বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকাজ বন্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্রে বিএনপির লবিস্ট নিয়োগের সব তথ্য-প্রমাণ সরকারের হাতে এসেছে। এই লবিস্ট নিয়োগে বিএনপি ৩২ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। বিপুল পরিমাণ এ অর্থ কীভাবে লবিস্ট ফার্মকে দেওয়া হলো সেটি নিয়ে সরকারের ভেতরে ও বাইরে প্রশ্ন উঠেছে। এর সঙ্গে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগও এসেছে বিএনপির বিরুদ্ধে। এটি তদন্তে সরকার হার্ডলাইনে। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি দ্রুত তদন্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং আওয়ামী লীগের মন্ত্রী এবং নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
এদিকে বিএনপি তথা একটি রাজনৈতিক দলের লবিস্ট নিয়োগকে খুব অনৈতিক হিসেবে না দেখলেও লবিস্ট নিয়োগের এ বিপুল পরিমাণ অর্থ লেনদেনের বৈধতা এবং লবিস্ট নিয়োগের মাধ্যমে দলটি রাষ্ট্রবিরোধী বা রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী কোনো কাজ করেছে কি না সে বিষয়ে তদন্ত চেয়েছেন কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
তারা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে কোনো রাজনৈতিক দলের বা প্রতিষ্ঠানের লবিস্ট নিয়োগের বিষয়ে আমাদের দেশে সুস্পষ্ট আইনি নির্দেশনা নেই। সেই অর্থে বিএনপি লবিস্ট নিয়োগ করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন দেশের লবিস্ট নিয়োগের বিষয়ে আইনি বৈধতা রয়েছে, লবিস্ট নিয়োগে তাদের (বিএনপির) দলীয় স্বার্থ থাকতে পারে। বিএনপির জন্য এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তারা লবিস্ট নিয়োগের খরচ কীভাবে করেছে। আর দেশবিরোধী বিষয়টিও এখানে বিএনপির রাজনীতির জন্য ইতিবাচক হবে না। বিএনপির উচিত কী প্রক্রিয়ায় কত টাকা তারা লবিস্ট নিয়োগে ব্যয় করেছে সেটি প্রকাশ করা। যদি এটা অবৈধ প্রক্রিয়ায় হয় তাহলে মানি লন্ডারিংয়ের ঝুঁকিতে পড়বে।
আবার কেউ কেউ বলছেন, সম্প্রতি র্যাব এবং এর সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পরই এ লবিস্ট নিয়োগ বিতর্ক শুরু হয়েছে। এ নিষেধাজ্ঞার জন্য বিএনপি-জামায়াতের লবিস্ট নিয়োগ করে অপপ্রচারকে দায়ী করতে চায় সরকার। তবে তারা এও বলেন, রাজনৈতিক স্বার্থে বিএনপি আওয়ামী লীগ তথা আওয়ামী লীগ সরকারের বিষয় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রচার-প্রপাগান্ডা চালাতে পারে। কারণ এটা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি অংশ। এর মাধ্যমে বিএনপি-আওয়ামী লীগসহ দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বই প্রকাশিত হয়। জাতীয় নির্বাচন ঘিরে বিদেশমুখিতা অনেক দিন ধরেই চলে আসছে। তবে রাষ্ট্রবিরোধী বিষয় হলে অবশ্যই সরকারকে জনগণের সামনে বিষয়টি উপস্থাপন করতে হবে। আর আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি আইনের আওতায় আনতে হবে।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম গতকাল শুক্রবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের হাতে সব তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। বিএনপির যুক্তরাষ্ট্রের তিন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির কপি এবং কত টাকা ব্যয় হয়েছেÑ সবসহ নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হয়েছে। কারণ রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচন কমিশনে আয়-ব্যয়ের হিসাব দাখিল করতে হয়। বিএনপি নির্বাচন কমিশনে এ অর্থের হিসাব দাখিল করেছে কি না, কমিশনকে খতিয়ে দেখতে অনুরোধ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছেও চিঠি পাঠানো হয়েছে। বিএনপি চুক্তির জন্য বিদেশে যে অর্থ পাঠিয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো অনুমোদন রয়েছে কি না, যাচাই করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার ছাড়া আর কারোর বৈধভাবে লবিস্ট নিয়োগের কোনো বিধান বাংলাদেশের আইনে লেখা নেই। ফলে এ বিষয়ে আমার স্পষ্ট ধারণা নেই। তবে যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট ফার্ম নিয়োগের আইন রয়েছে। সরকারগুলো দেশের স্বার্থে লবিস্ট নিয়োগ দিতে পারে। ফলে আর্থিক লেনদেনেও সরকারের স্বচ্ছতা থাকে। বাংলাদেশ সরকারও লবিস্ট নিয়োগ দিতে পারে। আর বিএনপির লবিস্ট নিয়োগের চেয়ে তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হলো তারা কীভাবে টাকা দিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে যেহেতু বিষয়টি আলোচনায় এসেছে তাহলে বিএনপির উচিত রাজনৈতিক স্বার্থে হলেও বিষয়টি স্পষ্ট করা। আর যদি বিএনপি না করে তবে সরকারের বিষয়টি তদন্ত করে সবার সামনে উপস্থাপন করা উচিত। রাষ্ট্রবিরোধী কোনো অপপ্রচারে বিএনপি লবিস্ট নিয়োগ করলে তার বৈধতা বা স্বচ্ছতা প্রকাশ করা সরকারের দায়িত্ব বলে আমি মনে করি।’ তিনি আরও বলেন, ‘কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আইনে সেখানে লবিস্ট নিয়োগ করা যায় না।’
সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক বলেন, ‘লবিস্ট নিয়োগ নিয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের আইনেই রয়েছে। কূটনৈতিক সম্পর্ক, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং রাজনৈতিক ইস্যুতে সে দেশে লবিস্ট নিয়োগ হয়। এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব দুই-ই থাকে। রাষ্ট্র যেমন লবিস্ট নিয়োগ করে তেমনি রাজনৈতিক দল, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি যার যার কাজ অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করে।’
গত ১৭ জানুয়ারি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম প্রথম বিএনপির এ লবিস্ট নিয়োগের বিষয়টি সংসদে তোলেন। তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াত বিদেশি লবিস্ট নিয়োগে আটটি চুক্তি করেছে। এর মধ্যে তিনটি করেছে বিএনপি। এ তিন চুক্তিতে বিএনপি ৩.৭৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। বিএনপি অফিসের ঠিকানাও চুক্তির কপিতে উল্লেখ করা হয়েছে। জামায়াতের চুক্তির কপিতে প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা দেওয়া নেই। তবে চুক্তির কপিতে তাদের নাম রয়েছে। প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন লবিস্ট ফার্মের সঙ্গে তারা চুক্তি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের আইনে এসব চুক্তির অনুমোদন রয়েছে।
এরপর সংসদে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। এ সময় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও সরকারদলীয় এমপিরা এ লবিস্ট নিয়োগ ইস্যু এবং র্যাবের নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি দাবি করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন দুটি ইস্যুতেই বিবৃতি দেন। এরপর সংসদে বিষয়টি নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়।
গত বুধবার সংসদে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিবৃতিতে জানান, যুক্তরাষ্ট্রে বিএনপি-জামায়াত আটটি লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করেছে। কত টাকা ব্যয় করা হয়েছে সেই তথ্যও সংসদে দিয়েছেন তিনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘২০১৪ সালে জামায়াত একটি ফার্ম নিয়োগ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করার জন্য। এজন্য তারা দেড় লাখ ডলার দেয়। বিচার বন্ধে তারা আরেকটি লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করেছিল। আর যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে প্রভাবিত করার জন্য পিস অ্যান্ড জাস্টিস নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে ১ লাখ ৩২ হাজার ডলার দিয়ে নিয়োগ করে।’
বিএনপির বিদেশি লবির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বিএনপি ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ২৭ লাখ ডলার প্রতি বছর আর প্রতি মাসে রিটেইনার ফি ১ লাখ ২০ হাজার ডলার ব্যয় করেছে। এ তথ্যগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে।’
ড. মোমেন আরও বলেন, ‘বিএনপি ২০১৭ সাল পর্যন্ত চারটি এবং ২০১৯ সালে একটি লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করে। এছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে জামায়াত-বিএনপি তিনটি লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করে। যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ সে দেশের আইনে বৈধ প্রক্রিয়া। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এবং প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কোন্নয়নে লবিস্ট নিয়োগ দিয়ে থাকে। কিন্তু লবিস্ট নিয়োগের উদ্দেশ্য কী সেটি হলো মুখ্য বিষয়।’
গত বৃহস্পতিবার সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাবের ওপর আলোচনা এবং একাদশ সংসদের ১৬তম অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন। তিনিও বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচারের অভিযোগ তোলেন এবং সংসদকে জানান, তার সরকার এর দ্রুত তদন্ত করবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশকে ধ্বংস এবং মিথ্যা অপবাদ আর অসত্য তথ্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য তারা লবিস্ট নিয়োগ করেছে। বিদেশি ফার্মকে এই কোটি কোটি ডলার তারা পেমেন্ট করল, এই অর্থ কীভাবে বিদেশে গেল? এটা কোথা থেকে এলো তার জবাব তাদের দিতে হবে। এর ব্যাখ্যা তাদের দিতে হবে।
সংসদে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যের পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমি স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, আমরা যা কিছু করি দেশকে রক্ষার জন্য করি, দুর্বৃত্তদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য করি।’ তিনি সরাসরি লবিস্ট নিয়োগের বিষয়টি স্বীকার করেননি, আবার অস্বীকারও করেননি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতির পর বিএনপির পক্ষ থেকে আর কোনো মন্তব্য করা হয়নি।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রাজ্জাক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘একটা হলো সরকার দেশের জন্য করা, আরেকটা হলো বিএনপি যেটা করছে। তারা লবিস্ট নিয়োগ করছে সেটা দেশের বিরুদ্ধে, সরকারের বিরুদ্ধে। এটা অনেকটা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। তারা তো এটা করতে পারে না। বিএনপি দেশের মানুষের সঙ্গে বেইমানি করছে। দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে।’
প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় গতকাল তার ভেরিফাইড ফেইসবুক পেজে ‘বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্রের রাজনীতি’ শিরোনামে একটি পোস্টে লিখেছেন, বাংলাদেশে আসা উন্নয়ন সহায়তা আটকে দিতে যুক্তরাষ্ট্রে আটটি লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করেছে বিএনপি-জামায়াত জোট। তারা আগেও একই কাজ করেছে। যেমন : ২০১৩ সালে তৈরি পোশাক খাতের জিএসপি সুবিধা আটকে দিতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের হস্তক্ষেপ চেয়ে ওয়াশিংটন পোস্টে নিবন্ধ লিখেছিলেন বেগম জিয়া। বাংলাদেশকে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন উন্নয়ন সহায়তা আটকে দিতে ২০১৫ সাল থেকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ধারাবাহিকভাবে দেশটির নীতিনির্ধারক ও রাজনীতিবিদদের চিঠি লিখেছেন।
এই পোস্টের সঙ্গে একটি ভিডিও শেয়ার করে জয় লিখেছেন, ‘আরও জানতে দয়া করে ভিডিওটি দেখুন এবং মন্তব্য করুন।’
এ বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও কূটনৈতিক বিশ্লেষক ওয়ালী উর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিএনপি যে বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করে এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কাজ করে তার বড় প্রমাণ পাবেন ২০১৩ সালে ওয়াশিংটন টাইমসে বেগম খালেদা জিয়ার প্রকাশিত কলাম। সেই কলামে বেগম জিয়া রোহিঙ্গাদের আর্থিক সহায়তাসহ অনেক সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলেন। এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কী লাগে।’