কলকাতার চলচ্চিত্র অঙ্গনে তিনি ছিলেন সবার প্রিয় ‘মিঠুদা’। অভিনয় ছিল তাঁর প্রাণ। লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন তিনি। গতকাল বুধবার ভারতীয় চ্যানেল স্টার জলসার রিয়েলিটি শো ‘ইসমার্ট জোড়ি’–এর সেটে ছিলেন তিনি। সকাল থেকে টানা শুটিংয়ে অংশ নিয়েছেন। একসময় অসুস্থ হয়ে পড়েন। সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে কিছু ওষুধ খাওয়ানো হয় তাঁকে। কিন্তু শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। রক্তচাপ নেমে আসে ৮০-তে। একসময় বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আজ বৃহস্পতিবার ভোরে তিনি বাড়িতে মারা যান। তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৮ বছর।
একসময় পশ্চিম বাংলার চলচ্চিত্রশিল্পের হাল ধরেছিলেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, অভিষেক চট্টোপাধ্যায়, তাপস পাল, চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তীর মতো অভিনেতারা। টালিউডে অভিষেক আর প্রসেনজিতের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকলেও দুই অভিনেতার মধ্যে বরাবর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল বলে শোনা যায়। প্রায় তিন দশক নায়কের ভূমিকায় টালিউডে ব্যস্ত ছিলেন অভিষেক। তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই শোকস্তব্ধ টালিউড।অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়ে স্মৃতিচারণা করেন। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের কাছে প্রতিক্রিয়া জানান অনেকেই। স্মৃতিচারণা করে লিখেছেন কলামও।
আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়া একটি কলামে ‘সুজন সখী’ সিনেমার সখী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত লিখেছেন, ‘সেই কবে থেকে আমাদের সম্পর্ক। সেই মিঠু কী করে এভাবে চলে যেতে পারে? টেলিভিশনে আজকাল দেখে বুঝতাম, ও শরীরের যত্ন নিচ্ছে না। ঘুম–খাওয়া কিছুই ঠিক সময়ে করত না। বরাবর খুব জেদ। নিজে যা ভালো বুঝবে, তাই-ই করবে। ওর মনে হয়তো অনেক ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। ওর মধ্যে অনেক না পাওয়ার ক্ষোভ ছিল। হয়তো নিজের বিষণ্নতায় নিজের ক্ষতি করেছে সবার অগোচরে।’
ঋতুপর্ণা আরও লিখেছেন, ‘প্রসেনজিতের পরে সবচেয়ে বেশি ওর সঙ্গে কাজ করেছি। আমাদের জুটি তো সুপার ডুপার হিট! তখন যেখানেই যেতাম, মানুষ আমাদের কথা বলত। একসঙ্গে দেখতে চাইত। আমাদের শেষ ছবি ছিল “নীলাচলে কিরিটী”। ওর চলে যাওয়াটা বাংলা সিনেমায় শূন্যতা সৃষ্টি করবে। মিঠুর মতো অভিনেতারা বাংলা সিনেমার খরার সময় এসে ধরে রেখেছিল এই ইন্ডাস্ট্রিকে। স্বপন সাহার “সুজন সখী” তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল এই ইন্ডাস্ট্রি। আমার দ্বিতীয় সুপারহিট সিনেমাই কিন্তু “সুজন সখী”। আমরা দুজনই ওই ছবি দিয়ে ইন্ডাস্ট্রিতে পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছিলাম। এই ছবি করে গ্রাম–গঞ্জে আমাদের নাম ছড়িয়ে পড়ে। ওই সিনেমার গান এখনো খোলা মাঠের অনুষ্ঠানে আমায় গাইতে হয়।’
অভিনেতা প্রসেনজিৎ বলেছেন, ‘চোখের সামনে একের পর এক মৃত্যু দেখছি। প্রতিক্রিয়াও জানাচ্ছি। কিন্তু অভিষেকের খবরটা সকালে শোনার পর মনে হয়েছে, এর প্রতিক্রিয়া আমি দিতে পারব না। ওর বিয়েতে বরের অভিভাবক হয়ে গিয়েছিলাম আমি। সেই দিনের কথা আজ মনে পড়ছে। ওর সঙ্গে যা কিছু ভালো স্মৃতি, সেটাই রেখে দিতে চাই। এর বেশি আর বলতে পারছি না।’
পীযূষ সাহা আজ সকালে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আজ সুপ্রভাত বলি কী করে! মিঠুদার মৃত্যুর খবর শুনে কিছুক্ষণ আমার কথা হারিয়ে যায়… একসঙ্গে কাজের স্মৃতিগুলো ভিড় জমাচ্ছে…।’ সুদীপা চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘মিঠুদা, আমরা শোকস্তব্ধ, বাকরুদ্ধ। যে চলে যায়, সে তো চলেই যায়। যারা পড়ে থাকে—শোক তাদের। সংযুক্তা বৌদি আর ওই একরত্তি মেয়েটার সামনে পড়ে অগাধ সমুদ্র…।’ সুদীপ্তা চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘ভালো থেকো মিঠুদা, আর কী বলব বুঝতে পারছি না…!’ প্রিয়াঙ্কা মিত্র লিখেছেন, ‘কেউ আর দস্যু বলবে না… ফটো তোলার সময় বলবে না, “হাসিতেই ফটো”!’ রাজা চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘ভীষণ অভিমান ছিল, সেভাবে মনের মতো চরিত্র পাননি বলে (কারণটা বিতর্কিত)। সকালে জানতে পারলাম মিঠুদা না ফেরার দেশে চলে গেছেন। ভালো থেকো মিঠুদা।’ পল্লবী চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘তুলনায় বয়সে কাছাকাছি মিঠু অর্থাৎ অভিষেক। এ কারণে বন্ধুত্ব হতে বেশি সময় লাগেনি। দারুণ প্রাণবন্ত ছিল ও। সারাক্ষণ হুল্লোড়, হা হা, হি হি। পারিবারিক সেই বন্ধুত্বের ছায়া স্বাভাবিকভাবেই পর্দায়ও। আমারও অল্প বয়স, মিঠুরও। আমাদের নিয়ে জুটি তৈরি করছেন পরিচালকেরা। দর্শক ভাবছেন, আমাদের মধ্যে তুমুল প্রেম!’
এ অভিনেত্রী আরও লিখেছেন, ‘পুরোদস্তুর ভালো মানুষ। মনে, মুখে, মাথায় এক। যা সাধারণত দেখা যায় না। খাওয়াতে খুবই ভালোবাসত। নিজে কিন্তু মেপে খেত। সুন্দর দেখতে ছিল। তার ওপরে নায়ক। শরীরটাকে তো ঠিক রাখতে হবে!’নব্বইয়ের দশকে বাংলা চলচ্চিত্রজগতের অন্যতম ব্যস্ত অভিনেতা ছিলেন অভিষেক। একসময় প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, তাপস পালদের সঙ্গে একসারিতে নাম উঠে আসত তাঁর। উৎপল দত্ত, সন্ধ্যা রায়ের মতো প্রতিভাশালী অভিনেতাদের সঙ্গে পর্দায় দেখা গেছে তাঁকে। কাজ করেছেন শতাব্দী রায়, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর মতো সমসাময়িক প্রথম সারির অভিনেত্রীদের সঙ্গেও। ১৯৬৪ সালের ৩০ এপ্রিল জন্ম তাঁর। ১৯৮৬ সালে তরুণ মজুমদারের ছবি ‘পথভোলা’ দিয়ে সিনেমায় যাত্রা শুরু। তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো হলো ‘দহন’, ‘বাড়িওয়ালি’, ‘মধুর মিলন’, ‘মায়ের আঁচল’, ‘আলো’, ‘নীলাচলে কিরীটি’। শুধু বড় পর্দা নয়, ছোট পর্দায়ও তিনি সমানভাবে সাবলীল অভিনয় করে দর্শকদের প্রশংসা পেয়েছেন।বৃহস্পতিবারই তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে। তার আগে কলকাতার টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে শ্রদ্ধা জানানো হবে এই প্রয়াত অভিনেতাকে।