গুচ্ছভুক্ত ২০ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ মাসেও প্রথম বর্ষের ভর্তিপ্রক্রিয়া শেষ হয়নি। সাতবার ভর্তি বিজ্ঞপ্তি দিয়েও আসন পূর্ণ করতে পারেনি একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়। এর জন্য গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তির ক্ষেত্রে কিছু দুর্বলতাকে চিহ্নিত করেছে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষ।বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে ভোগান্তি ও খরচ কমাতে দীর্ঘদিনের দাবির পর গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি নিতে সম্মত হয় ২০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়।এতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা। এবারই (গত বছরের ১ এপ্রিল) প্রথম জিএসটি (জেনারেল, সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি) গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তির আবেদন শুরু হয়। গত অক্টোবরের শেষ থেকে পরীক্ষা শুরু করে ৪ নভেম্বরের মধ্যে ফলাফল ঘোষণা করা হয়। এখনো বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির কাজ শেষ করতে পারেনি।গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অন্যতম রাজধানীর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার্থীদের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগ্রহ থাকে। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয় সাতবার মেধাতালিকা প্রকাশ করেও আসন পূর্ণ করতে পারেনি। সম্প্রতি তারা অষ্টমবারের মতো ভর্তির মেধাতালিকা প্রকাশ করেছে।জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে আসনসংখ্যা দুই হাজার ৭৬৫টি। সপ্তম মেধাতালিকা প্রকাশের পরও বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্য বিভাগে ৫৪৩টি আসন ফাঁকা রয়ে গেছে। লোকপ্রশাসন বিষয়ে ৮০টি আসনের বিপরীতে সাতবার মেধাতালিকা প্রকাশ করে ৫৯ জন শিক্ষার্থী পাওয়া গেছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ইমদাদুল হক বলেন, ‘প্রথমবারের মতো গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। এতে আমাদের কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। তবে এবারের ভর্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামীতে ভুলত্রুটিগুলো সংশোধন করব। ’ তিনি আরো বলেন, শিক্ষার্থী ভর্তিতে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কিছু মানদণ্ড থাকে। সেগুলো পূরণ না হওয়ায় প্রয়োজনীয় শিক্ষার্থী পেতে সমস্যা হচ্ছে।কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা আরো খারাপ। সেখানে প্রথম বর্ষে আসনসংখ্যা দুই হাজার ৯৫টি। তারা তৃতীয় মেধাতালিকা প্রকাশের পর মাত্র ৮২৫টি আসনে শিক্ষার্থী ভর্তি করতে পেরেছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির ‘এ’ ইউনিটে ৫৫০ আসনের মধ্যে ভর্তি হয়েছে ২৭৬ জন, ‘বি’ ইউনিটে এক হাজার ৯৫ আসনের মধ্যে ভর্তি হয়েছে ৩৪৯ জন এবং ‘সি’ ইউনিটে ৪৫০ আসনের মধ্যে ভর্তি হয়েছে ২০০ জন।‘বি’ ইউনিটের (মানবিক বিভাগ) সমন্বয়কারী অধ্যাপক দেবাশীষ শর্মা বলেন, ‘তিনবার মেধাতালিকা প্রকাশের পরও আমরা আশানুরূপ শিক্ষার্থী পাচ্ছি না। সামনে গুচ্ছ ভর্তি কমিটির বৈঠক রয়েছে। বৈঠকে ঠিক হবে চতুর্থ মেধাতালিকা প্রকাশ করব, না অন্য কোনো প্রক্রিয়ায় যাব। ’
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তিপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকরা বলছেন, মূলত তিন কারণে গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তিতে এই অবস্থা তৈরি হয়েছে। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জিপিএতে ছাড় দিচ্ছে না। সবাই পরীক্ষায় বেশি স্কোর করা শিক্ষার্থীদের ভর্তি করাতে চাচ্ছে। অথচ এসব শিক্ষার্থীর বেশির ভাগ গুচ্ছের বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হয়ে গেছেন। বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় ন্যূনতম ৮ জিপিএ চেয়ে বিজ্ঞপ্তি দেয়। এতে কিছু শিক্ষার্থী ঘুরেফিরে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পান। ফলে তাঁরা আর গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছেন না। মেধাবী শিক্ষার্থীদের প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আগ্রহ বেশি থাকায় তারা জিপিএ কমাচ্ছে না। জিপিএ কম থাকা শিক্ষার্থীদের ভর্তির জন্য ডাকাও হচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে পাওয়া যাচ্ছে না প্রয়োজনীয়সংখ্যক শিক্ষার্থী। দ্বিতীয়ত, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অনেক আগেই ভর্তি শেষ করে ক্লাস শুরু করে দেওয়ায় যেসব শিক্ষার্থী আগে বড় কলেজে ভর্তি হয়ে গেছেন, তাঁরাও এখন আর গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে চাইছেন না। তৃতীয়ত, অনেক শিক্ষার্থী গুচ্ছের পরীক্ষা দেওয়ার পরই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গেছেন। তাঁরাও এক বছর পর আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আগ্রহী নন। ফলে চলতি শিক্ষাবর্ষে অনেক আসন ফাঁকা রেখেই ভর্তি কার্যক্রম শেষ করতে হবে গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে।
২০২০ সালে এই শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনার কারণে এইচএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে যাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষাও পিছিয়ে যায়। তার পরও আশা ছিল, ভর্তিপ্রক্রিয়া শেষে ২০২১ সালের শেষ প্রান্তে এসব শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু করতে পারবেন। তাতে তাঁরা এক বছর সেশনজটে পড়তেন। কিন্তু ২০২২ সালে এসেও ভর্তি শেষ করা যাচ্ছে না গুচ্ছভুক্ত বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেশে বর্তমানে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৫০টি। এর মধ্যে সাতটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ও আলাদা গুচ্ছ করে ভর্তিপ্রক্রিয়া শেষ করে এনেছে। বাকি ২৩ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে নতুন চারটি শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেনি। ১৯ বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের মতো করে ভর্তির কার্যক্রম শেষ করেছে।গুচ্ছভুক্ত ২০ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাথমিকভাবে তিন লাখ ৬১ হাজার ৪০১ জন আবেদন করলেও যাচাই-বাছাই শেষে দুই লাখ ৩২ হাজার ৪৫৫ জন ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ পান। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন আছে ২২ হাজার ১৩টি।গুচ্ছ ভর্তিতে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমলেও বেড়েছে জটিলতা। কারণ একজন শিক্ষার্থীকে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার পরও পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগে আলাদাভাবে অনলাইনে আবেদন করতে হচ্ছে।
এ কারণে গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে একজন শিক্ষার্থীকে ৩০ থেকে ৪০টি আবেদন করতে হচ্ছে। এতে খরচ হচ্ছে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। সব বিভাগ আলাদা করে ফি নেওয়ায় এই খরচ হচ্ছে।
মুনতাসিন মুন্নী নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমি জগন্নাথে সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু যেদিন এসএমএস পেয়েছি তার পরের দিনই ভর্তি। গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করায় সঠিক সময়ে উপস্থিত হতে না পেরে ভর্তি হতে পারিনি। এখন পরবর্তী মেধাতালিকার জন্য অপেক্ষা করছি। ’গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিসংক্রান্ত টেকনিক্যাল সাবকমিটির আহ্বায়ক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য প্রফেসর মুনাজ আহমেদ নূর বলেন, ‘আমরা কেন্দ্রীয়ভাবে পরীক্ষা নিয়েছি। আর ভর্তিটাও কেন্দ্রীয়ভাবে করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা হয়নি। ফলে আমাদের কত আসন ফাঁকা আছে বা কী পদক্ষেপ নিতে হবে, সেটা জানতে পারছি না। আগামীতে কেন্দ্রীয়ভাবে পরীক্ষার পাশাপাশি ভর্তিও কেন্দ্রীয়ভাবে করা গেলে এই প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়া সহজ হবে। ’