সংগীতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনেক শিল্পীর আত্মজীবনী আমরা দেখতে পাই। তবে এটা এ দেশে অনেকটা দুষ্প্রাপ্য বলা চলে। যদিও শিল্পীদের জীবনীগ্রন্থ অপ্রতুল নয়। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখতে পাই মাকুসুদুল হকের বাংলাদেশের রকগাথা: আজম খানের উত্তরাধিকার, ওয়াহিদ সুজনের উকিল মুন্সির চিহ্ন ধরে, সুমনকুমার দাশের শাহ আবদুল করিম: জীবন ও গান, রাশেদুল আনামের হাছন রাজা, সাজ্জাদ হোসাইনের অঞ্জনযাত্রা: অঞ্জনদত্তের আত্মকথা ইত্যাদি। কিন্তু আত্মজীবনীর দেখা মেলা ভার।
সংগীতকে সাহিত্য হিসেবে একটু অবহেলাই করা হয় কিন্তু গান তো সাহিত্যের বাইরে নয়—২০১৬ সালেই তো সাহিত্যে নোবেল পেলেন বব ডিলান। সুইডিশ একাডেমি বব ডিলানকে নিয়ে বলেছে, ‘আমেরিকার সংগীত ঐতিহ্যে নতুন কাব্যিক মূর্ছনা সৃষ্টির জন্য ৭৫ বছর বয়সী রক, ফোক, ফোক-রক, আরবান ফোকের এই কিংবদন্তিকে নোবেল পুরস্কারের জন্য বেছে নেওয়া হলো।’
আমাদের দেশেও কি কিংবদন্তি নেই? আছেন, কিন্তু মারা না যাওয়া পর্যন্ত আমরা তাঁদের আমলে নিই না। তাঁদের গান শুনি, কিন্তু গানের জগতে প্রবেশের আগে তাঁরা কী করতেন, কীভাবে এলেন এই জগতে, তা জানতে আগ্রহী পাঠক থাকলেও সেসব প্রকাশ করার জায়গা খুব একটা হয় না। অনেক শিল্পী নিজেরাও বিষয়টি ভাবেন না। সেদিক থেকে ব্যতিক্রম সৈয়দ আব্দুল হাদী। জীবনকে দেখার চোখ তাঁর অনন্য। তাঁকে নিয়ে জানার আগ্রহ সব শ্রোতারই আছে বোধ করি। অনেক দিন ধরেই তিনি আছেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। তবে এবার নিজেই লিখলেন আত্মজীবনী।
এ বছর জানুয়ারি মাসে প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে সৈয়দ আব্দুল হাদীর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ জীবনের গান। সাবলীল গদ্যে এই আত্মজীবনী পড়লে যেকোনো পাঠকই ভাববেন, আত্মজীবনীকার হয়তো বহুদিন ধরেই লেখেন।২০০ পৃষ্ঠার এ বইয়ের প্রথম অংশজুড়ে রয়েছে তাঁর শৈশব। রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন নাটকের পটভূমি, ত্রিপুরার পাহাড়, টিলার কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট শহর আগরতলাতেই সৈয়দ আব্দুল হাদীর বেড়ে ওঠা। মূলত সেখানে ছিল তাঁর নানাবাড়ি। জন্মের পরপরই তাঁর নানির এক পুত্রসন্তানের মৃত্যু হয়। সেই শোক ভোলার জন্যই সৈয়দ আব্দুল হাদীর মা-বাবা তাঁকে নানির কাছে আগরতলাতে রেখে যান।
সৈয়দ আব্দুল হাদী উল্লেখ করেছেন, ৫ বছর আগের স্মৃতি মনে না থাকলেও ৫০ বছর আগের আগরতলার স্মৃতি ঠিকই মনে আছে। ভুলে যাননি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের স্মৃতিও। জাপানি বিমান এলেই সবাই ট্রেঞ্চে ঘাপটি মেরে থাকত। এরপর যখন বিমান চলে যেত, ছোট ছেলেমেয়েরা আনন্দে গেয়ে উঠত, ‘সা রে গা মা পা ধা নি/ বোম ফালাইছে জাপানি/ বোমার ভিতর কেউটে সাপ/ ব্রিটিশ বলে বাপ রে বাপ’। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জনপ্রিয়তার কথাও বলেছেন তিনি। নেতাজির ছবি কে কত দ্রুত আঁকতে পারত, সেই প্রতিযোগিতাও হতো তাদের মধ্যে। শৈশবের এমন আরও অনেক স্মৃতি যেন তাঁর হৃদয়ে গেঁথে রয়েছে ভালোবাসা হয়ে। বিচিত্র সেসব স্মৃতি। সিগারেটের প্যাকেট দিয়ে ডাগ্গি খেলা, বিকেলবেলা কালভার্টের ওপর বসে গাজী মিয়ার বাঁশি শোনা, আরও অনেক স্মৃতি।
গাজী মিয়ার বাঁশি শোনার সময় মাঝে মাঝে রাস্তা দিয়ে দু-একজন ক্যানভাসার গান গাইতে গাইতে যেতেন, সেগুলোও তাঁর এখনো স্পষ্ট মনে আছে। যেমন
‘খাউজ্জানি বড় জ্বালা সজনী, শেষে উঠে পোড়ানি/ রাজবাড়ি গিয়া দেখি/ রাজা খাউজ্জায় রানি খাউজ্জায়/ আরও খাউজ্জায় চাকরানি/ খাউজ্জানি বড় জ্বালা সজনী…’
একটু বড় হলে গানের প্রতি আকর্ষণ বাড়ে তাঁর। ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র রাজা হোসেন খান তখন তাঁদের বাড়ির পাশেই থাকতেন। তিনি প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার সময় বিমোহিত হয়ে শুনতেন সেতার। ভাবলেন সেতার বাজানো শিখবেন। কিন্তু কিছুদিন সেতার বাজানোর পর দেখলেন আঙুলে ফোসকা পড়েছে। পরে তাঁর ওস্তাদ রাজা হোসেন খান তাঁকে সেতার বাজানো বাদ দিয়ে গান গাইতে বলেন। এর পর থেকে সে অঞ্চলের বিভিন্ন ক্লাবে মাঝেমধ্যেই গাইতেন তিনি।
শৈশবে গানের প্রতি যে ভালোবাসার সৃষ্টি হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর সেই ভূত যেন আরও জেঁকে বসে। তাঁর বন্ধুরা যখনই বুঝল সৈয়দ আব্দুল হাদী ভালো গান করেন, তখন থেকেই যেকোনো ছোট-বড় অনুষ্ঠানে তাঁর ডাক পড়া শুরু হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে যোগদান করেন তৎকালীন জগন্নাথ কলেজে। বাংলার প্রভাষক হিসেবে। কিন্তু বেশি দিন সে চাকরি করেননি। রাওয়ালপিন্ডিতে একটি গানের অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য চাকরিতে ইস্তফা দেন।
গানের জন্য এমন চাকরি ছেড়ে দেওয়া সহজ ব্যাপার ছিল না। যদিও তিনি বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে সে সময়ে পড়ালেখা করা লোক কম ছিল বলে যাঁরা পড়ালেখা করেছেন, তাঁদের চাকরির অভাব হতো না। সেই সাহসেই হয়তো তিনি চাকরিটা ছেড়েছিলেন। এমনকি বিদেশে যখন পড়তে গিয়েছিলেন, তখনো সেখানকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাংলা গান গেয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছিলেন।
২০০০ সালে সংগীতে অবদানের জন্য একুশে পদক লাভ করেন। এ ছাড়া শ্রেষ্ঠ গায়ক হিসেবে পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। এ পর্যন্ত তিনি বেতার, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে ১০ হাজারের বেশি গান গেয়েছেন। তাঁর রয়েছে অজস্র একক অ্যালবাম ও মিশ্র অ্যালবাম। সুবল দাশের সহকারী হিসেবে অনেক দিন সহকারী সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন, এমনকি পরিচালক মোস্তফা আনোয়ারের ফেরারি নামে চলচ্চিত্রে একক সংগীত পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি।
সৈয়দ আব্দুল হাদী বইয়ের একদম শেষে লিখেছেন, ‘এই পৃথিবীর, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অপার রহস্য, মানবজীবনের উদ্দেশ্য-বিধেয়—কোনো কিছুরই কি শেষ কথা আছে? বোধ হয় নেই, তাই হ্যামলেটের সেই উক্তিটির কথাই মনে হয়, “লাইফ ইজ আ টেল, টোল্ড বাই অ্যান ইডিয়ট, ফুল অব সাউন্ড অ্যান্ড ফিউরি, সিগনিফাইয়িং নাথিং।”’