রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দিচ্ছেন—এমন ধারণা হয়েছে ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিন-ইভেস লে ড্রিয়ানের। এর বিপরীতে তিনি বলেছেন, পুতিনের বোঝা উচিত ন্যাটোও একটি পারমাণবিক জোট।হয়তো কোনো পারমাণবিক যুদ্ধ হবে না। কিন্তু যদি সে রকম কিছু অঘটন শুরু হয়ে যায়, পরিণতিটা কী হতে পারে, সে সম্পর্কে আমরা কতটা জানি? যুদ্ধ কিন্তু শুধু ইউরোপ-আমেরিকায় সীমাবদ্ধ থাকবে না। চীন-বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান, কোনোটাই বাদ যাবে না। সীমিত বা আঞ্চলিক পারমাণবিক যুদ্ধ এখন আর হবে না। হলে হতে হবে বিশ্বব্যাপী, শুরুটা যেখানে যেভাবেই হোক।এ রকম পারমাণবিক বিশ্বযুদ্ধ কি হতে পারে? অন্তত একটি কারণে এর আশঙ্কা খুবই কম। কীভাবে জানলাম? সে কথায় পরে আসছি।
অবশ্য ঘটনা দিন দিন খারাপ থেকে খারাপের দিকে যাচ্ছে। রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেন সীমান্তে হামলা চালিয়েছে। রাজধানী কিয়েভেও রাশিয়ার যুদ্ধবিমানগুলো বোমা বর্ষণ করেছে, খণ্ডযুদ্ধ চলছে। আর ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটো জোটভুক্ত দেশগুলো পরামর্শসভা করছে। সমুচিত জবাব দেবে। হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে নানা রকম অবরোধ আরোপ করছে। আর রাশিয়া বলছে, বাইরের কোনো শক্তি হস্তক্ষেপ করলে পরিণতি হবে মারাত্মক।রাশিয়া মরিয়া। বলছে, তাকে চারদিক থেকে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো ঘিরে রেখেছে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কয়েকটি প্রজাতন্ত্র ও মিত্রদেশকে দলে টেনে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ওই সব দেশের সীমান্ত এলাকায় তাদের নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড বসিয়ে রাশিয়াকে অনায়াসে কাবু করে ফেলবে। বাকি ছিল ইউক্রেন। ১৫ থেকে ২০ বছর ধরে তাকেও ন্যাটোতে টানার চেষ্টা চলছিল। রাশিয়ার ঘোর আপত্তি। কারণ, ইউক্রেন হাতছাড়া হলে ওই এলাকায় রাশিয়ার রণতরিগুলোর জন্য নির্ভরযোগ্য ঘাঁটি হাতছাড়া হয়ে যাবে। ইউক্রেনের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে কৃষ্ণসাগরের তীরে ক্রিমিয়া সমুদ্রবন্দর তাদের খুব দরকার। তা ছাড়া সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের আমল থেকে ইউক্রেনের ভূখণ্ড ব্যবহার করে রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের পাইপলাইন ইউরোপে গেছে। তাই ইউক্রেনকে হাতে রাখতে হবে।
এর আগে এসব নিয়ে একবার যুদ্ধ পর্যন্ত হয়েছে। সমাধান হয়নি। ইউক্রেনের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের অধিবাসী আদি রুশ। তাদের প্রভাবিত দুটি অঞ্চল সম্প্রতি স্বাধীনতা লাভ করামাত্রই রাশিয়া তাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। তারপর তাদের মিত্রদেশকে সমর্থনের যুক্তিতে ওই দুটি অঞ্চলে ট্যাংক-মিসাইল-সৈন্য পাঠিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে।ওদিকে কিছুদিন আগে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন ও চীনের প্রধানমন্ত্রী সি চিন পিং এক তাৎপর্যপূর্ণ বৈঠকে সহযোগিতার বন্ধন দৃঢ়তর করার অঙ্গীকার করেছেন। যদিও চীন শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের কথা বলছে; কিন্তু বলছে যেন কেউ যুদ্ধের উসকানি না দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের কিছু কাজের সমালোচনাও করেছে।রাশিয়া বলছে, ইউক্রেন ন্যাটোতে যেতে পারবে না। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, রাশিয়া একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে হামলা চালিয়েছে। সবাই বলছেন, আবার সেই স্নায়ুযুদ্ধ বোধ হয় শুরু হয়ে গেল। কারণ, দুপক্ষের দেশগুলোর কাছে প্রচুর পারমাণবিক অস্ত্রের মজুত আছে।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়ার পারমাণবিক বোমা আছে ৬ হাজার ২৫৭টি, যুক্তরাষ্ট্রের ৫ হাজার ৫৫০টি। সাম্প্রতিক অন্যান্য সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চীনের হাতে রয়েছে ৩৫০টি, ফ্রান্সের ২৯০টি ও যুক্তরাজ্যের হাতে ২২৫টি পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। এর বাইরেও পাকিস্তান ভারত, উত্তর কোরিয়া, ইসরায়েলসহ আরও বেশ কিছু দেশের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে যদিও পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের জন্য গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকেই বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক চুক্তি হয়েছে। পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনা এবং বিশেষভাবে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধে বিশ্বের মূল পরাশক্তিগুলো সম্মতি-চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
এক হিসাব অনুযায়ী রাশিয়ার ইন্টার কন্টিনেন্টাল-রেঞ্জ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপিত পারমাণবিক বোমা প্রায় ৩০ মিনিটেই যুক্তরাষ্ট্রে আঘাত হানতে সক্ষম। প্রায় একই ধরনের সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর রয়েছে। স্টার্ট চুক্তিতে এ ধরনের অস্ত্র নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যদি পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে বিশ্বের ৪ হাজার ৫০০ মহানগরী ধ্বংস করতে মাত্র ১৩ হাজার ৫০০ পারমাণবিক বোমাই যথেষ্ট। এ পর্যন্ত শুধু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে যুক্তরাষ্ট্র দুটি অ্যাটম বোমা ব্যবহার করেছিল। এতে প্রায় ১ লাখ ৫ হাজার মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে মারা যান এবং আহত হন প্রায় ৯৪ হাজার মানুষ। ওই পারমাণবিক অস্ত্রের তেজস্ক্রিয়তার জের এখনো ওই সব এলাকায় চলছে।
প্রতিবছর হিরোশিমা-নাগাসাকি দিবসে বিশ্বের সব দেশে সেই নির্মম হত্যাযজ্ঞে নিহত-আহত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এ রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি কেউ চায় না। তাহলে কেন বছরের পর বছর হাজার হাজার পারমাণবিক বোমা বানানো হচ্ছে? এর কারণ হিসেবে বলা হয়, বেশি পারমাণবিক বোমা মজুত থাকলেই নাকি শান্তি নিশ্চিত হবে। কারণ, প্রতিপক্ষ জানবে অমুক দেশের বিরুদ্ধে কিছু করা যাবে না, কারণ ওদের কাছে অনেক বেশি পারমাণবিক বোমা আছে! এ রকম যুক্তি একেবারেই অচল। তাই স্নায়ুযুদ্ধের সময় বিভিন্ন দেশের পারমাণবিক অস্ত্রের মজুত ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনার চুক্তি হয়েছে। যদিও বাস্তবায়ন খুব ধীর। উপরন্তু, চোরাই পথে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির ফর্মুলা বিভিন্ন দেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। বিস্তার রোধ কঠিন হয়ে উঠছে।তাহলে কি আজ না হোক কাল পারমাণবিক যুদ্ধ হতে পারে? এর কোনো সহজ উত্তর নেই। তবে অন্তত একটি কারণে হয়তো এ ধরনের ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের পুনরাবৃত্তি আর হবে না।
কারণটা কী? ধরা যাক, পারমাণবিক শক্তিধর একটি দেশ অন্য একটি দেশের ওপর পারমাণবিক অস্ত্র নিক্ষেপ করল। যদিও একটি বোমাই যথেষ্ট, তবু সে একটি বোমা মেরে নিশ্চুপ থাকতে পারবে না। দুটি কারণে। প্রথমত, এ বোমাগুলো তৈরি করা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে পরীক্ষা করে দেখার সুযোগ নেই। বোঝা মুশকিল সেটা কতটা কার্যকর। সব বোমাই হয়তো ফর্মুলা অনুযায়ী কম্পিউটার সিমুলেশনের মাধ্যমে পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে অথবা ভূগর্ভস্থ কোনো বিশেষ এলাকায় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে। যেটা পরীক্ষা করা হয়েছে, সেটা তো গেছেই। আর সেই আদলে যে বোমাগুলো বানানো হয়েছে, ওগুলো গুদামে আছে। তাই একটা সন্দেহ থাকবেই, যদি সেটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনে বিস্ফোরিত না হয়? তাহলে তো পরমুহূর্তে তার দেশের ওপর ওরা পারমাণবিক বোমা ছুড়বে। তাই কোনো ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। যদি পারমাণবিক বোমা মারতেই হয়, তাহলে একের পর এক পাঁচ-সাত-দশটা ছুড়তেই থাকবে। আর একই সঙ্গে প্রতিপক্ষের মিত্রদের ওপরও পারমাণবিক হামলা চালাতে হবে। না হলে তো বিপদ।
ওদিকে অপর পক্ষও বসে থাকবে না। ওরাও একই পদ্ধতিতে পারমাণবিক হামলা চালাতে থাকবে। ফলে, কয়েক মিনিটের মধ্যেই সারা বিশ্ব পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে।পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলো এসব জানে। তাই শেষ পর্যন্ত ওরা কেউই পারমাণবিক যুদ্ধে যেতে চাইবে না। কারণ, সবাই বোঝে আরেকটা পারমাণবিক যুদ্ধে কেউ জিতবে না, সবাই ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই হয়তো বিবদমান পক্ষগুলো কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে এ ধরনের সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছাবে। এটাই সবার কাম্য।