দেশে করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের সংক্রমণ ঠেকাতে আবারও নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে সরকার। এর আগে গত আগস্টে সর্বশেষ বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়। এরপর করোনা পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণেই ছিল। কিন্তু ওমিক্রনের কারণে গত চার সপ্তাহ ধরে সংক্রমণ ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করেছে এবং চলতি সপ্তাহে তা উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে শেষ বিধিনিষেধের পাঁচ মাস পর ফের বিধিনিষেধ আরোপ করা হলো।
গতকাল সোমবার বিধিনিষেধের ব্যাপারে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সেখানে বলা হয়েছে, আগামী বৃহস্পতিবার থেকে এ বিধিনিষেধ কার্যকর হবে এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত তা বলবৎ থাকবে। বিধিনিষেধ চলাকালীন বাস-ট্রেন ফের অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলবে। উন্মুক্ত স্থানে যেকোনো সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান কিংবা রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
দেশে ডেল্টা সংক্রমণের পর গত বছর এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত বিভিন্ন সময় বিধিনিষেধ ছিল। এরপর সংক্রমণের হার দ্রুত কমে এলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলে; জীবনযাত্রা অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসে। তবে ওমিক্রন বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ সৃষ্টির পর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলাদেশেও করোনাভাইরাস সংক্রমণ আবার বাড়তে শুরু করে। দৈনিক শনাক্তের হার ৫ শতাংশের বেশি হলে পরিস্থিতি অবনতির হওয়ায় গত ৩ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হয়। সভা শেষে ৪ জানুয়ারি ১৫ দফা নির্দেশনা দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এরপর গতকাল ১১টি ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি হয়।
সার্বিক বিচারে বিধিনিষেধ ঠিকই আছে বলে মত দিয়েছেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখন এসব বিধিনিষেধ কার্যকর করতে কমিউনিটিকে কাজে লাগাতে ও সম্পৃক্ত করতে হবে। স্থানীয় সরকার, সিটি করপোরেশন, পৌরসভাকে কাজে লাগাতে হবে। শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে হবে না। প্রচুর স্বেচ্ছাসেবক লাগবে, যারা প্রচুর উৎসাহ নিয়ে কাজ করবে। তাহলেই বিধিনিষেধ কাজে লাগবে। মানুষ যেন নিজের জন্যই এসব বিধিনিষেধ মানতে অভ্যস্ত হয়, সেটা করতে হবে।’
বিধিনিষেধের ব্যাপারে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘সরকার আগেই বলেছে, ইনডোর অনুষ্ঠানগুলোতে ধারণক্ষমতার অর্ধেক মানুষ রাখতে হবে। তবে প্রজ্ঞাপনে উন্মুক্ত স্থান বলাতে একটা বিভ্রান্তি হতে পারে। এটা বলতে হবে, কোথাও ভিড় করা যাবে না। আর খোলা জায়গায় ভিড় বেশি হয়। যেমন বাণিজ্যমেলায় হাজার হাজার লোক হচ্ছে। খোলা জায়গায় যদি কম লোক থাকে, তাহলে সংক্রমণের আশঙ্কা কম। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। তাই এ ধরনের জনসমাগম বন্ধ করে দেওয়া উচিত। আরেকটি হলো নির্বাচনী প্রচারণা উন্মুক্ত জায়গায়ই হচ্ছে, কিন্তু মিছিল তো গায়ে গায়ে লাগিয়ে হচ্ছে, স্লোগান দিচ্ছে, মুখ থেকে ড্রপলেটের মাধ্যমে করোনা ছড়াচ্ছে। কোনো জরুরি কাজ থাকলে সেটা খোলা জায়গা করব। কিন্তু উন্মুক্ত বা বদ্ধ, কোনো জায়গাতেই ভিড় করা যাবে না। যেখানে করবে সেখানে বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে, ধারণক্ষমতার অর্ধেক লোক হতে হবে।’
যেসব বিধিনিষেধ মানতে হবে : গতকাল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক আদেশে বলা হয়, করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের প্রাদুর্ভাব ও দেশে করোনার সংক্রমণ পরিস্থিতি পর্যালোচনাসংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার সিদ্ধান্ত, দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখা এবং সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এসব বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
বিধিনিষেধগুলো হলো ১. দোকান, শপিং মল ও বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতা এবং হোটেল-রেস্তোরাঁসহ সকল জনসমাগমস্থলে বাধ্যতামূলক সবাইকে মাস্ক পরতে হবে। অন্যথায় তাকে আইনানুগ শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। ২. অফিস-আদালতসহ ঘরের বাইরে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে ব্যত্যয় রোধে সারা দেশে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে হবে। ৩. রেস্তোরাঁয় বসে খাবার গ্রহণ এবং আবাসিক হোটেলে থাকার জন্য অবশ্যই করোনার টিকা সনদ প্রদর্শন করতে হবে।
৪. ১২ বছরের বেশি বয়সী সব শিক্ষার্থীকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্র্তৃক নির্ধারিত তারিখের পর টিকা সনদ ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে না। ৫. স্থল, সমুদ্র ও বিমানবন্দরে স্ক্রিনিংয়ের সংখ্যা বাড়াতে হবে। পোর্টগুলোতে ক্রুদের জাহাজের বাইরে আসার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করতে হবে। স্থলবন্দরগুলোতে আসা ট্রাকের সঙ্গে শুধু ড্রাইভার থাকতে পারবে। কোনো সহকারী আসতে পারবে না। বিদেশগামীদের সঙ্গে আসা দর্শনার্থীদের বিমানবন্দরে প্রবেশ বন্ধ করতে হবে। ৬. ট্রেন, বাস ও লঞ্চে সক্ষমতার অর্ধেকসংখ্যক যাত্রী নেওয়া যাবে। সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কার্যকারিতার তারিখসহ সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা জারি করবে। সর্বপ্রকার যানের চালক ও সহকারীদের আবশ্যিকভাবে কভিড-১৯ টিকা সনদধারী হতে হবে। ৭. বিদেশ থেকে আসা যাত্রীসহ সবাইকে বাধ্যতামূলক কভিড-১৯ টিকা সনদ প্রদর্শন করতে হবে। ৮. স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন এবং মাস্ক পরার বিষয়ে সব মসজিদে জুমার নামাজের খুতবায় ইমামরা সংশ্লিষ্টদের সচেতন করবেন। জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা এ বিষয়টি নিশ্চিত করবেন। ৯. সর্বসাধারণের করোনার টিকা এবং বুস্টার ডোজ গ্রহণ ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় প্রচার এবং উদ্যোগ গ্রহণ করবে। এ ক্ষেত্রে তারা তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সহায়তা গ্রহণ করবে। ১০. উন্মুক্ত স্থানে সর্বসামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং সমাবেশ পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখতে হবে। ১১. কোনো এলাকার ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে সে ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নিতে পারবে।
দফায় দফায় বিধিনিষেধ : গত ২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে করোনার সংক্রমণ শুরু হয়। মার্চের শেষদিকে ধীরে ধীরে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ২২ মার্চ এক ঘোষণায় ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ১০ দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। পরবর্তী সময়ে তা ১১ ও পরে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়। পরিস্থিতির আশানুরূপ উন্নতি না হওয়ায় পুনরায় তা ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। এরপর পঞ্চম দফায় ছুটি ৫ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়। ষষ্ঠ দফায় এ ছুটি ১৬ এবং সর্বশেষ সপ্তম দফায় ৩০ মে পর্যন্ত বর্ধিত হয়। এর মধ্যে ২৪-২৬ মে ঈদের ছুটি ছিল। সাধারণ ছুটির মধ্যে সারা দেশেই পণ্য পরিবহন, চিকিৎসা ইত্যাদি অতি-প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ছাড়া গণপরিবহনও বন্ধ থাকে। দেশ জুড়ে লকডাউন বা অবরুদ্ধকরণ আরোপ করা না হলেও আক্রান্তের বাড়ি, প্রয়োজনে জেলা, উপজেলা ইত্যাদি অবরুদ্ধকরণ করা হয়। ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের ২৯টি জেলা সম্পূর্ণ এবং ১৯টি জেলা আংশিকভাবে অবরুদ্ধ করা হয়। ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত দেশে ৫৮টি জেলায় করোনা আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে আক্রান্তের ভিত্তিতে সবুজ, হলুদ ও লাল অঞ্চলে ভাগ করে লকডাউন দেওয়া হয়। এরপর পরিস্থিতির উন্নতি হলে বিধিনিষেধ শিথিল হয়।