মামলার হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ বিচারপতি এ এইচ শামসুদ্দিন চৌধুরী এবং বিচারপতি শেখ মোঃ জাকির হোসেন র্দীর্ঘ শুনানির পর ২০১০ সালে ৫ আগস্ট মামলাটি খারিজ করে দেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে সুবিদখালী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে বহাল থাকেন কাজী মোঃ মনিরুজ্জামান। উক্ত খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে বদলিকৃত প্রধান শিক্ষক মোঃ মনিরুজ্জমান (মামুন) পুনরায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আপিল বিভাগে (সিএ ১২২/২০১৪) মামলা দাখিল করেন।

২০১৭ সালের ৫ এপ্রিল প্রধান বিচারপতির নেতেৃত্বে গঠিত বেঞ্চে উক্ত মামলাটি খারিজ করে দেন। এরপর বরিশাল প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে ১৭/২০১৭ সালে এটি আবারো দাখিল করেন। এরপরও প্রধান শিক্ষক মোঃ মনিরুজ্জামান উপজেলা শিক্ষা অফিসকে ম্যানেজ করে ওই বিদ্যালয় থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত বেতন ভাতাদি উত্তোলন করেন। বরিশাল প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে ২০১৮ সালের ২৫ জুন মামলাটি খারিজ হওয়ায় তিনি ২০১০ সালে ১৫ এপ্রিল থেকে বেতন ভাতাদি পাওয়ার বিষয়ে তৎকালীন উপজেলা শিক্ষা অফিসার উত্তম কুমার কুন্ডু বরাবরে ২০১৮ সালের ২২ জুলাই আবেদন পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রেরণ করেন। কাজী মোঃ মনিরুজ্জামান সুবিদখালী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা শিক্ষা অফিসার প্রত্যায়নপত্র প্রদান করেন।

সূত্রে জানা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জেলা রিটানিং অফিসার মোঃ মতিউল ইসলাম চৌধুরী স্বাক্ষরিত সুবিদখালী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে নিয়োগপত্রের সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার হিসেবে দ্বায়িত্ব পান কাজী মোঃ মনিরুজ্জামান। এছাড়াও ২০১৮ সালের ১৪ আগস্ট সুবিদখালী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন করেন পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক ড. মো. মাছুমুর রহমান। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পরিদর্শন প্রতিবেদনে অনুরোধ করেছেন জেলা প্রশাসক।

এর আগে তৎকালীন প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান এমপি বরাবরে আবেদন করা হলে ২০১৭ সালের ৩ নভেম্বর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করলেও কোনো সমাধান হয়নি।

এ বিষয়ে ভুক্তভোগী প্রধান শিক্ষক কাজী মোঃ মনিরুজ্জামান বলেন, আমি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ যথাযথভাবে পালন করে হাইকোর্ট ও সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃক রিট পিটিশন ৩০৩২/২০১০ তারিখ মামলা খারিজ হওয়ার পরেও যোগদানের পর থেকে আজ পর্যন্ত কোনো বেতন ভাতাদি পাইনি। ফলে দীর্ঘদিন যাবৎ মানবেতর জীবনযাপন করছি। আমার পরিবারে বৃদ্ধ মা-বাবা এবং এক মেয়ে ও দুই ছেলে পড়াশুনা করছে। প্রায় ১২বছর ধরে কোনো বেতন ভাতা পাচ্ছি না। এতোগুলো বছর ধার-দেনা করে ও আমত্মীয়স্বজনের সহায়তায় কোনোভাবে সংসার চালাচ্ছি। ঋণের বোঝা খুব ভারি হয়ে গেছে। বকেয়া বেতন ভাতাদি পেলে ঋণ শোধ করে হাফ ছেড়ে বাঁচতে পারি।

তিনি আরো বলেন, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের দ্বারে দ্বারে অসংখ্যবার যোগাযোগ করেও কোনো কাজ হয়নি।

প্রধান শিক্ষক মোঃ মনিরুজ্জামান (মামুন) বলেন, এই বিষয়টি আমাকে জিজ্ঞাসা না করে সচিব অথবা ডিজিকে জিজ্ঞাসা করেন। কারণ উনি (কাজী মোঃ মনিরুজ্জামান) এই বিদ্যালয়ের শিক্ষকই না।

বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি মোঃ মনিরুজামান মনির হাওলাদার বলেন, এই বিদ্যালয়ে দুই জন প্রধান শিক্ষক থাকার বিষয়টি একাধিকবার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানোর পরে তদন্ত হয়েছে। উভয়ের বেতন-ভাতাদি বন্ধ থাকলেও বর্তমানে মোঃ মনিরুজ্জামান মামুন কোনো অদৃশ্য বা দৈব শক্তিতে বেতন-ভাতাদি উত্তোলন করছেন তা জানা নেই। আমরা পরিচালনা কমিটি উভয়ের কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখেছি কাজী মনিরুজ্জামান এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এবং এর রেজুলেশন করে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরণ করেছি।

মির্জাগঞ্জ উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোঃ রিয়াজুল ইসলাম জানান, আমি এখানে নতুন এসেছি তবুও বিষয়টি আমি জেনেছি। একই বিদ্যালয়ে দুই জন প্রধান শিক্ষক বিষয়টি দুঃখজনক। তবে কাজী মনিরুজ্জামান সুবিদখালী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। কেন তিনি বেতন ভাতাদি পাবে না, সে ব্যাপারে কাগজপত্র দেখার পরে আমি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষে সাথে আলাপ করে অবশ্যই ব্যবস্থা নিবো।

Leave a Comment