গুলশানের ২৭ নম্বর বাড়িটা আসলে একটা কফি শপ, নাম চেরিবিন। সেখানেই রঙিন জামাকাপড় পরে এসেছে সবাই। নারীদের বেশির ভাগেরই পরনে শাড়ি। থাকবে নাই-বা কেন, শাড়িকে ঘিরেই যে আয়োজন। পয়লা ফাল্গুন, ভালোবাসা দিবস সামনে রেখে শাড়ি নিয়ে আড্ডা দিতেই এই উদ্যোগ। এখানে-সেখানে জড়ো হয়ে আমন্ত্রিত অতিথিরা ধোঁয়া ওঠা কফির মগ হাতে আড্ডা দিচ্ছেন।
এই আয়োজনের আহ্বায়ক শাফিয়া শামা। শামা একজন নারী উদ্যোক্তা, ‘উড়ান’ নিয়ে পথ চলছেন বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল। হোঁচট খেয়েছেন, উঠে দাঁড়িয়েছেন, আবার পথ চলেছেন। শুরুটা সহজ ছিল না। কিছু মানুষের অনুপ্রেরণা যেমন ছিল, তেমনি ছিল কাছের মানুষদের টিটকিরি, অবিশ্বাস আর অসহযোগিতা। সাবেক স্বামীই তো বলেছিলেন, ‘তুমি ব্যবসা করে মাসে যে টাকা আয় করবে, তা দিয়ে আমার সিগারেটের দামই হবে না। এইগুলো বাদ দাও।’ তাঁর কথা না শুনে নিজের মনের কথা শুনেছেন শামা। তিলে তিলে দাঁড় করিয়েছেন উড়ানকে। সেই উড়ানের পক্ষ থেকেই গতকাল সন্ধ্যায় ছিল এই আয়োজন। সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন খ্যাতনামা ডিজাইনার বিবি রাসেল।
গায়ে সাড়ে তিন শ টাকার একটি শাড়ি পেঁচিয়ে এসেছিলেন বিবি রাসেল। সগর্বে সে কথা জানিয়ে বললেন, ‘আপনারা আমাকে আজ যে শাড়িতে দেখছেন, এর দাম সাড়ে তিন শ টাকা। দামাদামি করে আরেকটু কমেও কিনতে পাওয়া যাবে। আমি বিশ্বের যে প্রান্তেই যাই না কেন, সরকারি, বেসরকারি যত বড় আয়োজনেই যাই না কেন, আমাদের দেশের তাঁতিদের তৈরি এ রকম শাড়ি পরেই যাই।
এভাবেই আমি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করি। এই তাঁতের শাড়ি, গামছাই আমার কাছে ইতিবাচক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। কত টাকার শাড়ি, তাতে কিছু আসে-যায় না। রুচি আর স্টাইলই সব।’ এই ডিজাইনার বিশ্বাস করেন, নারীর জন্য শাড়ির চেয়ে সুন্দর পোশাক আর হয় না।ইউএনডিপির কান্ট্রি ইকোনমিস্ট নাজনীন আহমেদ জানান, তাঁর আলমারির শতকরা ৭৫ ভাগ পোশাকই ‘মেড ইন বাংলাদেশ’। দেশি পোশাকেই সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন তিনি। অন্যদেরও বেশি বেশি দেশি পণ্য কিনতে অনুরোধ করেন তিনি।
শিমুল মুস্তফার কথায় ঝরে পড়ল খানিকটা আক্ষেপ। এই আবৃত্তিকার বলেন, ‘গত কয়েক বছরে দেশে অনেক অডিটরিয়াম হয়েছে, তবে কিছুই জনগণের জন্য হয়নি। হাতে গোনা কিছু মানুষের জন্য হয়েছে। সেসব অডিটরিয়ামে লুঙ্গি পরে ঢোকা যায় না। নৃত্যের জন্য টাকা পাওয়া যায় না; কিন্তু “ড্যান্সে”র জন্য স্পনসরের অভাব হয় না।’ শাড়ির চেয়ে সুন্দর পোশাক যে আর হয় না, এ কথার সঙ্গে তিনিও একমত।
শাড়ি, নারী, শিল্প-সংস্কৃতি আর কেনাকাটা নিয়ে এই আলোচনায় উপস্থিতদের অনেকেই স্বপ্রণোদিত হয়ে অংশ নিলেন। এরপর আবার নাশতা হাতে এখানে-সেখানে জড়ো হয়ে চলে গ্রুপ আড্ডা। অনেকেই পাশের কাচঘেরা ঘরে গিয়ে দেখলেন শামার ডিজাইন করা শাড়ি, কামিজ, উত্তরীয়। শাড়ির আঁচলে রয়েছে ‘কে যাস রে ভাটি গাঙ বাইয়া’, ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই’, ‘নিশিতে যাইও ফুলবনে রে ভ্রমরা’, ‘বর্ণে, গন্ধে ছন্দে গীতিতে’, ‘শোনো গো দখিন হাওয়া’, ‘নিটোল পায়ে রিনিক ঝিনিক’সহ অনেক জনপ্রিয় গানের চরণ।
শাড়ি নিয়ে প্রাণবন্ত এই আড্ডা চলেছিল রাত ৮টা পর্যন্ত।