বিদেশে অর্থ পাচার আর অন্যের জমি দখলের রেকর্ড করে দেশ জুড়ে আলোচিত হন ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের অব্যাহতিপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বরকত ও তার ভাই ফরিদপুর প্রেসক্লাবের অব্যাহতিপ্রাপ্ত সভাপতি ইমতিয়াজ হাসান রুবেল। তবে এরকম ‘বরকত-রুবেল’ দেশের বিভিন্ন স্থানে আরও রয়েছেন। যেমন আছে রাজধানীর উপকণ্ঠ কেরানীগঞ্জেও। ‘ফরিদপুর স্টাইলে’ কেরানগীগঞ্জের দুই সহোদর ছলিমউল্যাহ ও হাবিবউল্যাহ কৃষিজমি, জলাশয় আর খাল-বিল-নালা দখল করেই চলেছেন। শুধু রাতারাতি খাল আর জলাশয় দখলেই তারা দক্ষ নন, এই দুই ভাইয়ের চোখ থাকে অন্যের জমিতেও।
ছলিমউল্যাহ ও হাবিবউল্যাহর মালিকানাধীন ‘মধু সিটি’র বিরুদ্ধে বুড়িগঙ্গার শাখা নদী, খাল ও সরকারি খাস জমি বেদখলেরও অভিযোগ রয়েছে। ২০১৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ঢাকার জেলা প্রশাসককে (ডিসি) লেখা এক চিঠিতে বলা হয়, ‘মধুসিটি রিভারভিউ হাউজিংয়ের দখলকৃত বুড়িগঙ্গা শাখা নদীর, তিনটি খাল ও চলাচলের তিনটি রাস্তাসহ মোট ১৮ একর জমি উদ্ধার ও দখলকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হলো।’ এ ব্যাপারে মধুসিটির অন্যতম মালিক সলিমউল্যাহ ইত্তেফাককে বলেছিলেন, ‘স্থানীয় একটি চক্র প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অভিযোগ দিয়েছিল। পরে ডিসির কার্যালয় সবকিছু মেপে কোনো অনিয়ম পায়নি।’ ছলিমউল্যাহ ও হাবিবউল্যাহর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক) অভিযোগ রয়েছে।
ভুক্তভোগীরা জানান, মধুসিটি কেরানীগঞ্জে পাঁচটি আবাসন প্রকল্প গড়ে তুলেছে। এসব প্রকল্প করতে গিয়ে শুধু জলাশয়, খাল-বিল-নালা ও সরকারি খাস জমিই দখল করেননি, মানুষের পৈতৃক সম্পত্তি এমনকি বসতবাড়িও জোর করে দখল করছেন। এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে স্থানীয় থানায় একাধিক মামলা ও সাধারণ ডায়ারি (জিডি) করা হলেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ভুক্তভোগীরা বহুবার মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেছেন। জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপিও দিয়েছেন। বরং যারাই প্রতিবাদ করেছেন তারা উলটো মারধর ও মামলার শিকার হয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, মধুসিটি সব অপকর্মই নির্বিঘ্নে করছে স্থানীয় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও প্রশাসনের আশ্রয়-প্রশয়ে।
মধুসিটির হাত থেকে পৈতৃক বাড়ি ও জমিজমা রক্ষা করতে রাত জেগে পাহারা দিচ্ছেন স্থানীয় শত শত পরিবার। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে উলটো চুরি-ছিনতাই-ডাকাতির মামলার আসামি হয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যরা, কৃষিবিদ মোসলেহ উদ্দিন ফারুক এবং অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাসহ স্থানীয় সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা।
একসময় খামারবাড়িতে পরিচালক হিসেবে চাকরি করা কৃষিবিদ মোসলেহ উদ্দিন ফারুক ইত্তেফাককে বলেন, ‘আমরা মধুসিটির বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করেছিলাম, রায় আমাদের পক্ষে আসে। মধুসিটি কৃষিজমি, তিন ফসলি ও চার ফসলি জমি দখল করে রাতের অন্ধকারে বালু দিয়ে ভরাট করে ফেলছে। আমাদের রাজনৈতিক শক্তি নেই। পৈতৃক জমি ছেড়ে না দেওয়ায় আমার বিরুদ্ধে চুরি-ছিনতাই-ডাকাতির মিথ্যা অভিযোগে তিন/চারটি মামলা দেওয়া হয়েছে। আট জন মুক্তিযোদ্ধার পরিবারও ভুক্তভোগী। মধুসিটি জোর করে সম্পত্তি নিয়ে যেতে চায়। থানায় অভিযোগ করতে গেলেও মামলা নেয় না। স্থানীয় প্রশাসনও নীরব থাকে।’
জানা গেছে, স্থানীয়দের জমি দখল, বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ, মাদকের ব্যবসা, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে গড়ে তোলা হয়েছে ‘মোটরসাইকেল বাহিনী’। ‘কাঁঠালতলী গ্রীন সিটি’র অফিস ভেঙে কোম্পানির জমি বেদখল করার চেষ্টাও করে কথিত এই মোটরসাইকেল বাহিনীর সদস্যরা।
কাঁঠালতলী গ্রীন সিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলোয়ার হোসেন ইত্তেফাককে বলেন, ‘অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেই আমাদেরকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়। একটি জমিতে ভাড়া দিয়ে সাইনোবোর্ড লাগিয়ে পরে আশপাশের জমি জোরপূর্বক দখল করে নেওয়া হচ্ছে। রাতের আঁধারে মোটরসাইকেল বাহিনীর পাহারায় অন্যের জমি বালু দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে। আমরা রাতে ঘুমাতে পারি না। প্রশাসনেরও সহযোগিতা পাই না।’
স্থানীয়দের অভিযোগ, ‘মোটরসাইকেল বাহিনী’ চক্রের সদস্যরা প্রভাবশালীদের কাছ থেকেই পেয়েছেন এসব মোটরসাইকেল। ‘কাজ তুলে দেওয়া’র যোগ্যতা অনুযায়ী চক্রের দুই শতাধিক সদস্য মাসে ‘সম্মানি’ পান সর্বনিম্ন ৫ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এই চক্রের ভয়ে নিজেদের জমিজমা ছেড়ে স্থানীয়দের অনেকে এলাকা ত্যাগ করে মাসের পর মাস ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, প্রভাবশালীদের ‘অনুমতি’ ছাড়া এই এলাকায় কেউ নিজেদের জমিতেও স্থাপনা নির্মাণ করতে পারেন না। ‘অনুমতি’ কিংবা ‘বোঝাপড়া’ ছাড়া কেউ এলাকায় কোনো প্রকল্প বা স্থাপনা করতে গেলে ১০ মিনিটের মধ্যেই জড়ো হয়ে যায় ‘মোটরসাইকেল বাহিনী’। শুরু করে মারধর, ভাঙচুর ও উচ্ছেদ। ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সিদ্দিকের অভিযোগ, এই মোটরসাইকেল বাহিনীর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার কারণে তিনি বারবার হামলার শিকার হয়েছেন।
কেরানীগঞ্জ উপজেলার তারানগর, কলাটিয়া, রোহিতপুর ও শাক্তাসহ বিভিন্ন এলাকায় ফসলি জমি দখল করে আবাসন প্রকল্প করছে মধুসিটি। কোম্পানিটি বিগত ১০-১৫ বছর ধরে স্থানীয় কৃষকদের কৃষিজমি, পৈতৃক সম্পত্তি ও জলাশয় ভরাট করে প্রকল্প করছে। বালুরচর ও মধ্যেরচর মিলিয়ে বানানো হয়েছে মধুসিটি রিভারভিউ। এমনটি হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ থাকা সত্ত্বেও জমির প্রকৃতি বদলে ফেলা হচ্ছে। এতে এলাকার দশ শতাংশ কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কৃষিজমি ধ্বংস হলেও ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে দুই ভাই ছলিমউল্যা ও হাবিবউল্যাহর। দুই ভাই এলাকায় নিজেদের বসবাসের জন্য গড়ে তুলেছেন দুটি দৃষ্টিনন্দন প্রাসাদ।
জানা গেছে, মধুসিটির এসব কর্মকাণ্ডে সরাসরি প্রশ্রয় রয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েক জন নেতা। কেরানীগঞ্জ মডেল থানা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ইউসুফ আলী চৌধুরী সেলিম এবং দুই যুগ্ম-আহ্বায়ক আলতাফ হোসেন বিপ্লব ও শফিউল আজম বারকুর সখ্য রয়েছে এই কোম্পানির সঙ্গে। বারকু ইত্তেফাককে বলেছেন, ‘মধুসিটি একবার ঈদের আগে তাদেরকে ২০/২২ লাখ টাকা দিয়েছে। সেই টাকা তারা পার্টি অফিস নির্মাণে ব্যয় না করে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাসহ গরিব অনেককে অনুদান হিসেবে দিয়েছেন। ’
বারকু ইত্তেফাককে আরও বলেছেন, ‘মধুসিটি আগে অনেকের জায়গা দখল করেছে। এখন তাদেরকে আমরা বলে দিয়েছি—নিজেদের জায়গা ছাড়া অন্য কারও জায়গা তোমরা ভরাট করবে না’। এক প্রশ্নের জবাবে বারকু বলেন, ‘মধুসিটিসহ অনেকেই মাটি ভরাট করে। যারাই বালু দিয়ে মাটি ভরাট করে তাদের সঙ্গে কমবেশি ইয়ে… থাকে, পার্টি চালাতে তো খরচ লাগে…।’ আর থানা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক সেলিম বলেন, ‘বালু ভরাট থেকে কমিশন নেওয়ার ঘটনা আগেও ঘটেছে, এটা নতুন কিছু নয়’।
ভুক্তভোগী অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা মহিউদ্দিন ফারুক ইত্তেফাককে বলেন, ‘মধুসিটি তিন ফসলি ও চার ফসলি কৃষিজমি বালু দিয়ে ভরাট করে ফসল ধ্বংস করে দিচ্ছে। হাইকোর্টে রিট করলেও সেটিও তারা মানছে না। প্রতিবাদ করলে রাতের আঁধারে সন্ত্রাসী বাহিনী এসে বাড়িঘর ভাঙচুর করে। আমরা অসহায়।’
এতসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে মধুসিটির মালিক ছলিমউল্যাহকে ফোন করলে তিনি রিসিভ করেননি। মোবাইলে পরিচয় দিয়ে বার্তা পাঠানোর পর তিনি তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা সাব্বিরকে দিয়ে ফোন করান। সাব্বির ইত্তেফাককে বলেন, ‘সব অভিযোগ সত্য নয়। আর যাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে বলা হচ্ছে, আমরা কোনো মামলা করিনি।’