ফ্রান্সের ভার্সাইয়ের ঐশ্বর্যশালী প্রাসাদটির কথা মনে আছে নিশ্চয়। প্যারিসের ১২ মাইল পশ্চিমে ঝাঁ–চকচকে প্রাসাদটি তৈরি করেছিলেন তৎকালীন ফরাসি রাজারা। বলা হয়ে থাকে, বহির্বিশ্বকে প্রভাবিত করতেই প্রাসাদটির ডিজাইন করা হয়েছিল। যদিও ফরাসি বিপ্লবের সময় এটি রাজকীয় ব্যর্থতার এক উজ্জ্বল প্রতীকে পরিণত হয়। প্রাসাদটির কথা বলা হচ্ছে কারণ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নেতারা দুই দিনের শীর্ষ সম্মেলনের জন্য বর্তমানে সেখানে অবস্থান করছেন। ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের মুখে ইইউ ঐক্যের চিত্র তুলে ধরতে পারে এই সম্মেলনে।
বেশ কিছু বিষয়ে ইইউ সদস্যদেশগুলোর মধ্যে এর আগে স্পষ্ট বিভক্তি দেখা গেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, ইইউর জন্য একটি অভিন্ন প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এবং ইউক্রেনকে ইইউতে অন্তর্ভুক্ত করে ‘ব্লকে’র বিস্তার বাড়ানো প্রসঙ্গ।কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের কারণে ইইউর অনেক দেশকে এমন কিছু পদক্ষেপ নিতে দেখা গেছে, যেগুলো আগে দেখা যায়নি। যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিজেদের ভূমিকার কারণে গত কয়েক দশকের অস্বস্তির পর জার্মানি তার সামরিক বাহিনীকে পুনরায় ঢেলে সাজানো শুরু করেছে। ইউরোপীয়দের ব্যবসায়িক ক্ষতি সত্ত্বেও ইইউ রাশিয়ার ওপর ব্যাপক হারে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
ইউক্রেনীয় আশ্রয়প্রার্থীদের ইইউ ব্লকে বসবাসের ক্ষেত্রে সাহায্যার্থে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অস্থায়ী সুরক্ষা নির্দেশিকাটি প্রথমবারের মতো ব্যবহৃত হয়েছে। ২০১৫ সালে অভিবাসী সংকটের সময় এ বিষয়ে ব্যাপক বিভক্তি দেখা গিয়েছিল। যুদ্ধে জড়ানো কোনো দেশের জন্য এই প্রথম অস্ত্র ক্রয় ও সরবরাহ করছে বেলজিয়াম।
রাশিয়ার গ্যাসের ওপর থেকে নির্ভরতা কমাতে একটি নতুন পরিকল্পনা তৈরি ও জ্বালানি শক্তি উৎপাদনের আলোচনার বিষয়টি সব সময় তালিকার নিচের দিকে রাখত ইইউ। এবার এ বিষয়ে তাদের মধ্যে ঐক্যের সুর দেখা গেছে। পশ্চিমারা এবার জ্বালানির বিকল্প খোঁজার বিষয়ে বেশ তৎপর।
কিন্তু নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুট বললেন ভিন্ন কথা। গত বুধবার তিনি বলেন, রাশিয়া থেকে ইইউর দেশগুলোয় তেল ও গ্যাস আমদানি পুরোপুরি বন্ধ করা অসম্ভব। তিনি আরও বলেন, ‘রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের ওপর আমাদের যে নির্ভরশীলতা রয়েছে, এর পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের যে সংকট, তা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। আজ থেকেই দেশটি থেকে গ্যাস ও তেল আমদানি বন্ধে আহ্বান আমি জানাব না।’ইউক্রেন ইস্যুতে বুধবার ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী জ্যঁ ক্যাসটেক্সের সঙ্গে বৈঠক করেছেন মার্ক রুট। ফ্রান্সের প্যারিসে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এরপর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন রুট।
ইইউ–বহির্ভূত পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরি বছরের পর বছর ধরে ব্রাসেলসের সুনজরে ছিল না। বর্তমান সংকটে এ দুটি দেশকে কাছে টানছে ব্রাসেলস। ন্যাটো এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্রাসেলসের সহযোগিতা এবং সমন্বয় দীর্ঘদিন অনুপস্থিত ছিল। বর্তমান সংকটে এদের সঙ্গে তুলনামূলক ঘনিষ্ঠ হয়েছে ব্রাসেলস। প্রশ্ন হচ্ছে, এটি কি ব্রাসেলসের অস্থায়ী পদক্ষেপ নাকি ইউরোপে ব্রাসেলসের পুনর্জন্ম।
২০১৬ সালের ব্রেক্সিট ভোটের পরে ইইউ উপলব্ধি করেছে যে তাদের আত্মোন্নতি দরকার।ইইউকে ২০১২ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছিল। ছয় দশকের বেশি সময় ধরে ইউরোপে শান্তি ও পুনর্মিলন, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের অগ্রগতিতে অবদান রাখার জন্য এ পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল।কিন্তু ইউরোপের অনেকের চোখে ব্রাসেলস উদারতাবাদের পরিবর্তে নব্য উদারবাদের আবাসস্থল। তারা বড় ব্যবসাকে অগ্রাধিকার দিয়ে বাণিজ্য চুক্তির প্রবর্তক। শরণার্থীদের ইইউ উপকূলে পৌঁছাতে বাধা দেওয়ার জন্য নোংরা অভিবাসী চুক্তির (তুরস্কের সঙ্গে) নির্মাতা।
২০০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার পর ইইউ বিশেষ পরিবার বা ব্যক্তিকে সাহায্যের পরিবর্তে ব্যাংকগুলোকে সাহায্য করা শুরু করে। ইইউ এমন একটি সত্তা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কয়েক দশক পর, যেটি ইউরোপে শান্তির জন্য একটি শক্তি হিসেবে তার দৃষ্টিভঙ্গী, মিশন এবং স্বীকৃতি হারিয়ে ফেলে।ভোটাররা ‘ভালো বিকল্প’ খোঁজার পরিপ্রেক্ষিতে জনতুষ্টিবাদ, জাতীয়তাবাদ এবং উদারবাদ ইউরোপীয় রাজনীতিতে পরিচিত ধারা হয়ে উঠেছে। ইইউ দেশগুলো অভিবাসন, ইউরো জোন সংস্কার এবং আরও অনেক কিছু ইস্যু নিয়ে চাপে পড়তে থাকে।
ইউরোপে ব্রাসেলস এবং ঐতিহ্যবাহী রাজনীতিবিদদের প্রতি আস্থা কমে যাওয়ায় ষড়যন্ত্র তত্ত্বের বিকাশ ঘটে। ফলে জনসাধারণের মধ্যে হাঙ্গেরির ভিক্টর ওরবাস, তুরস্কের এরদোয়ান, যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প ও রাশিয়ার পুতিনের মতো ব্যক্তিদের জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করে। এরপর ২০২০ সালে করোনা মহামারির পর সবকিছু পুনর্নির্মাণ শুরু হয়।অপ্রত্যাশিতভাবে পুনরায় দৃশ্যপটে ফিরে আসার পর ব্রাসেলস জনস্বার্থে কাজ করছে বলে মনে করা হচ্ছে। সদস্যদেশগুলোকে আরও ঐক্যবদ্ধ মনে হচ্ছে। তারা সাধারণ মানুষের মতামতে গুরুত্ব দিচ্ছে।
করোনা মোকাবিলায় ইইউ যেভাবে এক হয়েছে, একইভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট মোকাবিলা করতে ইইউ নেতাদের আহ্বান জানিয়েছেন ইইউর পররাষ্ট্র নীতিবিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল।ইউরোপে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ইইউর নেতাদের আবারও একই প্রশ্নের মুখোমুখি করেছে—তাঁরা কী করতে পারেন, কী করা উচিত বা কিসের পক্ষে দাঁড়ানো উচিত।কিন্তু এই দুই দিনের অনানুষ্ঠানিক শীর্ষ সম্মেলন নতুনভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়া ইইউর ফাটল উন্মোচন করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে।সব ইইউ নেতাই ক্রমবর্ধমান জ্বালানি ব্যয় এবং রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা ও সম্ভাব্য পাল্টা নিষেধাজ্ঞার প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন। এ বিষয়ে নিজেদের করণীয় নিয়েও রয়েছে দ্বিমত। কেউ কেউ একটি সর্বজনীন ইইউ সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন। অর্থাৎ ব্রাসেলস থেকে নতুন তহবিল চাইছেন তাঁরা। জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসের মতো কয়েকটি দেশ আবার এ বিষয়ে ‘না’ বলে দিয়েছে ইইউর এই শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজক ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ। বিশ্বে ক্ষমতাধর নেতাদের মধ্যে তিনি একজন। দীর্ঘদিন ধরে একটি শক্তিশালী, আরও স্বাধীন, খাদ্য, প্রযুক্তি এবং শক্তি আমদানি বন্ধ করে এবং ন্যাটোর সঙ্গে কাজ করার জন্য নিজস্ব প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তুলেছেন।
তবে ইউক্রেনের দুর্ভোগ ও ক্ষতির দৃশ্যে ইইউর নেতাদের মধ্যে আবেগ তৈরি করছে বলেই মনে করা হচ্ছে। ইইউর সদস্যপদ পাওয়ার জন্য ইউক্রেনের আবেদন দ্রুত বাস্তবায়ন করা যায় কি না, এ নিয়ে ইইউতে বিতর্ক চলছে। তবে সংহতির প্রতীক হিসেবে ভার্সাই প্রাসাদ সাক্ষী হবে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে অভিযান শুরু করে রাশিয়া। রুশ আগ্রাসন ঠেকাতে পশ্চিমা দেশগুলো নানা রকম নিষেধাজ্ঞা জারি করে চলেছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ওপরও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশ। যুদ্ধ বন্ধে রাশিয়া ও ইউক্রেনের কর্মকর্তারা বেলারুশ সীমান্তে কয়েক দফায় বৈঠকে বসেন। তবে প্রতিবারই কোনো রকম সমঝোতা ছাড়াই বৈঠক শেষ হয়েছে। কিয়েভ বলছে, তারা আবারও বৈঠকে বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ জন্য দুই পক্ষই প্রস্তুতি নিচ্ছে। যুদ্ধ বন্ধে কূটনৈতিক তৎপরতা এখনো চলছে। ভারত, চীন, ইসরায়েল ও আরব বিশ্বের কয়েকজন নেতা পুতিন ও জেলেনস্কির সঙ্গে মধ্যস্থতার বিষয়ে নিজেদের আগ্রহের কথা জানিয়েছেন।