ঘুরেফিরে জুলাই মাস এলেই ২০১৬ সালের ১ জুলাইয়ের সেই বীভৎসতার কথা মনে আসে। বাংলাদেশের ইতিহাসের নির্ঘণ্টে এর থেকে বড় ভয়ংকর কলঙ্কের দিনও আছে। বহু দেশেই এ রকম রয়েছে, কিন্তু সেখানে একটির সঙ্গে অন্যটির যোগসূত্র নেই, প্রতিটিই আলাদা একেকটি ঘটনা। কিন্তু বাংলাদেশের বেলায় তা নয়।
১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যে উদ্দেশ্যে হত্যা করা হয়, ঠিক হুবহু একই উদ্দেশ্যে ভিন্ন প্রেক্ষাপট ও পন্থায় বাকি কলঙ্কিত ঘটনাগুলো ঘটানো হয়। হলি আর্টিজানসহ যারা এসব কলঙ্কিত ঘটনার মূল নেপথ্যের পরিকল্পনাকারী দেশি-বিদেশি ব্যক্তি ও গোষ্ঠী, তারা সব সময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে এবং এখনো আরো বড় কলঙ্ক রচনার জন্য দিন-রাত ওভারটাইম কাজ করছে বিধায় হলি আর্টিজানের মতো কলঙ্কিত দিবস এলেই বাংলাদেশের ভূত-ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত যে বলিরেখা কপালে ভেসে উঠতে চায় তাতে সত্যিই শঙ্কিত হতে হয়। কিন্তু শঙ্কায় ম্রিয়মাণ হই না, কারণ আমাদের সঙ্গে একাত্তর আছে এবং বঙ্গবন্ধুর মেয়ে শেখ হাসিনা রয়েছেন। প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ১ জুলাইয়ের ঘটনা এবং তার আগে-পরের কিছু ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণের পর বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যতের কিছু রূপরেখা তুলে ধরার চেষ্টা করব।
২০১৬ সালের ১ জুলাই পবিত্র রমজান মাসের শুক্রবার। এই পবিত্রতম দিনে বাংলাদেশের ইসলামিস্ট সশস্ত্র জঙ্গিরা ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে আহাররত নিরীহ ও সম্পূর্ণ নিরাপদ ২২ জন মানুষকে হত্যা করে। মানুষ হত্যা করছে, আর মুখে আল্লাহু আকবার স্লোগান দিচ্ছে। নাউজুবিল্লাহ। মহান আল্লাহর নামের এর থেকে বড় অবমাননা আর হতে পারে না। কয়েক দিন পর ২০১৬ সালের ৭ জুলাই কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতে আগত মুসল্লিদের ওপর তারা আক্রমণ চালায় এবং তাতে পুলিশসহ চারজন নিরীহ মানুষ নিহত হয়। হলি আর্টিজানের আক্রমণসহ বাংলাদেশে যত জঙ্গি আক্রমণ হয়েছে তার মূল উদ্দেশ্য বোঝার জন্য আগের ঘটনাবলির ওপর একটু নজর বোলাতে হবে। দেখার বিষয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় ট্রাইব্যুনাল থেকে ২০১৩ সালে বের হওয়া শুরু হতেই সশস্ত্র জঙ্গিরা আবার নতুন করে মাঠে নামে। এ যাত্রায় ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী রাজীব হায়দার তাদের প্রথম শিকার হন। মনে রাখতে হবে, ওই সময়ই হেফাজতের আবির্ভাব ঘটে। ধর্ম সম্পর্কীয় বা কোনো ধর্মের বিরুদ্ধেই গণজাগরণ মঞ্চের কোনো মন্তব্য ছিল না। তাদের একমাত্র স্লোগান ও দাবি ছিল যুদ্ধাপরাধীদের সঠিক বিচার। তাহলে হেফাজত গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে এত প্রচণ্ডভাবে খেপে গেল কেন? উত্তর সহজ ও সরল। যেকোনো মূল্যে জামায়াতি নেতাদের বাঁচাতে হবে। কারণ বাংলাদেশে জামায়াতই একমাত্র সুসংগঠিত দেশব্যাপী বিস্তৃত নেটওয়ার্ক রক্ষাকারী কট্টর ওয়াহাবিপন্থী রাজনৈতিক দল, যে ওয়াহাবিতন্ত্রে বিশ্বাসী হেফাজতসহ সব ইসলামিস্ট পক্ষ। এ ছাড়া বিদেশে জামায়াতের শক্তিশালী কানেকশন রয়েছে। জামায়াত ফিনিশ হয়ে গেলে অন্য ওয়াহাবিবাদী কোনো পক্ষই বাংলাদেশে টিকতে পারবে না। তাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হেফাজত যেমন বড় ফণা তোলে, তেমনি সশস্ত্র জঙ্গিদের দেশব্যাপী গোপন ও অকস্মাৎ টার্গেট কিলিং শুরু হয় রাজীব হায়দারকে হত্যার মধ্য দিয়ে। এক পর্যায়ে ২০১৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গুলশানে ইতালীয় নাগরিক সিজারে তাবেল্লাকে হত্যা করা হয়। তার কিছুদিন পর রংপুরে হত্যার শিকার হন জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি। কয়েক দিনের ব্যবধানে ২০১৬ সালের প্রথম দিকে পাবনার সেবায়েত নিত্যরঞ্জন পাণ্ডে, ঝিনাইদহের আনন্দ গোপাল, পঞ্চগড়ের গোপাল চন্দ্রকে হত্যা করা হয়। হত্যার শিকার হন খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ নাটোরের মুদি দোকানদার সুনীল গোমেজ এবং টাঙ্গাইলের দরজি শ্রমিক নিখিল জোয়ার্দার। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য অনলাইনে প্রচারে সোচ্চার খিলগাঁওয়ের নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়, সিলেটের অনন্ত বিজয় দাস ও ঢাকার ওয়াশিকুর রহমানকে তারা হত্যা করে। জামায়াত-হেফাজতের উগ্রবাদী ধর্মান্ধতার চরম বিরোধী ও উদারপন্থী ইসলামী প্রবক্তা নুরুল ইসলাম ফারুকীকে ঢাকায় তাঁর নিজ বাসায় কুপিয়ে মারা হয়। হত্যার হুমকি দেওয়া হয় সুধীসমাজের সেই সব ব্যক্তিকে, যাঁরা পত্রিকার কলামে, কথায় ও টেলিভিশনের টক শোতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুর অব্যবহিত পর থেকে ২০১৬ সালের ১ জুলাইয়ের আগ পর্যন্ত ৫০ জনেরও অধিক নিরীহ মানুষকে তারা হত্যা করে।
হলি আর্টিজানে নিহতদের মধ্যে ১৭ জনই ছিল পশ্চিমা বিশ্বের নাগরিক। যাঁরা হত্যার শিকার হয়েছেন বিভিন্ন দৃষ্টিতে তাঁদের শ্রেণিভেদটি বোঝার জন্য মাত্র কয়েকজনের নাম ওপরে উল্লেখ করেছি। হিন্দু পুরোহিত হত্যা করলে ভারতের মোদি সরকার এবং পশ্চিমাদের হত্যা করলে ইউরোপ-আমেরিকা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধে আওয়ামী লীগ সরকারকে চাপ দেবে—এটাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। আর বাংলাদেশের অন্য যাদের হত্যা করা হয়েছে তারা সবাই ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য সোচ্চার এবং জামায়াত-হেফাজত বিরুদ্ধ। এখানে ধর্মীয় প্রলেপ লাগলেও ধর্মীয় কোনো ব্যাপার ছিল না এবং আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের লক্ষ্যের সঙ্গে এদের লক্ষ্যের কোনো মিল ও সামঞ্জস্য ছিল না। বাংলাদেশের বৃহত্তর জনমতের তোড়ে জামায়াত-হেফাজতের কৌশল এবং জঙ্গিদের লক্ষ্য ব্যর্থ হয়, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়। এই ফাঁকে অন্য একটি পক্ষকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করতে দেখা যায়। সে সময়ে সমান্তরাল এই অন্য পক্ষটি জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও অত্যন্ত কৌশলে ২০০৭-০৮ মেয়াদে তাদের যে এজেন্ডা ছিল সেটি পুনরায় বাস্তবায়নের জন্য আদাজল খেয়ে কাজে নেমে পড়ে। তাদের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রচারণা ছিল, মধ্যপ্রাচ্য থেকে আইএস ও আল-কায়েদা বাংলাদেশে এসে গেছে। তাই তাদের পরাজিত ও দেশকে রক্ষা করতে হলে বিদেশি বড় বড় শক্তির সহায়তা নেওয়া একান্ত অপরিহার্য। কিন্তু শেখ হাসিনার অসাধারণ রাজনৈতিক সাহস এবং দেশের স্বার্থে বঙ্গবন্ধুর মতো আপসহীন অবস্থানই সে সময়ে বাংলাদেশকে রক্ষা করে। কিছু মানুষ সে সময়ে নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে, জঙ্গিদের বিরুদ্ধে এবং আইএস-নামীয় ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচনে পত্রিকার কলামে, সেমিনারে ও টেলিভিশনের টক শোতে সোচ্চার থেকে শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করেছেন।
২০১৬ সালের ১ জুলাইয়ের পরও বহুবার একই ধরনের বড় আক্রমণ চালানোর চেষ্টা জঙ্গিরা করেছে। কিন্তু তারা সফল হয়নি। গত আড়াই-তিন বছর সশস্ত্র জঙ্গি তৎপরতা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে। তাই বলে বাংলাদেশ জঙ্গিমুক্ত হয়েছে এ কথা বলা যাবে না। কারণ জঙ্গিবাদের যে সামগ্রিকতা এবং তার সঙ্গে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা, এদের সঙ্গে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের কানেকশন, ভূ-রাজনীতির খেলা এবং আইএস-আল কায়েদা বাংলাদেশে এসে গেছে বলে ২০০৭-০৮ মেয়াদের এজেন্ডা যারা বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল, তারা সবাই নিজ নিজ অবস্থানে আগের লক্ষ্যে অটুট রয়েছে এবং পরবর্তী সুযোগের অপেক্ষায় আছে। মার্চ মাসের শেষের দিকে হেফাজত যা শুরু করেছিল তার আরেকটু বিস্তৃতি ঘটলেই এদের সবার চেহারা আবার স্বরূপে দেখা যেত। সশস্ত্র জঙ্গি তৎপরতা দমনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী অনেকটা সফলতা পেলেও সামগ্রিকভাবে জঙ্গিবাদের কবল থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রকে মুক্ত করার জন্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কার্যকর পদক্ষেপ, আন্দোলন, ক্যাম্পেইন ও কর্মসূচি নেই। বিপরীতে জঙ্গিবাদের নেটওয়ার্ক ও জঙ্গিবাদী অর্থনীতি ক্রমেই ব্যাপক ও বিশালতর হচ্ছে। ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রের সব শ্রেণি, স্তর ও পর্যায়ের মানুষ ধর্মের সংবেদনশীল বিষয়াদির অপব্যাখ্যায় ভীষণভাবে প্রভাবিত হচ্ছে এবং অযৌক্তিক, অসমর্থিত ও অবৈজ্ঞানিক চিন্তা-চেতনা মানুষের মধ্যে তৈরি হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে এর উপস্থিতি চলমান সময়ে টের পাওয়া যায় না, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে যখন সেটি বোঝা যায় তখন আর প্রতিকারের সময় থাকে না। রাজনৈতিক পন্থা আবশ্যক, কিন্তু শুধু রাজনীতি ও প্রশাসনিক পন্থায় ধর্মীয় অপব্যাখ্যাজনিত মতাদর্শকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করা যায় না।
স্বাধীনতার শুরু থেকে পরিপূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র কেন এবং কিভাবে ও কী কারণে উগ্রবাদী কট্টর ওয়াহাবি পন্থার দিকে ঝুঁকে গেছে ও যাচ্ছে তার জ্বলন্ত উদাহরণ তিউনিশিয়া, আলজেরিয়া, মিসর ও তুরস্ক। তিউনিশিয়ার স্বাধীনতার স্থপতি হাবিব বারগুইবার মতো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রনেতা বিশ্বের কোনো মুসলিম দেশ পায়নি। কিন্তু বারগুইবার আদর্শ এখন শুধুই ইতিহাস। ব্রাদারহুডকে ক্ষমতা থেকে হটাতে সামরিক একনায়কতন্ত্রের কবলে এখন মিসর। তুরস্কে কামাল আতাতুর্কের আদর্শ এখন ক্রমেই ধুলায় ঢেকে যাচ্ছে। রোমান সাম্রাজ্য ও অটোমানদের শোচনীয় পতনের সিঁড়িতেই তরতর করে উঠছে এসব দেশ। ইতিহাসের শিক্ষা নীরবে-নিভৃতে কাঁদে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পশ্চিমা বিশ্বের অনেক নামজাদা পণ্ডিত ব্যক্তি নতুন শত্রুর সন্ধানে ক্লাস অব সিভিলাইজেশন তত্ত্ব সামনে এনেছেন। তাহলে মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্রগুলো কি সেই ফাঁদে পা দিচ্ছে?
বাংলাদেশের কথায় ফিরে আসি। ১৯৭২ সালে আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতের সূচকগুলোর যে অবস্থান ছিল তার থেকে আজ অনেক অগ্রগতি হয়েছে। তাতে কি আমরা বলতে পারছি সামগ্রিকভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রযন্ত্র অধিকতর উদার ও যৌক্তিক হয়েছে, মনোজগতের উন্নতি ঘটেছে, আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি। একই সঙ্গে ২০১৬ সালের ১ জুলাইয়ের আগে ও পরের বহুমুখী ষড়যন্ত্র ও ঘটনাবলি স্মরণে রাখা জরুরি। ইতিহাস ভুলে গেলে তার চরম মূল্য দিতে হয়।