করোনাভাইরাসের ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ ঠেকাতে দেশে কঠোর লকডাউন ঘোষণায় মাথায় হাত পড়েছে ‘হাঁড়িভাঙ্গা’ আম ব্যবসায়ীদের। দুরপাল্লার বাস, ট্রেনসহ ব্যক্তিগত যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উত্তরের জেলা রংপুরের মিঠাপুকুর ও বদরগঞ্জে প্রসিদ্ধ হাঁড়িভাঙ্গা আমের বাজারে নেমেছে ধস। পাইকারী গ্রাহক না থাকায় ব্যবসায়ীরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। বিগত বছরে মৌসুমের শুরুতে যেখানে ১৮০০ থেকে দুই হাজার টাকা প্রতি মণ আম বিক্রি হয়। এবারে তার অর্ধেক দামে আম নিচ্ছে না কেউ। গ্রাহক না থাকায় মৌসুমী আম ব্যবসায়ী ও বাগান মালিকদের পথে বসার উপক্রম হয়েছে।
এদিকে কঠোর লকডাউনের ঘোষণায় লোকশানের আশঙ্কায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীরা আম কেনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। বাগানে আম পেকে পঁচে যাচ্ছে। প্রতিবছর হাঁড়িভাঙ্গা আম বিক্রি করে শুধুমাত্র রংপুরের চাষিরা আয় করেন প্রায় ২০০ কোটি টাকার ওপরে। কিন্তু এবারে সেই চিত্র ভিন্ন। ব্যবসায়ীদের দাবী রংপুর থেকে আম পরিবহণের বিশেষ ব্যবস্থা করা গেলে কিছুটা ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব ছিল। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমের হাটে কাউকে চলাচল করতে দেখা যায়নি। কারো মুখে মাস্কও ছিল না।
হাঁড়িভাঙ্গা আমের মুল উৎস রংপুরের মিঠাপুকুর-বদরগঞ্জের পদাগঞ্জ হাটে গিয়ে দেখা যায়, প্লাস্টিকের ক্যারেটে থরে থরে সাজানো হাঁড়িভাঙ্গা আম। গ্রাহকের অভাবে আম নিয়ে অপেক্ষায় দিন পার করছে শতশত চাষি। বিক্রির অভাবে আড়তে স্তুপ করে রাখা হয়েছে আম। সেখানে কথা হয় আড়তদার আব্দুস সাত্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ধারদেনা ও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে বাগান কিনেছি। আসল টাকা তো দুরের কথা। বাড়ি ভিটা বিক্রি করে এবারে টাকা পরিশোধ সম্ভব নয়। আমার মত শত শত চাষির পুঁজি থাকবে না। এবারে আম কিনে আমরা দেউলিয়া।’ দুরপাল্লার বাস, ট্রেন চলাচল থাকলে লোকশান পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব ছিল বলে মনে করেন তিনি।
ব্যবসায়ী ইদ্রিস আলী বলেন, কঠিন লকডাউনের খবরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীরা আম নিতে অপারগতা জানায়। আর ঢাকায় নিয়ে তারা কার কাছে আম বেচবে। তার ওপর গাড়ী ভাড়া বেশি। আম বহনের ক্যারেটের দাম বেড়েছে অনেক গুণ। কারণ যে ক্যারেটে বিভিন্ন অফিস ও বাসা-বাড়িতে আম পাঠানো হয় ওই ক্যারেট আর বাজারে ফেরত আসে না। ফলে ক্যারেট নিয়ে বাড়ছে আরেক সমস্যা।
বদরগঞ্জ উপজেলার নাটারাম এলাকার মৌসুমী ব্যবসায়ী মেনারুল ইসলাম বলেন, গত বছর চলতি মৌসুমে প্রতিমণ আম ঢাকায় বিক্রি করেছি ৩২০০ টাকায়। এবারে এক হাজার থেকে বারো’শ টাকাতেও কেউ কিনছে না। পাকা আম পাঁচ টাকা কেজিতেও নিচ্ছে না কেউ। প্রচণ্ড গরমের কারণে আম দ্রুত পঁচে যাচ্ছে। ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ করে কুতুবপুর কলেজপাড়ার বাগান মালিক মশিউর রহমান বলেন, ‘এবারে ৫০০ গাছ কিনেছি। তাতে মোট ব্যয় হয়েছে ৭ লাখ টাকা। কিন্তু এবারে ৪ লাখ টাকার আম বিক্রি সম্ভব নয়। চিন্তায় দিশেহারা হয়ে পড়েছি। আর ১৫ দিন যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক থাকলে ধস থেকে রক্ষা পাইতো আম ব্যবসায়ীরা।’
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এবারে রংপুর কৃষি অঞ্চলের পাঁচ জেলায় প্রায় সাড়ে ৬ হাজার ৯৭৯ হেক্টর জমিতে হাঁড়িভাঙ্গাসহ অন্যান্য আম বাগান রয়েছে। এতে গাছের সংখ্যা রয়েছে প্রায় দুই লাখ ৫৭ হাজার। এরমধ্যে শুধুমাত্র রংপুর জেলায় হাঁড়িভাঙ্গা আমের জমি রয়েছে রয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ হেক্টর। এবারে শুধুমাত্র হাঁড়িভাঙ্গা আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫২ হাজার ১৯৮ মেট্রিকটন।
হাঁড়িভাঙ্গা আমের মাতৃগাছের জনক মৃত নফল উদ্দিন পাইকারের ছেলে খোড়াগাছা ইউনিয়নের তেকানী গ্রামের আম চাষি আমজাদ হোসেন পাইকার (৫৮) বলেন, ‘করোনার কারণে গত বছরও লোকশান হয়। এবারের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। যারা বাগানে আম কিনেছে লোকশানের কারণে এখন আর কেউ আম ছিড়তে আসছে না।’
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক বিধু ভূষণ রায় বলেন, ‘দেশের এমন পরিস্থিতিতে আম পরিবহণ করতে হলে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে চাষি ও ব্যবসায়ীদের সমন্বয় করতে হবে। সে ক্ষেত্রে স্থানীয় আম চাষিদের উদ্যোগ নিতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের তেমন কিছু করার নেই।’
তবে লোকশানের মুখে পড়লে আগামীতে বাগান মালিকরা আম চাষে আগ্রহ হারাবে বলে মনে করেন তিনি। সূত্র: কালেরকন্ঠ