প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, শিশুদের জন্য একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ আমরা গড়ে যেতে চাই। এ জন্য আমি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও করে দিয়েছি। আজকে আমরা উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছি। এই মর্যাদা ধরে রেখে আগামী দিনে আমরা বাংলাদেশকে উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলব। এটা হচ্ছে আমাদের অঙ্গীকার। আর আজকের শিশুরাই হবে সোনার বাংলার আগামী দিনের কর্ণধার।বৃহস্পতিবার (১৭ মার্চ) বিকেলে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধির সৌধের ১নং গেটে আয়োজিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০২ তম জন্মবার্ষিকী, জাতীয় শিশু দিবস ও মুজিববর্ষ উদ্যাপন কমিটির আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন নিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে আমরা জাতির পিতার জন্মশত বার্ষিকী শুরু করেছিলাম। যে অনুষ্ঠানগুলো করার কথা ছিল সেভাবে করতে পারিনি। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে আমরা সবকিছু ভার্চুয়ালি করেছি। ২০২১ সালে আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করেছি। ২০২২ সালের ১৭ মার্চ আমরা মুজিব বর্ষ উদ্যাপন করছি। ২৬ মার্চ পর্যন্ত মুজিববর্ষ পালিত হবে। ২১ মার্চ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত সরকারি শেখ মুজিবুর রহমান কলেজ মাঠে লোকজ মেলা আয়োজন করা হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য ২০৪১, ২০৭১ আমাদের স্বাধীনতার শতবর্ষ উদ্যাপন করব। সেই সাথে ১০০ বছর পর্যন্ত বাংলাদেশ কীভাবে উন্নত হবে সেই পরিকল্পনাও আমি প্রণয়ন করে দিয়ে দিয়েছি।প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টুঙ্গিপাড়ার মাটিতে জন্মগ্রহণ করেছেন। এই মাটির ধুলামাটি মেখে, হেসে-খেলে বড় হয়েছেন। এই মাটি থেকেই শিখেছেন মানুষকে ভালোবাসতে। মানুষের কল্যাণে কাজ করতে। মানুষের জন্য তিনি কীভাবে একটি উন্নত জীবন দেবেন এই শিক্ষাটাও তার এই মাটির থেকে পাওয়া। আবার এই মাটিতেই তিনি চীর নিদ্রায় শায়িত। তারই নেতৃত্বে পেয়েছি আমার স্বাধীনতা, পেয়েছি আত্মমর্যাদা, পেয়েছি আত্মপরিচয়, পেয়েছি একটি রাষ্ট্র। আমি আজকে জাতির পিতার প্রতি আমার শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেন, আমি জানি না কি অপরাধ ছিল তার। এই দেশকে ভালোবেসেছিলেন আমার বাবা। দেশের মানুষকে ভালোবেসেছিলেন। এই দেশকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। যেন এদেশের মানুষ ভবিষ্যতে উন্নত জীবন পায়। সেই আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তিনি তার জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন মানুষের জন্য।সকল শিশুদের শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, তিনি শিশুদেরও গভীরভাবে ভালোবাসতেন। এ দেশের অগণিত শোষিত বঞ্চিত মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে গিয়ে তিনি যে জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন কিন্তু সেই কাজ সম্পন্ন করতে পারেনি। শিশুদের জাতির পিতা অত্যন্ত ভালোবাসতেন। আর সে জন্যই আমরা ১৭ মার্চকে শিশু দিবস হিসেবে ঘোষণা দিয়েছি। কারণ শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য স্বাধীনতার পরপরই যে সংবিধান দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু সেই সংবিধানে শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করেছিলেন তিনি। এছাড়া শিশু অধিকার আইনও তিনি করে দিয়েছিলেন। সেই সাথে শিশুদের সুরক্ষার জন্য কেয়ার অ্যান্ড প্রোটেকশন সেন্টার যা বর্তমানে সরকারি শিশু পরিবার নামে পরিচিত সেটা তিনি প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছিলেন।শেখ হাসিনা আরও বলেন, মাত্র সাড়ে ৩ বছরের যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তখনই ঘাতকের বুলেটের নির্মম আঘাত। আমি আর আমার ছোট বোন রেহানা বেঁচে গিয়েছিলাম। স্বজনহারা ব্যথা বুকে নিয়ে এদেশে রিফিউজিদের মতো কাটাতে হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য আমি ফিরে এসেছিলাম।সে অবস্থায় ঘাতক, যুদ্ধাপরাধী আলবদর, রাজাকারদের রাজত্ব ছিল। তারপরও আমি ফিরে এসেছিলাম আমার বাবার স্বপ্ন পূরণ করার জন্য। এ দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য। এ দেশের শিশুদের আগামী দিনে আমাদের মতো স্বজনহারা বেদনা নিয়ে বাঁচতে না হয়। তারা যেন সুন্দর জীবন পায়, উন্নত জীবন পায়।
শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেন, শিক্ষার জন্য বঙ্গবন্ধু ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন। জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসারে ১৯৯৬ সালে আমরা যখন সরকার গঠন করি তখনো আমরা শিশুদের উন্নয়নের জন্য শিক্ষা দীক্ষায় এগিয়ে নিয়ে যেতে পরি, পিছিয়ে না পড়ে সে জন্য প্রতিটি এলাকায় স্কুল তৈরি করে শিক্ষার ব্যবস্থা করি। জাতির পিতার মতো আমরাও অনেক স্কুল জাতীয়করণ করি। ২০০৮ সালে দ্বিতীয়বার যখন সরকারে আসি তখন অনেক গুলো কাজ করে গিয়েছিলাম।যাতে শিশুদের জীবনটা সুরক্ষিত হয়। আমরা জাতীয় শিশু শ্রমনীতি ২০১০, পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ আইন ২০১০, জাতীয় শিশু নীতি ২০১১, প্রতিবন্ধীদের সুরক্ষার জন্য প্রতিবন্ধী অধিকার সুরক্ষা ২০১৩, নারী ও শিশু প্রতিহিংসা প্রতিরোধ ২০১৩-২৫ মেয়াদে একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করি। সেটা আমরা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। বাংলাদেশ শিশু একাডেমি আইন ২০১৮, বাল্য বিবাহ নিয়ন্ত্রণ জাতীয় পরিকল্পনা ২০১৮-৩০ পর্যন্ত আমরা পরিকল্পনা করেছি। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন সংশোধন আইন ২০৩০ আমরা প্রণয়ন করেছি। শিশুরা স্কুল থেকে ঝরে না পড়ে সে জন্য মিড ডে মিল ও টিফিনের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। শতভাগ শিশু যাতে স্কুলে যায় সে পদক্ষেপও আমরা নিয়েছি। করোনা ভাইরাসের সময় স্কুল বন্ধ ছিল আল্লাহর রহমতে এখন সব স্কুল খুলে গেছে। কাজেই এখন স্কুলে পড়াশোনার সুযোগ আবার এসেছে। কোনো রকম যেন তারা বঞ্চিত না হয় সে জন্য আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি।
শিশুদের খেলাধুলার আগ্রহ বাড়াতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, প্রতি উপজেলায় একটি করে মিনি স্টেডিয়াম তৈরি করে দিয়েছি। সেখানে শিশুরা খেলাধুলা করতে পারবে, প্রতিযোগিতা করতে পারবে। আন্তঃস্কুল খেলাধুলা প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক চর্চা ব্যবস্থা করা হয়েছে।যাতে শুরু থেকেই তারা নানা ধরনের শিক্ষা পেতে পারে সেই ব্যবস্থাও আমরা নিয়েছি। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে আমাদের শিশুরা সুরক্ষিত থাকবে, সুন্দর জীবন পাবে।উপস্থিত শিশুদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, জাতির পিতা শিশুদের খুব ভালোবাসতেন। আমার ছেলে জয়ের সৌভাগ্য হয়েছে আমার বাবার কোলে চড়ে খেলাধুলা করতে। তিনি যখন বাচ্চাদের সামনে যেতেন তখন মনে হতো তিনিও একটা শিশু। এটা ছিল তার চরিত্রের সবচেয়ে বড় একটা দিক। দুর্ভাগ্য ৭৫-এ শিশুরা মুক্তিযুদ্ধ পায়নি। কারবালার ময়দানেও এমন ঘটনা ঘটেনি, শিশু নারীদের হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু এই বাংলার মাটিতে যাদের জন্য আমার বাবা জীবন উৎসর্গ করেছেন, বছরের পর বছর কারাগারে ছিলেন, জাতি হিসাবে মর্যাদা দিয়েছেন সেই বাঙালিদের হাতে তাকে জীবন দিতে হয়েছে। এটা হচ্ছে সবচেয়ে কষ্টের সবচেয়ে দুঃখের।
বিকেল তিনটায় বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত আলোচনা সভায় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম এমপি, মুহাম্মদ ফারুক খান এমপি, মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা এমপি, জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী এবং শিশুদের পক্ষে শেখ মুনিয়া ইসলাম বক্তব্য রাখেন। পরে আলোচনা সভা শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।এর আগে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০২ তম জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে বৃহস্পতিবার সকাল ১০ টা ৫৫ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বেলা ১১ টা ২০ মিনিটে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ টুঙ্গিপাড়ায় পৌঁছান। পরে সকাল সাড়ে ১১টায় বঙ্গবন্ধুর সমাধি সৌধ বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে প্রথমে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শ্রদ্ধা জানান। এ সময় কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। শ্রদ্ধা নিবেদনের পর সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর একটি চৌকস দল গার্ড অব অনার প্রদান করে। বেজে ওঠে বিগউলের সুর। পরে বঙ্গবন্ধু, তার পরিবারের শহীদ সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধে নিহত ৩০ লাখ শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে ফাতেহা পাঠ ও বিশেষ মোনাজাতে অংশ নেন। পরে রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ বঙ্গবন্ধু ভবনে রক্ষিত মন্তব্য বহিতে মন্তব্য লিখে স্বাক্ষর করেন।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদনের পর দলের নেতৃবৃন্দকে সঙ্গে দলের প্রধান হিসেবে এবং জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা জানান শেখ হাসিনা। এরপর জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা জানান। পরে রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি শেষ করে হেলিকপ্টারে যোগে বেলা ১২ টা ৪০ মিনিটে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও বিকেল ৫টা ৪০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকার উদ্দেশ্যে টুঙ্গিপাড়া ত্যাগ করেন।