অক্সিজেনসংকট নিয়ে কথা বলছেন না চিকিৎসক-নার্স

সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অক্সিজেনসংকটের কারণে করোনা রোগীর মৃত্যুর যে অভিযোগ উঠেছে, সে ব্যাপারে চিকিৎসক ও নার্সরা কোনো কথা বলছেন না। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক অভিযোগের সত্যতা স্বীকার না করলেও ‘কিছু সময়ের’ জন্য হাসপাতালের কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ লাইনে প্রবাহ কম থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

যদিও জেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলছেন, কেন্দ্রীয় সরবরাহ ব্যবস্থায় অক্সিজেনের চাপ কম থাকলেও সে কারণে রোগীর মৃত্যু হওয়ার কথা নয়, কারণ হাসপাতালে অন্তত ৭০টি অক্সিজেন সিলিন্ডার রয়েছে।

তাহলে কী কারণে করোনা রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ উঠল, সেটা তদন্তের জন্য তিন সদস্যের একটি কমিটি করার কথা জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক।

এদিকে মারা যাওয়া রোগীর স্বজনরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা ক্ষতিপূরণও দাবি করছেন।

গত সোমবার জেলার শ্যামনগর উপজেলার বংশীপুর ইউনিয়নের সোনাখালী গ্রামের কাশেম গাজীর ছেলে আশরাফ আলী (৩৮) করোনায় আক্রান্ত হয়ে তীব্র শ্বাসকষ্ট নিয়ে সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। গত বুধবার সন্ধ্যা ৬টার পর তাঁর মৃত্যু হয়।

আশরাফের ভাই হোসেন আলী কালের কণ্ঠ’র কাছে দাবি করেন, সন্ধ্যা ৬টার দিকে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে তাঁর ভাইয়ের শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায় এবং এক পর্যায়ে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তিনি বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালের এই অবস্থা আগে জানলে অন্য ব্যবস্থা করতাম।’ হাসপাতালে করোনা রোগীর চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ করে হোসেন বলেন, তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে এমন অবস্থার উন্নতি হবে না। তাঁর প্রশ্ন, ‘সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীরা কি এসব জানেন না?’

আশাশুনি উপজেলার শ্রীউলা ইউনিয়নের বক্সার গ্রামের আসাদুল্লাহ কালের কণ্ঠকে জানান, তাঁর বড় ভাই রবিউল ইসলাম পারভেজ এই হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। অক্সিজেনসংকটের কারণে বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে তাঁর ভাই মারা যান। চিকিৎসকদের অবহেলায় তাঁর ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে, এমন অভিযোগ করে সরকারের কাছে ক্ষতি পূরণ দাবি করেন।

গত বুধবার সন্ধ্যায় করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অক্সিজেনসংকটের কারণে ছয় করোনা রোগীর মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে।

সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটি অক্সিজেনসংকটে রোগীর মৃত্যুর অভিযোগের পাশাপাশি আলোচনায় আসা অন্য অভিযোগগুলোরও তদন্ত দাবি করেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার কমিটির যুগ্ম সদস্যসচিব আলী নুর খান বাবলুর স্বাক্ষরে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়, তিন দিন আগে থেকে সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থায় সরবরাহ কমে আসার সংকেত পাওয়া যায় বলে তাঁরা জানতে পেরেছেন। এর পরও কর্তৃপক্ষ যথাসময়ে অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করেনি। হাতে গোনা তিন-চারজন চিকিৎসক ও শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা ২৪ ঘণ্টা পরিশ্রম করে হাসপাতালের চিকিৎসাব্যবস্থা টিকিয়ে রেখেছেন। অন্যারা বেসরকারি ক্লিনিক-হাসপাতাল নিয়ে ব্যস্ত।

গতকাল এ বিষয়ে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সরেজমিনে খোঁজখবর নিতে গেলে সেখানে কর্তব্যরত নার্স ও চিকিৎসকরা মুখ খুলতে রাজি হননি। সব তথ্য করোনা কমিটির তথ্য কর্মকর্তার মাধ্যমে সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া হয় বলে তাঁরা বিষয়টি এড়িয়ে যান।

তবে একজন চিকিৎসক পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, বুধবার সন্ধ্যায় এক ঘণ্টার মধ্যেই অক্সিজেনসংকটের কারণে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) দুজন এবং করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) দুজন করোনা আক্রান্ত রোগী মারা যায়। এ ছাড়া করোনা উপসর্গ নিয়ে ওয়ার্ডে মারা গেছে চারজন।

জানতে চাইলে হাসপাতালের তত্ত্বাধায়ক ডা. কুদরাত-ই-খুদা কালের কণ্ঠকে বলেন, কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থায় যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে কিছু সময় ফ্লো (প্রবাহ) কমে যায়। বিষয়টি জানার পর দ্রুত সময়ের মধ্যে অক্সিজেন সরবরাহ ঠিক করা হয়। ওই সময়ের মধ্যে করোনা আক্রান্ত চারজন রোগীর মৃত্যু হয় জানিয়ে তিনি বলেন, অক্সিজেনসংকটে নয়, নানা জটিলতায় তাদের মৃত্যু হয়েছে। তিনি জানান, হাসপাতালে অক্সিজেনের কোনো সংকট নেই। কী কারণে অক্সিজেনের প্রবাহ কমে গিয়েছিল, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

সাতক্ষীরার করোনা নিয়ন্ত্রণ কমিটির সদস্যসচিব জেলার সিভিল সার্জন ডা. হুসাইন শাফায়াত কালের কণ্ঠকে বলেন, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন সরবরাহে সমস্যার কারণে অক্সিজেনের কোনো সংকট দেখা দেওয়ার কথা নয়। কারণ কেন্দ্রীয় সরবরাহ ব্যবস্থা ছাড়াও সেখানে ৭০টির বেশি অক্সিজেন সিলিন্ডার রয়েছে। এখানে দায়িত্বশীলদের কোনো গাফিলতি ছিল কি না সেটা খতিয়ে দেখবে স্বাস্থ্য বিভাগ।

জেলার করোনা নিয়ন্ত্রণ কমিটির আহ্বায়ক সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক হুমায়ুন কবির সাংবাদিকদের জানান, ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. কাজী আরিফ আহমেদকে প্রধান করে গঠিত এ কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা. মারুফ আহমেদ ও সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ডা. সাইফুল্লাহ।

জেলা প্রশাসক বলেন, আগামী তিন দিনের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। প্রয়োজন হলে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও পৃথক তদন্ত কমিটি করা হবে।

সাতক্ষীরায় করোনা সংক্রমণের হার কিছুটা কমলেও মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত চারজন ও উপসর্গ নিয়ে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এখন পর্যন্ত এটিই করেনায় সাতক্ষীরায় সর্বোচ্চ মৃত্যু। এ নিয়ে জেলায় করোনায় মারা গেছে ৭৪ জন। আর উপসর্গ নিয়ে মারা গেছে আরো ৩৫০ জন। এ ছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ১০৬ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৫২ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার ৪৯.৫ শতাংশ।

Leave a Comment