গবেষক হতে চাইলে যে জীনিসগুলো জানতেই হবে আপনাকে এটি একটি গল্প আকারে তুলে ধরলাম আমাদের দেশের স্বনামধন্য একজন শিক্ষকের অভিজ্ঞতা দিয়ে। এটি পড়লে আপনি জানকে পারবেন গবেষক হতে চাইলে যে জীনিসগুলো জানতেই হবে আপনাকে।
গবেষক হতে চাইলে
মানুষ চাইলে কি না সম্ভব। ছেলেটা প্রায় তিন বছর ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছে। প্রতিবার এপ্লিকেশন করার পর আমাকে ই-মেইল করে জানায়- অমুক ইউনিভার্সিটি’তে আমার জন্য একটা রেকমেন্ডেশন লেটার পাঠাতে হবে। আমিও নিয়ম করে পাঠিয়ে দেই।
প্রায় আড়াই ধরে ছেলেটা চেষ্টা করে যাচ্ছে। তুরস্ক থেকে আসা এই ছেলেটা আমার অধীনেই মাস্টার্স থিসিস করেছে। ভালো ছাত্র বলতে যা বুঝায়; তার ধারে কাছেও নেই। অন্তত আমার অধীনে যে সব ছাত্র-ছাত্রী থিসিস করেছে; তাদের মাঝে এই ছেলেটাকে আমি কোন ভাবেই বলবো না পিএইচডি স্কলারশিপ পাওয়ার জন্য প্রথম সারির।
কিন্তু ছেলেটার খুব ইচ্ছা সে আমেরিকায় পিএইচডি করবে। মাস্টার্স পাশ করার পর তাকে জিজ্ঞেস করেছি
এরপর কি করবে?
পড়াশুনা চালিয়ে যাবো। পিএইচডি করবো।
বাহ, বেশ তো। তাহলে থিসিসটা আরেকটু ভালো করে করলে না কেন? আরেকটু মনোযোগ দিলেই তো পারতে?
ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে চমৎকার করে হাসি দিয়ে বলেছে
আমি জানি আমার থিসিস তোমার মন মতো হয়নি। কিন্তু দেখো, একদিন আমাকে নিয়ে তুমি গর্ব করবে। কারন আমি চেষ্টা করেছি প্রতিটা জিনিস শিখে নেবার।
গত প্রায় আড়াই বছর ধরে ছেলেটা চেষ্টা করে যাচ্ছে। এই পর্যন্ত কতো ইউনিভার্সিটিতে যে আমি ওর জন্য রেফারেন্স লেটার লিখেছি, আমার নিজেরই হিসেব নেই। এইসব দেশে যা হয়- ছাত্র ঠিক যেমন; ওকে ছাত্র অবস্থায় আমি যেমন দেখেছি; রেফারেন্স লেটারে সেটাই লিখতে হয়।
তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভালো-খারাপের মিশেল থাকে। তো মাস দুয়েক ছেলেটাকে বললাম
গবেষক হতে চাইলে
আমার মনে হয় তোমার রিচার্চ প্রপোজালটা একটু পড়ে দেখা দরকার। কোথাও যদি কোন সমস্যা থাকে, সেই ক্ষেত্রে দুজনে মিলে ঠিক করে নেয়া যাবে। আড়াই বছর হয়ে গিয়েছে, কোথাও তোমার হচ্ছে না। এখন বোধকরি একটু ভাবা দরকার।
ছোট্ট এই শহরে একটা কফি শপে বসে ওর রিসার্চ প্রপোজাল (অর্থাৎ যে বিষয়ে পিএইচডি করতে চায়, সেটার একটা প্রপোজাল) দেখে মনে হলো সব কিছু মোটামুটি ঠিক’ই আছে। শুধু বললাম- ডাটা কালেকশনের জায়গায় কেন তুমি ইন্টার্ভিউ করতে চাও; সেটার কোন ব্যাখ্যা নেই। ব্যাখ্যাটা যোগ করে দিও। আর ইন্টার্ভিউ কোয়েশ্চেন গুলো কিভাবে ডেভেলপ করবে; কোন থিয়োরি ব্যাবহার করবে সেটা একটু পরিষ্কার করে লিখে দিও।
এরপর মাস দুয়েক আগে সে আরেকটা ইউনিভার্সিটিতে আবেদন করেছে। বরাবরের মতো আমাকে রেফারেন্স লেটার লিখতে হয়েছে। সেখানে কি লিখেছিলাম, পুরোপুরি তুলে দেয়া তো সম্ভব নয়। তবে বরাবরের মতোই লিখেছিলাম- ছাত্র হিসেবে ও মধ্যম সারির। তাত্ত্বিক কিংবা পদ্ধতি গত বিষয়ে যে খুব ভালো জ্ঞান আছে; এমনটাও নয়। এইসব লিখেছি- কারন ছেলেটা ঠিক যেমন, সেটাই তো আমাকে লিখতে হবে। তো এবার যেটা করেছি; সেটা হচ্ছে- আলাদা করে একটা প্যারা করে লিখেছি-
ছাত্র হিসেবে আমি ওকে প্রায় বছর পাঁচেক ধরে দেখছি। ওর একাডেমীক ব্যাকগ্রাউন্ড হয়ত পিএইচডি করার মতো একদম সেরা ছাত্রদের কাতারে নয়; তবে ওর একটা চমৎকার গুণ আছে- লেগে থাকা। যে কোন কিছুতে সে লেগে থাকতে পারে। মাস্টার্স থিসিস শুরু করার সময় ওর কোন ধারণাই ছিল না- থিসিস কিভাবে লিখতে হয়। অথচ আমাদের এখানে ব্যাচেলরের ছাত্ররা এইসব অনার্স লেভেলেই শিখে আসে। কিন্তু তুরস্ক থেকে আসা এই ছেলেটার সে অর্থে কোন ধারণাই ছিল না এই বিষয়ে। এরপরও সে এক বারের চেষ্টাতেই মোটামুটি একটা রেজাল্ট নিয়ে বের হতে পেরেছে। যেখানে অন্যান্য দেশ থেকে আসা অনেকেই বেশ কয়েকবারের চেষ্টাতেও ভালো করে পাশ করতে পারেনি। এর কারন হচ্ছে- ছেলেটার শেখার ইচ্ছা এবং লেগে থাকার মানসিকতা। আমি জানি ওর মাস্টার্সের রেজাল্ট অতটা ভালো না। কিন্তু আমি নিশ্চিত- ওর শেখার আগ্রহটা আছে। শেখার জন্য সে লেগে থাকবে। যেটা পিএইচডি করার জন্য সব চাইতে বেশি দরকার। মেধা হয়ত অনেকেরই আছে। কিন্তু লেগে থাকার গুণ সবার থাকে না। এই ছেলেটার আছে। তাই আমি ভীষণ ভাবে রেকমেন্ড করছি ওর পিএইচডি এডমিশনের জন্য।
আজ সকালে ছেলেটার একটা ই-মেইল পেয়েছি। মেইলটা পুরোপুরি তুলে দিচ্ছি
প্রিয় আমিনুল,
শেষ পর্যন্ত আমি পেরেছি। আমার গত প্রায় আড়াই বছর ধরে চেষ্টা শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছে। আমি পুরো স্কলারশিপ সহ আমেরিকার জর্জিয়ায় পিএইচডি এডমিশন পেয়েছি। এই কয় বছর ধরে আমাকে উৎসাহ দেয়ার জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। তুমি উৎসাহ না দিলে আমি হয়ত আরও আগেই থেমে যেতাম। আমি কী এই উইকএন্ডে তোমাকে কোন রেস্তরাঁয় নিমন্ত্রণ করতে পারি? তোমার উত্তরের অপেক্ষায় থাকলাম।
মেইলটা পড়ে ছেলেটাকে উত্তর না দিয়ে এই লেখা লিখতে বসেছি। ছেলেটার ই-মেইল পড়ে একটা ভালো লাগা কাজ করছে। ভালো লাগার রেশ কেটে যাবার আগেই ভাবলাম কিছু লিখে ফেলা যাক।
প্রিয় ছাত্র,
এই যে তুমি ই-মেইল করে জানিয়েছ; এতেই আমি অনেক আনন্দিত হয়েছি। রেস্তরাঁয় আমন্ত্রণ করার দরকার নেই। জীবনভর এমনই থেকো। তুমি তো তুরস্ক থেকে এসছ। নিজ দেশ বাংলাদেশে থেকে এসছে, এমন কতো ছাত্র-ছাত্রী এই শহরে আছে; এমন একটা মেইল করারও প্রয়োজন বোধ করেনি! তুমি যে মনে করে মেইল করেছ, এটাই অনেক। শুধু একটা জিনিস মনে রেখো- কখনো অতীত ভুলে যাবে না। যারা অতীত ভুলে যায়, তারা হচ্ছে পৃথিবীর সব চাইতে নিকৃষ্ট শ্রেণীর মানুষ। এদের পক্ষে যে কোন খারাপ কাজ করা সম্ভব। নিজেকে খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখার জন্য হলেও অতীত মনে রাখবে। যেটা তোমাকে মানুষ হতে সাহায্য করবে। যাতে পা মাটিতেই থাকে। মনে রেখো- ভালো গবেষক হবার চাইতে ভালো মানুষ হওয়া বেশি জরুরী।
গবেষক হতে চাইলে যে জীনিসগুলো জানতেই হবে আপনাকে আর্টিকেলটি লিখেছেনঃ Aminul Islam