এক লাখ ৭০ হাজার টাকার একটি চেক (সিএ ১৭৫৪০৮৯) কাঁচি দিয়ে কাটছেন ইভ্যালির গ্রাহক মো. শামীম হোসেন। মোবাইলে এর ভিডিও ধারণ করে তা পাঠিয়ে দেন ইভ্যালিতে। ই-কমার্স কম্পানিটি তাঁকে বলেছিল, তাঁর কাছে থাকা চেকটি কেটে টুকরা টুকরা করার ভিডিও পাঠালে টাকা ফেরত পাবেন। কিন্তু এখন তাঁর ‘আম-ছালা’ দুটিই গেছে বলে তাঁর ধারণা, টাকা আর ফেরত আসছে না। তাঁর মতো আরো অনেক গ্রাহকও ওই পরামর্শ মেনে টাকা ফেরত না পাওয়ার অভিযোগ করছেন।
হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুক মেসেঞ্জার, টেলিগ্রামসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় ইভ্যালি গ্রাহকদের একাধিক গ্রুপ রয়েছে। সেখানেই চেক ছেঁড়ার প্রস্তাব দেওয়ার মোবাইল কথোপকথনের রেকর্ড অনেক ক্রেতা শেয়ার করছেন। ক্রেতাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেলও যুক্ত আছেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এসব গ্রুপে ক্রেতারা অভিযোগ করে বলেছেন, গত জানুয়ারি থেকে সাইক্লোন অফারে বাইক অর্ডার করে এখন পর্যন্ত ডেলিভারি না পাওয়া গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে আগাম তারিখ উল্লেখ করে দুটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকের চেক দিয়েছিল ইভ্যালি। এরপর গত মাসে ফোন করে তাঁদের অনুরোধ করা হয়েছিল, তাঁরা যেন নির্ধারিত তারিখে চেকগুলো ব্যাংকে জমা না দেন। তার পরও যেসব ক্রেতা চেক জমা দেন, তার বড় অংশই বাউন্স ও স্টপ পেমেন্ট হয়েছে বলে অনেক ক্রেতা অভিযোগ করছেন। এরপর আসে চেক কুচি কুচি করার অদ্ভুত প্রস্তাব!
ই-কমার্স খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গ্রাহকদের কাছে চেক থাকা মানে কিছুটা হলেও প্রমাণ থাকা। রিফান্ড না দিলে চেক ডিস-অনারের মামলা করারও সুযোগ থাকছে। কিন্তু তা ছিঁড়ে ফেললে ইভ্যালি যদি টাকা না-ও দেয়, গ্রাহকের হাতে কোনো প্রমাণ থাকছে না।
জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডাব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক হাফিজুর রহমান গতকাল বৃহস্পতিবার রংপুর ডেইলীকে বলেন, ‘গ্রাহকের চেক ছিঁড়ে দিলে তারা টাকা দেবে—এই নিশ্চয়তা তারা কেন চাচ্ছে বোধগম্য নয়। তারা যদি গ্রাহককে টাকা ফেরত দেয়, তাহলে চেক ছিঁড়তে হবে কেন? উদ্দেশ্য ভালো হলে টাকাটা ব্যাংকে দিতে অসুবিধা কোথায়? তারা চেক তো আগে দিয়েছে। সেই চেকের অনূকুলে টাকা দিলে গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে চলে যাবে। নিশ্চয় কোনো খারাপ উদ্দেশ্য আছে।’
হাফিজুর বলেন, ‘যদি কোনো কাস্টমার ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন বা প্রতারিত হয়েছেন বলে মনে করেন, তাহলে তাঁর উচিত হবে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে মামলা করা। তাহলে আমরা সিগন্যাল পাব, কী পরিমাণ কাস্টমার প্রতারিত হচ্ছেন এবং কী ধরনের সমস্যা, কী ধরনের লায়াবিলিটিস তৈরি হচ্ছে।’
ইভ্যালিকে আগাম মূল্য পরিশোধ করেও যাঁরা পণ্য পাননি কিংবা অন্য অভিযোগ রয়েছে, তাঁদের জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। গত বুধবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ইভ্যালিসহ অন্যান্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা পরিস্থিতি বিষয়ক এক আন্ত মন্ত্রণালয় সভা শেষে এই পরামর্শ দেন হাফিজুর রহমান।
গত ১৪ মার্চের এক হিসাব অনুযায়ী, গ্রাহক ও মার্চেন্টদের কাছে মোট ৪০৭ কোটি ১৮ লাখ ৪৮ হাজার ৯৯৪ টাকা দায়ের বিপরীতে ইভ্যালির কাছে মাত্র ৬৫ কোটি ১৭ লাখ ৮৩ হাজার ৭৩৬ টাকা চলতি সম্পদ ছিল। দেড় মাসের মধ্যে গ্রাহকের হাতে পণ্য বুঝিয়ে দেওয়ার কথা বলে অগ্রিম এসব টাকা নিয়ে রেখেছে ইভ্যালি। এই পরিস্থিতিতে বছর পার হয়ে গেলেও তারা পণ্য দিতে পারছে না।
এর আগে ইভ্যালির বিরুদ্ধে কেন আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, তা জানতে চেয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। প্রতিষ্ঠানটির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে ৯ সদস্যের একটি আন্ত মন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
গত ১৯ জুলাই ইভ্যালিকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কম্পানিটি ব্যবসার ধরন, সম্পদ দায়, গ্রাহকের দেনা, মার্চেন্টদের কাছে দেনাসহ বিভিন্ন তথ্য জানতে চায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। গত ১ আগস্ট এসব তথ্য দেওয়ার কথা থাকলেও ইভ্যালি দিতে পারেনি।
নোটিশে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলেছিল, এ বছরের ১৪ মার্চ পর্যন্ত গ্রাহক ও মার্চেন্টদের কাছে মোট ৪০৭ কোটি টাকার বেশি দায়ের বিপরীতে মাত্র ৬৫ কোটি টাকা চলতি সম্পদ থাকার কারণ কী? অবশিষ্ট টাকা ইভ্যালির কাছে আছে কি না, থাকলে সে বিষয়ে তথ্য এবং না থাকলে তার পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে হবে।
এদিকে ইভ্যালিকে ১৫ জুলাই পর্যন্ত কম্পানির সম্পদ ও দায় বিবরণী আগামী ১৯ আগস্টের মধ্যে এবং একই সময়কালের হিসাবে গ্রাহকের কাছে মোট দেনার পরিমাণ ও এসংশ্লিষ্ট গ্রাহকসংখ্যা ২৬ আগস্টের মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে বলা হয়েছে। গ্রাহক ও মার্চেন্টদের প্রতি চলমান দায়ভার স্পষ্ট করার ব্যাপারে ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য ইভ্যালিকে ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
গতকাল বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এক নোটিশে এসংক্রান্ত তথ্য সরবরাহ করারও নির্দেশ দেয় প্রতিষ্ঠানটিকে। এর আগে দায় মেটানোর ব্যাখ্যা দিতে ছয় মাস সময় চেয়ে গত ২ আগস্ট বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় ইভ্যালি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা ইভ্যালিকে তিন সপ্তাহ সময় দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছি। ইভ্যালির ব্যালান্সশিট ও দেনার তথ্য দেওয়ার জন্য আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সময় দিয়েছি। এ ছাড়া গ্রাহকের পাওনাদি ও অন্যান্য তথ্য দেওয়ার জন্য আরো এক সপ্তাহ এবং ভেন্ডরসহ অন্যান্য তথ্য দেওয়ার জন্য পরের সপ্তাহসহ মোট তিন সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়েছে।’ প্রতিষ্ঠানটি এর পরও তথ্য না দিলে কী হবে জানতে চাইলে হাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা বৈঠক করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব।’
এ বিষয়ে ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেলের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মটির জনংযোগ প্রতিষ্ঠানের কাছে লিখিত বক্তব্য চেয়েও পাওয়া যায়নি।