পূর্ব ইউক্রেন সীমান্তে লাখো সেনা মোতায়েন নিয়ে পশ্চিমাদের সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যে ২১ ফেব্রুয়ারি দেশটির রুশপন্থী বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত দুটি অঞ্চল দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। একই দিন তিনি অঞ্চল দুটিতে সেনা পাঠানোরও নির্দেশ দিয়েছেন। পুতিনের এই পদক্ষেপে ইউক্রেন সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। পুতিনের পদক্ষেপের পাল্টা হিসেবে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দিয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো।
চলমান ইউক্রেন সংকট নিয়ে পাঠকের মনে নানা প্রশ্ন আছে। বিবিসি বাংলা অবলম্বনে সেসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা রইল এই প্রতিবেদনে।সাম্প্রতিক ইতিহাস বিবেচনায় নিলে চলমান সংকটের সূত্রপাত ২০১৪ সালে। তবে এই সংকটের মূলে যেতে ফিরে তাকাতে হবে সোভিয়েত আমলে। তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল ইউক্রেন।
উক্রেনে দুটি রাজনৈতিক ধারা প্রবল। একটি ধারা পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে চায়। তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) যোগদানের পাশাপাশি পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য হতে আগ্রহী। অপর ধারাটি রুশপন্থী। তারা রাশিয়ার বলয়ে থাকতে চায়।ইউক্রেনের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ রুশভাষী। তারা জাতিগতভাবেও রুশ। রাশিয়ার সঙ্গে তাদের সাংস্কৃতিক-সামাজিক ঘনিষ্ঠতা আছে।
বিক্ষোভের মুখে ২০১৪ সালে ইউক্রেনের রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের পতন হয়। তিনি দেশ ছেড়ে পালান।ইয়ানুকোভিচ ইইউর সঙ্গে বড় ধরনের বাণিজ্য চুক্তি করতে চেয়েছিলেন। তখন পুতিন চাপ বাড়ান। চাপে পড়ে ইয়ানুকোভিচ ইইউর সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা থেকে বেরিয়ে আসেন। ফলে ইউক্রেনে তাঁর বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ শুরু হয়।ইয়ানুকোভিচের পরে যাঁরা ইউক্রেনের ক্ষমতায় আসেন, তাঁরা ইইউপন্থী বলে পরিচিত। তাঁদের নানা পদক্ষেপে পুতিন ক্ষুব্ধ হন।ইয়ানুকোভিচের পতনের পর পূর্ব ইউক্রেনের ক্রিমিয়া অঞ্চল দখল করে নেয় রাশিয়া।
কেন ক্রিমিয়া দখল
প্রায় ২০০ বছর ধরে রাশিয়ার অংশ ছিল ক্রিমিয়া। ১৯৫৪ সালে সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ তৎকালীন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র ইউক্রেনের কাছে ক্রিমিয়া হস্তান্তর করেন। তখন রুশ নেতৃত্ব ভাবতে পারেনি যে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হবে।ক্রিমিয়ার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক। কৌশলগত কারণে রাশিয়ার কাছে ক্রিমিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই সুযোগ পেয়ে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া দখল করে নেয় রাশিয়া।
রাশিয়ার দাবি কী
পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য নয় ইউক্রেন। তবে দেশটির ন্যাটোর সদস্য হতে চায়। এই বিষয়টি মানতে নারাজ রাশিয়া। এ কারণে রাশিয়া পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে এমন নিশ্চয়তা চায় যে ইউক্রেনকে কখনো ন্যাটোর সদস্য করা হবে না।রাশিয়ার চাওয়া অনুযায়ী, এ ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা দিতে রাজি নয় পশ্চিমা দেশগুলো।পুতিন মনে করেন, রাশিয়াকে চারদিক থেকে ঘিরে পশ্চিমা দেশগুলো ন্যাটোকে ব্যবহার করছে। ইউক্রেনকেও এই উদ্দেশ্যে ন্যাটোতে নেওয়া হতে পারে। এ কারণে পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর সম্প্রসারণের বিরোধিতা করছেন তিনি।রাশিয়ার অভিযোগ, গত শতকের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোকে পূর্ব দিকে সম্প্রসারণ করা হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতি রাখা হয়নি।
রাশিয়ার অভিযোগ প্রত্যাখ্যানের পাশাপাশি ইউক্রেনকে ন্যাটো জোটে অন্তর্ভুক্ত না করার যে দাবি মস্কো জানাচ্ছে, তা নাকচ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।অন্যদিকে ন্যাটো বলছে, এটি একটি আত্মরক্ষামূলক সামরিক জোট। প্রত্যেক দেশের প্রতিরক্ষার পথ বেছে নেওয়ার অধিকার আছে। ন্যাটোর আশঙ্কা, ইউক্রেনে হামলা চালাতে চায় রাশিয়া।
রাশিয়া কেন উদ্বিগ্ন
১৯৯০-এর দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়। এই ভাঙনকে রাশিয়ার জন্য একটি ভূরাজনৈতিক বিপর্যয় বলে মনে করেন পুতিন। তারপর থেকে রাশিয়া দেখছে, সামরিক জোট ন্যাটো ধীরে ধীরে তাদের ঘিরে ফেলছে। সংগত কারণেই রাশিয়া তার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন।১৯৯৯ সালে চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ড ন্যাটোতে যোগ দেয়। ২০০৪ সালে যোগ দেয় বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া, লাতভিয়া, লিথুয়েনিয়া, রোমানিয়া ও স্লোভাকিয়া। ২০০৯ সালে যোগ দেয় আলবেনিয়া।
জর্জিয়া, মলদোভা বা ইউক্রেনেরও ন্যাটোতে যোগ দেওয়া আকাঙ্ক্ষা আছে। কিন্তু রাশিয়ার কারণে এখন পর্যন্ত তা হয়ে ওঠেনি। তবে এই তিন দেশে রুশপন্থী বিদ্রোহী আছে। এই দেশগুলোর কোনোটি যদি ন্যাটোতে যোগ দেয়, তবে তা রাশিয়ার জন্য মেনে নেওয়া কঠিন হবে। এমনকি তা যুদ্ধের অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে।
রাশিয়ার গ্যাস কেন বড় ইস্যু
সমরাস্ত্রের ছাড়াও রাশিয়ার একটি বড় হাতিয়ার তার জ্বালানি। ইউরোপের মোট তেল-গ্যাস সরবরাহের ২৫ শতাংশ যায় রাশিয়া থেকে।ইউরোপে গ্যাস সরবরাহে রাশিয়ার প্রবেশদ্বার ইউক্রেন। রাশিয়া থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রধান গ্যাস পাইপলাইনগুলো ইউক্রেনের ভেতর দিয়ে গেছে।ফলে ইউক্রেন যদি রাশিয়ার প্রভাববলয়ের বাইরে চলে যায়, তাহলে গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে রাশিয়া তার একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে।
রাশিয়া কি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে
ইউক্রেন সীমান্তে লাখো সেনার সমাবেশ ঘটিয়েছে রাশিয়া। মস্কো বলছে, সামরিক মহড়ার অংশ হিসেবে এই সেনা সমাবেশ ঘটানো হয়েছে।তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা রাশিয়ার দাবি মানতে নারাজ। তারা বলছে, ইউক্রেনে হামলার পরিকল্পনা করছে রাশিয়া। যেকোনো সময় এই হামলা শুরু হয়ে যেতে পারে। কারণ, ইউক্রেনে হামলা চালানোর সব প্রস্তুতিই রাশিয়ার আছে।
রাশিয়া বলে আসছে, এমন কোনো পরিকল্পনা মস্কোর নেই।২১ ফেব্রুয়ারি পুতিনের নেওয়া পদক্ষেপের পর পশ্চিমারা বলছে, রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসন শুরু করে দিয়েছে। এখন তারা ইউক্রেনে একটি পূর্ণ যুদ্ধ শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছে।ন্যাটো মনে করেন, ইউক্রেন নিয়ে একটি সংঘাতের বাস্তবিক আশঙ্কা আছে।মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বিশ্বাস করেন, রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাবে।
ন্যাটো কি ঐক্যবদ্ধ
প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছেন, ইউক্রেন প্রশ্ন পশ্চিমা নেতারা ঐক্যবদ্ধ। তবে ইউক্রেনের ব্যাপারে বিভিন্ন দেশের সমর্থনে পার্থক্য দেখা যাচ্ছে।যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে মারণঘাতী সামরিক সরঞ্জাম পাঠিয়েছে। যুক্তরাজ্য স্বল্পমাত্রার ট্যাংক-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র দিচ্ছে।ডেনমার্ক, স্পেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডসের মতো ন্যাটো দেশ পূর্ব ইউরোপে প্রতিরক্ষা জোরালো করছে।তবে ইউক্রেনের অনুরোধ সত্ত্বেও দেশটিকে কোনো অস্ত্র দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে জার্মানি।ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁকে উত্তেজনা প্রশমনে জোর তৎপরতা চালাতে দেখা গেছে।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা
পুতিনের ২১ ফেব্রুয়ারির পদক্ষেপের জেরে রাশিয়ার ওপর স্মরণকালের সবচেয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো।যুক্তরাজ্য ইতিমধ্যে রাশিয়ার পাঁচটি ব্যাংক ও পুতিন-ঘনিষ্ঠ তিন ধনকুবেরের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।ইউরোপীয় ইউনিয়নও কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন প্রথম দফার নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দিয়েছেন। রাশিয়ার বড় দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও রাশিয়ান সোভেরিন ডেবটের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া রাশিয়ার ধনকুবের, তাঁদের পরিবারের সদস্য ও রুশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
অন্যদিকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে কানাডা ও জাপান।