মায়ের চেয়ে বাবার গুরুত্ব কম নয়। ‘বাবা’ এমন একটি শব্দ, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক আবেগ, অনুভূতি ও ভালোবাসা। সন্তানের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পর বাবার অবদানই সবচেয়ে বেশি।
হাদিসের বিখ্যাত গ্রন্থ ইবনে মাজাহতে বাবার মর্যাদা সম্পর্কে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
`তুমি এবং তোমার সম্পদ, উভয়টিই তোমার বাবার।’
ইসলামের দৃষ্টিতে, বাবা হল পরিবারের প্রধান। যিনি তার স্ত্রী এবং সন্তান উভয়ের প্রতিই দায়বদ্ধ। পরিবার ব্যবস্থায় পিতার উপস্থিতি অত্যাবশ্যক, বিশেষ করে উপার্জনকারী হিসাবে।
নিম্নে ইসলামে একজন পিতার ১০টি ভূমিকা উল্লেখ করা হল।
পরিবারের কর্তা হয়ে ওঠা
পরিবারের কর্তা হিসেবে বাবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। একজন নেতা হিসাবে পিতাকে অবশ্যই তার পরিবারের জন্য স্ত্রী এবং সন্তান উভয়ের কাছে একটি ভাল উদাহরণ স্থাপন করতে হবে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন,
وَ هُوَ الَّذِیۡ جَعَلَکُمۡ خَلٰٓئِفَ الۡاَرۡضِ وَ رَفَعَ بَعۡضَکُمۡ فَوۡقَ بَعۡضٍ دَرَجٰتٍ لِّیَبۡلُوَکُمۡ فِیۡ مَاۤ اٰتٰکُمۡ ؕ اِنَّ رَبَّکَ سَرِیۡعُ الۡعِقَابِ ۫ۖ وَ اِنَّهٗ لَغَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ ﴿۱۶۵﴾
আর তিনি সে সত্তা, যিনি তোমাদেরকে যমীনের খলীফা বানিয়েছেন এবং তোমাদের কতককে কতকের উপর মর্যাদা দিয়েছেন, যাতে তিনি তোমাদেরকে যা প্রদান করেছেন, তাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন। নিশ্চয় তোমার রব দ্রুত শাস্তিদানকারী এবং নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। [সুরা আল-আনআমঃ ১৬৫]
সন্তানকে সর্বোত্তমটা দিন
সন্তানের পিতার প্রতি নানা অধিকার রয়েছে। যেমন, তাদের সুন্দর নাম রাখা, সন্তানকে শিক্ষিত করা, তাদেরকে ভালো জায়গায় রাখা ইত্যাদি।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
“কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে তোমাদের (নিজস্ব) নামে এবং তোমাদের পিতাদের নামে ডাকা হবে। তাই তোমরা [সন্তানদের] ভালো নাম রাখো।” [সুনানু আবু দাউদ]
পিতার দায়িত্ব ভরণপোষণ করা
পিতা যে পরিবারের মেরুদণ্ডের ভূমিকা পালন করেন তা পবিত্র কুরআনে লেখা আছে। পিতা তার স্ত্রী ও সন্তানদের হালাল রিজিক দিয়ে ভরণপোষণ দিতে বাধ্য। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে বলেছেন,
اَلرِّجَالُ قَوّٰمُوۡنَ عَلَی النِّسَآءِ بِمَا فَضَّلَ اللّٰهُ بَعۡضَهُمۡ عَلٰی بَعۡضٍ وَّ بِمَاۤ اَنۡفَقُوۡا مِنۡ اَمۡوَالِهِمۡ ؕ فَالصّٰلِحٰتُ قٰنِتٰتٌ حٰفِظٰتٌ لِّلۡغَیۡبِ بِمَا حَفِظَ اللّٰهُ ؕ وَ الّٰتِیۡ تَخَافُوۡنَ نُشُوۡزَهُنَّ فَعِظُوۡهُنَّ وَ اهۡجُرُوۡهُنَّ فِی الۡمَضَاجِعِ وَ اضۡرِبُوۡهُنَّ ۚ فَاِنۡ اَطَعۡنَکُمۡ فَلَا تَبۡغُوۡا عَلَیۡهِنَّ سَبِیۡلًا ؕ اِنَّ اللّٰهَ کَانَ عَلِیًّا کَبِیۡرًا ﴿۳۴﴾
পুরুষরা নারীদের তত্ত্বাবধায়ক, এ কারণে যে, আল্লাহ তাদের একের উপর অন্যকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং যেহেতু তারা নিজদের সম্পদ থেকে ব্যয় করে। সুতরাং পুণ্যবতী নারীরা অনুগত, তারা লোকচক্ষুর অন্তরালে হিফাযাতকারিনী ঐ বিষয়ের যা আল্লাহ হিফাযাত করেছেনে। আর তোমরা যাদের অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাদেরকে সদুপদেশ দাও, বিছানায় তাদেরকে ত্যাগ কর এবং তাদেরকে (মৃদু) প্রহার কর। এরপর যদি তারা তোমাদের আনুগত্য করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কোন পথ অনুসন্ধান করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমুন্নত মহান। [সুরা নিসা ৪:৩৪]
একজন ন্যায়পরায়ণ স্বামী হওয়া
স্বামী হিসাবে পিতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হল একজন ন্যায়বান স্বামী হওয়া। একজন স্বামীকে অবশ্যই তার স্ত্রীর প্রতি ন্যায্য হতে হবে। বিশেষ করে যদি তার একাধিক স্ত্রী থাকে। মহান আল্লাহ কুরআনে বলেন,
وَ لَنۡ تَسۡتَطِیۡعُوۡۤا اَنۡ تَعۡدِلُوۡا بَیۡنَ النِّسَآءِ وَ لَوۡ حَرَصۡتُمۡ فَلَا تَمِیۡلُوۡا کُلَّ الۡمَیۡلِ فَتَذَرُوۡهَا کَالۡمُعَلَّقَۃِ ؕ وَ اِنۡ تُصۡلِحُوۡا وَ تَتَّقُوۡا فَاِنَّ اللّٰهَ کَانَ غَفُوۡرًا رَّحِیۡمًا ﴿۱۲۹﴾
আর তোমরা যতই কামনা কর না কেন তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে সমান আচরণ করতে কখনো পারবে না। সুতরাং তোমরা (একজনের প্রতি) সম্পূর্ণরূপে ঝুঁকে পড়ো না, যার ফলে তোমরা (অপরকে) ঝুলন্তের মত করে রাখবে। আর যদি তোমরা মীমাংসা করে নাও এবং তাকওয়া অবলম্বন কর তবে নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। [সুরা নিসা ৪ঃ ১২৯]
মেয়ের জন্য পাত্র খোঁজা
পরিবারের মেরুদণ্ড হওয়ার পাশাপাশি পিতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হল তিনি তার মেয়ের জন্য একজন উপযুক্ত পাত্র খুঁজবেন।
জাবির ইবনু আবদুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,
مَنْ كُنَّ لَهُ ثَلَاثُ بَنَاتٍ يُؤْوِيهِنَّ وَيَرْحَمُهُنَّ وَيَكْفُلُهُنَّ وَجَبَتْ لَهُ الْجَنَّةُ الْبَتَّةَ قَالَ قِيلَ يَا رَسُولَ اللَّهِ فَإِنْ كَانَتْ اثْنَتَيْنِ قَالَ وَإِنْ كَانَتْ اثْنَتَيْنِ قَالَ فَرَأَى بَعْضُ الْقَوْمِ أَنْ لَوْ قَالُوا لَهُ وَاحِدَةً لَقَالَ وَاحِدَةً
যার তিনটি কন্যা আছে এবং সে তাদের লালন-পালন করে, সে তাদের প্রতি করুণাশীল এবং সে তাদেরকে পোশাক-পরিচ্ছদ পরায়, তার জন্য অবশ্যই জান্নাত আবশ্যক।
বলা হলো, ইয়া রাসুলাল্লাহ, তার যদি মাত্র দুইজন [কন্যা] থাকে? নবীজি বললেন, এমনকি দুইজনও।
কেউ কেউ মনে করেন যে যদি সাহাবিরা বলতেন মাত্র একজন [কন্যা] তাহলে নবীজি একজনও বলতেন। [মুসনাদু আহমাদঃ ১৪২৪৭]
স্ত্রী ও সন্তানদের প্রতি পিতার কর্তব্য
একজন পিতার কর্তব্য হল তার স্ত্রী ও সন্তানদের যথাসম্ভব খাওয়ানো এবং বস্ত্র দেওয়া। এই বাধ্যবাধকতা কুরআনেই লেখা আছে। আল্লাহ কুরআনে বলেন,
আর পিতার উপর কর্তব্য, বিধি মোতাবেক মাদেরকে খাবার ও পোশাক প্রদান করা। সাধ্যের অতিরিক্ত কোন ব্যক্তিকে দায়িত্ব প্রদান করা হয় না। [সুরা বাকারা ২:২৩৩]
বাবার পরামর্শ শোনা
সুরা ইউসুফের কুরআনের এই আয়াতটি প্রমাণ করে যে নবি ইউসুফ আলায়হিস সালাম ছিলেন তার পিতার প্রতি কর্তব্যপরায়ণ পুত্র। তিনি তার বাবার পরামর্শ শুনেছিলেন। তার বাবা তাকে বলেছিলেন, ইউসুফ যেন তার স্বপ্নের কথা অন্য ভাইদের না বলেন।
قَالَ یٰبُنَیَّ لَا تَقۡصُصۡ رُءۡیَاکَ عَلٰۤی اِخۡوَتِکَ فَیَکِیۡدُوۡا لَکَ کَیۡدًا ؕ اِنَّ الشَّیۡطٰنَ لِلۡاِنۡسَانِ عَدُوٌّ مُّبِیۡنٌ ﴿۵﴾
সে বলল, ‘হে আমার পুত্র, তুমি তোমার ভাইদের নিকট তোমার স্বপ্নের বর্ণনা দিও না, তাহলে তারা তোমার বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র করবে। নিশ্চয় শয়তান মানুষের প্রকাশ্য দুশমন’। [সুরা ইউসুফঃ ৫]
আপনার পিতার কথা মেনে চলুন
পিতাকে মায়ের মতো সম্মান করতে হবে। আমাদের সর্বদা তাদের প্রতি অনুগত এবং বাধ্য হতে হবে। পিতার কথা মেনে চলার একটি অনুপম উদাহরণ হল নবি ইবরাহিম এবং তার পুত্র ইসমাইল আলাইহিস সালামের নিম্নলিখিত গল্প। আল্লাহ কুরআনে বলেছেন,
فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعۡیَ قَالَ یٰبُنَیَّ اِنِّیۡۤ اَرٰی فِی الۡمَنَامِ اَنِّیۡۤ اَذۡبَحُکَ فَانۡظُرۡ مَاذَا تَرٰی ؕ قَالَ یٰۤاَبَتِ افۡعَلۡ مَا تُؤۡمَرُ ۫ سَتَجِدُنِیۡۤ اِنۡ شَآءَ اللّٰهُ مِنَ الصّٰبِرِیۡنَ ﴿۱۰۲﴾
“আর যখন সে তার সাথে পরিশ্রমের বয়সে উপনীত হল, তখন সে বলল, হে বৎস, আমি স্বপ্নে দেখেছি যে আমি তোমাকে কোরবানি করব, তাই দেখ তুমি কি ভাবছ। আমার পিতা, আপনি যা আদেশ করেছেন তাই করুন। আল্লাহ যদি ধৈর্যশীলদের ইচ্ছা করেন তবে আপনি আমাকে পাবেন।” [সুরা আস সাফফাত ৩৭:১০২]
পিতার জন্য দুআ করা
পিতা-মাতা উভয়ের জন্য দুআ করতে বলেছেন আমাদের নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম। আল্লাহ কুরআনে বলেন,
رَبَّنَا اغۡفِرۡ لِیۡ وَ لِوَالِدَیَّ وَ لِلۡمُؤۡمِنِیۡنَ یَوۡمَ یَقُوۡمُ الۡحِسَابُ ﴿۴۱﴾
‘হে আমাদের রব, যেদিন হিসাব কায়েম হবে, সেদিন আপনি আমাকে, আমার পিতামাতাকে ও মুমিনদেরকে ক্ষমা করে দিবেন’। [সুরা ইবরাহিম ১৪:৪১]
সম্পূর্ণভাবে দায়িত্বশীল হওয়া
প্রত্যেক পিতা-মাতা উচিত তাদের সন্তান এবং তাদের ইসলামী বিকাশের জন্য সম্পূর্ণরূপে দায়বদ্ধ থাকা। পরকালে প্রত্যেক পিতাকে এর জন্য জবাবদিহি করতে হবে।
’আবদুল্লাহ ইবনু ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
أَلا كلُّكُمْ راعٍ وكلُّكُمْ مسؤولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ فَالْإِمَامُ الَّذِي عَلَى النَّاسِ رَاعٍ وَهُوَ مسؤولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ وَالرَّجُلُ رَاعٍ عَلَى أَهْلِ بَيْتِهِ وَهُوَ مسؤولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ وَالْمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ عَلَى بَيْتِ زَوْجِهَا وولدِهِ وَهِي مسؤولةٌ عَنْهُمْ وَعَبْدُ الرَّجُلِ رَاعٍ عَلَى مَالِ سَيِّدِهِ وَهُوَ مسؤولٌ عَنهُ أَلا فكلُّكُمْ راعٍ وكلكُمْ مسؤولٌ عَن رعيتِه
সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই এক একজন দায়িত্বশীল, আর (পরকালে) নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে তোমাদের প্রত্যেককেই জবাবদিহি করতে হবে। সুতরাং জনগণের শাসকও একজন দায়িত্বশীল লোক, তার দায়িত্ব সম্পর্কে তাকে জবাবদিহি করতে হবে। আর প্রত্যেক পুরুষ তার পরিবারের একজন দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে। আর স্ত্রী তার স্বামীর ঘর-সংসার ও সন্তান-সন্ততির ওপর দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে। এমনকি কোনো গোলাম বা চাকর-চাকরাণীও তার মুনীবের ধন-সম্পদের উপর একজন দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে। অতএব সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই এক একজন দায়িত্বশীল, আর তোমাদের প্রত্যেককেই স্বীয় দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হতে হবে। [সহিহ বুখারিঃ ৭১৩৮]