ঘুম থেকে উঠে মায়ের কাছে শরবত চেয়েছিল পাঁচ বছরের নাদিয়া আক্তার। কিন্তু কাজে যাওয়ার সময় হয়ে যাওয়ায় মেয়েকে তা করে দিতে পারেননি মা মদিনা আক্তার (২৫)। আজ সোমবার বিকেলে মেয়ের শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে না পারার আক্ষেপের কথা বিলাপ করতে করতে বলছিলেন আর বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন তিনি।গতকাল রোববার রাতে ময়মনসিংহের ভালুকা সিডস্টোর বাজার এলাকায় সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে লাগা আগুনে মদিনা আক্তার-স্বপন মিয়া দম্পতির তিন সন্তানের মৃত্যু হয়। তারা হলো দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া সাদিয়া আক্তার (৯), নাদিয়া আক্তার (৫) ও রায়হান মিয়া (২)মদিনার পাশে বসে তাঁর স্বামী স্বপন মিয়া হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকেন, ‘আল্লাহ, এই কষ্ট কেন দিলা, কেন নিলা না আমার! আমি কিবায় এই দুনিয়াত থাকবাম! আমার লাগ্গাই এরা মরল। খোদা, আমারে মরণ দাও।’ এ সময় তাঁদের পাশে থাকা লোকজনের চোখও আর্দ্র হয়ে ওঠে। সন্তান হারানো বাবা-মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন তাঁদের কেউ কেউ।আজ বিকেলে নেত্রকোনার কলমাকান্দার সুনই গ্রামে স্বপন মিয়ার বাড়িতে গিয়ে এমন হৃদয়বিদারক দৃশ্যের দেখা মেলে।
স্বপন মিয়া ভালুকা সিডস্টোর বাজার এলাকায় একটি বাসায় পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকেন। তিনি সড়কের নির্মাণশ্রমিকের কাজ করেন। তাঁর স্ত্রী ভালুকা মাস্টারবাড়ী এলাকায় তেপান্তর গার্মেন্টস নামে একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। তিন মাস আগে ১ হাজার ৬০০ টাকা দিয়ে বাসাটি ভাড়া নেন এই দম্পতি।
স্বপন মিয়া বলেন, গতকাল রাত ৯টার দিকে তিন সন্তানকে ঘরে ঘুম পাড়িয়ে রেখে পাশের দোকান থেকে ডিম আনার উদ্দেশে বের হন। এ সময় তিনি বাইরে থেকে দরজার শিকল বন্ধ করে যান। তাঁর স্ত্রী মদিনা আক্তার তখন পোশাক কারখানায় ছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই টিনের ওই ঘরটিতে থাকা সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আগুন লাগে। আগুন ছড়িয়ে পড়লে স্বপনের ঘরসহ আরও ছয়টি ঘর পুড়ে যায়। ওই অবস্থায় তাঁদের তিন সন্তানের আগুনে পুড়ে মৃত্যু হয়।তিনি বলেন, তাঁদের ইচ্ছা ছিল তিন সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করবেন। তখন আর সংসারের অভাব থাকবে না। কিন্তু এক বিস্ফোরণে সব স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে তাঁদের।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্বপন মিয়ার বড় বোন চম্পা আক্তারের স্বামী মতি মিয়া বলেন, ‘স্বপনের বাসা থেকে আমার বাসা ৩০ সেকেন্ডের পথ। আগুন দেখে দৌড়ে গিয়ে স্বপনের ঘরের দরজা খুলি। কিন্তু খাটের ওপর শিশুদের না দেখে আগুনের তাপে বাইরে বেরিয়ে আসি। পরে ফায়ার সর্ভিসের কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনলে ঘরে ঢুকে দেখি, সিলিন্ডারের কাছে ওরা তিনজন পুড়ে অঙ্গার হয়ে আছে। আমি তখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।’আজ সকালে ওই তিন শিশুর মরদেহ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে এলে সন্তানহারা বাবা-মায়ের বিলাপে এলাকা ভারী হয়ে ওঠে।আহাজারি করতে থাকা স্বপন মিয়ার বৃদ্ধ বাবা শামছু মিয়া বলেন, ‘তিনডা ফুল এইবায় নিব্বা গেছে। অহন আমার স্বপন আর অর বউ কী নিয়া বাঁচব!’
স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় ১০ বছর আগে বারহাট্টা উপজেলার শেকেরপাড়া এলাকার মৃত সাজল মিয়ার মেয়ে মদিনা আক্তারকে বিয়ে করেন স্বপন মিয়া। মদিনা ছয় বছর বয়সে মাকে হারান। এর কয়েক বছর পর তাঁর বাবার মৃত্যু হয়। ছোট থেকেই অভাবের সংসারে বেড়ে ওঠা মদিনা দিনমজুর স্বামীকে নিয়ে কাজের উদ্দেশ্যে গত তিন মাস আগে ভালুকায় আসেন।স্বপন মিয়ার প্রতিবেশী পোগলা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, হতদরিদ্র স্বপন মিয়ার দেড় শতক ঘরের জায়গাটি ছাড়া সহয়–সম্বল বলতে আর কিছুই নেই। তাঁর থাকার ঘরটিও ভাঙা। জীবিকার তাগিদে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ভালুকায় গিয়েছিলেন। কিন্তু সিলিন্ডারের আগুনে সব শেষ হয়ে গেল ওঁদের।