ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি মরে গেছে? এই আর্টিকেলটি পড়লে বুঝতে পারবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি মরে গেছে না বেচে আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি মরে গেছে না ঘুনে ধরেছে।
এই আর্টিকেলটি কামরুল হাসান মামুন স্যার এর টাইমলাইন থেকে নেওয়া হয়েছে। শুরু করা যাক আর্টিকেল টি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর লেখা এই চিঠিটি সবার পড়া উচিত। আমার ধারণা লেখাটি বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকের নাবলা কথা। শুধু শিক্ষার্থী না।
“আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র। আমি X অনুষদের সিনিয়র ইয়ারে পড়ছি। আজ প্রায় তিন বছর যাবত আপনাকে ফলো করি, আপনার লেখা পড়ি। যখন পড়ি, তখন মনে হয়, আমার দুঃখ টের পাবার মতো একজন শিক্ষক অন্তত এই বিশ্ববিদ্যালয় তৈরী করতে পেরেছে। তিনি ডঃ মামুন স্যার।
স্যার, আমি আজ কিছু কথা বলব আপনাকে।
২০১৮ তে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) তে আসি, আমার আশা ছিল অনেক। এখানে পড়ব, এরপর ফরেন “Y” ডিগ্রী করব। Perceived Image এবং Real Image এর মধ্যে বড়সড় ধরনের তফাৎ টের পাই আমি যখন সেকেন্ড ইয়ারে। কিছুদিন রেসিডেন্সিয়াল হলে ছিলাম। সিট পাইনি। মেঝেতে ঘুমুতাম। সেখানে রাবিশ ছিল, ছারপোকা ছিল, এর মধ্যে ঘুমিয়েছি। ভয়াবহ নিম্নমানের খাবার খেয়েছি। তবু সারভাইভ করে যেতে পারতাম- যদিনা রাজনীতি করতে হতো। স্যার, প্রতিদিন রাত সাড়ে নটায় লাইব্রেরী থেকে ফিরতাম। ঘর্মাক্ত শার্ট পালটে রাত দশটায় যখন মেঝের সেই বিছানায় শুতাম, তখন সিনিয়র রা এসে ধরে নিয়ে যেত প্রোগ্রাম করার জন্য। স্যার, ব্যক্তিগত ভাবে আমি শেখ মুজিবুর রহমান কে ভালবাসতাম। কিন্তু তাকে নিয়ে, আওয়ামীলীগকে পুজি করে এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে যে ভয়াল রাজনৈতিক প্রাকটিস চলছে, এটা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার স্বপ্ন কে নষ্ট করে দিচ্ছে। আমার মনে আছে, আমি পড়তে পারতাম না। ভয় হতো, ভাইয়েরা এসে প্রগ্রামে নিয়ে যাবে। সেই অবস্থায় উঠে রাত তিনটে অবধি হাতে তালি দিয়ে স্লোগান দিয়েছি, তারপর এসে ঘুমিয়ে সকাল ৮ টার ক্লাস করেছি। এগুলো আমি চাইনি স্যার। রাজনীতি ব্যাপারটাই আমাকে টানেনি। আমি পড়াশোনা করতে চেয়েছি শুধু।
আমার সিজিপিএ সেবার নেমে যায়। শরীর ভেঙে পড়ে। ট্রমাটাইজড হয়ে যাই। হল ছেড়ে দেই। আমাদের শিক্ষকদের মত দায়িত্বজ্ঞানহীন শিক্ষক আমি আমার কলেজেও দেখিনি স্যার- অন্তত তারা যতটুকু জানতেন, দেবার চেষ্টা করতেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্কছু শিক্ষকদের দেখে মাঝে মাঝে আমার স্বেচ্ছাচারী মনে হয়। যখন যেমন ইচ্ছে হচ্ছে ক্লাস নিচ্ছেন, নিচ্ছেন না। স্টুডেন্ট কতটুকু নিতে পারবে, তারা কেমন আছে, কোন ব্যাপারে তাদের আগ্রহ নেই। ক্লাসে পড়ানোর মান যথেষ্ট রকমের খারাপ। তাঁরা যখন পড়ান, টের পাওয়া যায়, যে তারা যতটুকু জানেন, তার ২০ ভাগও দিচ্ছেন না। আমরা বন্ধুরা নিজেরা যেটা ডিসকাস করে পড়ি, সেটা ভাল বুঝি। টিচাররা কোন রকম এসে যেন অনুবাদ করে বইগুলি। এতটা স্বস্তা শিক্ষার মান এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, এতটা মুখস্থকরণ এখানে, আমার ভয় হয়। যে আগামী ৫০ বছরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টেলেকচুয়াল মানুষেরা পড়তে আসবেনা আর।
টিএসসি আমার খুব পছন্দের ছিল একসময়। শুক্রবার বিকেলে সেই টিএসসি গেলে আমার বমনেচ্ছা হয়। এত বহিরাগত মানুষ, এত হাই ডেসিবল শব্দ, হর্ন, ক্রাউড, ভয়াবহ শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে এই শব্দদূষণে। এটা যে আমার বিশ্ববিদ্যালয়, তা আর বুঝতে পারিনা। মনে হয় কোন রেস্ট্রিকটেড বাউন্ডারি নেই, ছাত্র শিক্ষকের আলাদা একটু নিজেদের জায়গা নেই। হলে পড়ার পরিবেশ নেই, টিচিং ইভালুয়েশনের সুযোগ নেই। ঢাকা শহরের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এলে আমার অসুস্থ লাগে।
স্যার, মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি পড়তে চাইনি। এর চেয়ে আমার বাড়ির নিকটবর্তী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ভাল ছিল। সেখানে নিভৃত রুরাল ক্যাম্পাস আছে। হয়তো শিক্ষার মান কম। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত অসুস্থ পরিবেশ সেখানে নেই।
স্যার, একসময় এই বিশ্ববিদ্যালয়কে আমি ভীষণ ভালবাসতাম৷ আর এখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আমার ঘৃণা আর বিতৃষ্ণা ছাড়া কিছুই বাকি নেই৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মরে গেছে স্যার। যেদিন রাজনীতি বন্ধ হবে, আপনাদের মত মানুষদের কথাটাকে মূল্যায়ন করা হবে, সেদিন এই বিশ্ববিদ্যালয় ফিরতে পারে। নইলে আগামী দশ বছরে এই বিশ্ববিদ্যালয় অনেক নিচে নেমে যাবে। খুব আশা করি স্যার, আমাদের সরকার জেলায় জেলায় ইউনিভার্সিটি না খুলে এই বিশ্ববিদ্যালয় গুলিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিশ্ববিদ্যালয় বানাবে। আপনাকে যখন দেখি, লেখা যখন পড়ি, মনে হয় — স্বপ্ন বেঁচে আছে।”
– কেবল শিক্ষার্থী না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সেরা শিক্ষকের সাথে কথা হচ্ছিল। তার ধারণাও এই শিক্ষার্থীর ধারণার সাথে অনেকটা মিলে যায়। সেই সেরা শিক্ষকও মনে করেন যে যেইভাবে চলছে এইভাবে আর কিছুদিন চললে এটিকে মৃত ঘোষণা করা যাবে। এর মান বলতে আর কিছুই থাকবে না।
আসলেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের কথা ভাবার মত কোন শিক্ষক নেই। যদি থাকতো শিক্ষার্থীরা এমন অমানবিক অবস্থায় থাকতো না। কখনো দেখেছেন শিক্ষকরা সরকারের কাছে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে? বরং উল্টো হয়েছে। যা দেয় তাতেই খুশি হয়ে ধন্যবাদ দিতে দিতে মুখের ফেনা বের করে ফেলে। অথচ শিক্ষক শিক্ষার্থীরা সম্মিলিতভাবে দাবি জানালে এই অবস্থা থাকতো না। দেশ সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মানবেতর অবস্থায় রেখে জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় খোলার নামে কেবল ভবন নির্মাণ আর দলান্ধদের ভিসি নিয়োগ দিচ্ছে। তাতে কি শিক্ষার মান বাড়ছে না কমছে?