নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অভিযোগের অনুসন্ধান ও তদন্ত শেষ না হওয়ায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কার্যক্রম নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছে উচ্চ আদালত।
হাইকোর্ট এক রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছে, কমিশনের উচিত নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে অভিযোগের অনুসন্ধান কিংবা তদন্ত শেষ করে অভিযুক্তকে বিচারের আওতায় আনা এবং বিচারকাজ শেষের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।
দুদককে আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়ে আদালত বলেছে, কমিশন যদি ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে নীরবতা অবলম্বন করে, তবে দুর্নীতি ও দুর্নীতির চর্চা নির্মূলের সকল প্রচেষ্টা ব্যাহত হবে।
দুদকের মামলায় এক আসামির অব্যাহতির আদেশ বাতিল করে গত ২৪ জানুয়ারি এ রায় দিয়েছিল হাইকোর্ট। মঙ্গলবার এর পূর্ণাঙ্গ রায়টি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়।
৭২ পৃষ্ঠার রায়টি লিখেছেন বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার। তার সঙ্গে একমত হয়েছেন অপর বিচারপতি মহি উদ্দিন শামীম।
ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে ২০১১ সালের ২৬ জুলাই কুড়িগ্রাম পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মমিনুর রহমান ও সহকারী প্রকৌশলী মো. জহিরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে দুদক। পরে দুজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়।
বিচার চলাকালে আসামি জহিরুল ইসলাম মামলা থেকে অব্যাহতি চেয়ে ২০১৯ সালের ৬ মে আবেদন করলে ওই বছরের ১২ জুন রংপুরের সংশ্লিষ্ট আদালত তাকে অব্যাহতি দেয়। পরে বিচারিক আদালতের এ আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিভিশন আবেদন করে দুদক।
প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট জহিরুল ইসলামকে দুর্নীতির মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আদেশ বাতিল প্রশ্নে রুল জারি করে। চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে গত ২৪ জানুয়ারি রুল যথাযথ ঘোষণা করে রায় দেয় হাইকোর্ট। রায়ে বিচারাধীন এই মামলাটি দ্রুততম সময়ে অথবা এক বছরের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশনা দেয় আদালত।
আদালতে দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী কামরুন নেসা। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক। আসামিপক্ষে ছিলেন আইনজীবী রবিউল আলম বুদু।
পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলে, দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের ৩২ ধারা ও বিধি ১৫ অনুযায়ী, নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে কমিশনের উচিত অভিযোগের অনুসন্ধান বা তদন্ত শেষ করে অভিযুক্তকে বিচারের আওতায় আনা। একই সঙ্গে দক্ষতার সঙ্গে বিচার কাজ শেষ করে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা। এতে দুর্নীতি এবং দুর্নীতি চর্চা বন্ধ হবে।
আদালত বলে, কমিশনের কোনো আদেশ, কার্যপ্রণালী কিংবা নিষ্ক্রিয়তা সংশ্লিষ্ট আইনের উদ্দেশ্যেকে ব্যাহত করে এবং দুর্নীতি ও দুর্নীতির চর্চা প্রতিরোধে কমিশন যতি ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে নীরবতা অবলম্বন করে তবে সব প্রচেষ্টা ও পরিশ্রম ব্যাহত হবে।
গণমাধ্যমের বরাতে পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলে, বড় দুর্নীতির মামলাগুলোর আইনি প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার চেয়ে দুদক আত্মসাৎকৃত টাকা পুনরুদ্ধারে ব্যস্ত। ফলে অভিযুক্তরা নিজেদের রক্ষায় সুবিধা পাচ্ছে বা নিচ্ছে। আদালত বলে, টাকা উদ্ধার দুদকের কাজ নয়, আইনে তাদের সে ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। টাকা পুনরুদ্ধারে এটুকু প্রতীয়মান হয় যে, অভিযুক্ত ব্যক্তি অর্থ আত্মসাৎ বা পাচার করেছেন। কিন্তু এটি বলা যাবে না যে, টাকা উদ্ধার হলেই অভিযুক্ত বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যথেষ্ট সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
আদালত আরও বলে, মামলা দায়েরের পর অনেক সময় পার হলেও অনেক মামলা রয়েছে যেখানে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দুদক অভিযোগপত্র বা অনুসন্ধান প্রতিবেদন দিতে পারেনি, এটি স্পষ্টত আইনের লঙ্ঘন। এমনকি বিশেষ বিধান থাকার পরও এমন অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট অনুসন্ধান বা তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি।
হাইকোর্ট বলে, বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং অনেক সরকারি সংস্থার অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে মামলা হয়েছে। কিন্তু সেগুলোর অনুসন্ধান, তদন্ত, বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করতে দুদক কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়নি। এ নিয়ে কমিশনের পক্ষ থেকে কোনো ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়নি। দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ ও দুর্নীতি দমন কমিশন বিধি, ২০০৭ -এ কমিশনের কার্যক্রম সম্পর্কে বলা আছে। তাই, দেশের দুর্নীতি চর্চা বন্ধ করতে আইনগত অবস্থান থেকে কমিশনের আরও কঠোর হওয়া উচিত।