১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৫। পড়ন্ত দুপুর।
.
কাফরুলের পুরনো বিমানবন্দরের মাঠের ঝোপে সিমেন্টের খালি বস্তায় মোড়ানো আবর্জনার স্তুপের পাশে পড়েছিল সে। জন্মের পর মায়ের বুকের ওম পাওয়া হয়নি। আমাদের সমাজে পোয়াতি ঘরের নতুন অতিথির মুখে মধু দিয়ে বরণ করা হলেও নবজাতকটির ভাগ্যে মধু দূরে থাক, এক ফোঁটা পানিও জোটেনি।
.
একদল কুকুর সেই বস্তা ভেদ করে টেনেহিঁচড়ে ওকে নিজেদের খাবারে পরিণত করেছিল। খাবলে খেয়েছিল ওর আঙুল, নাক ও ঠোঁটের অংশ। কুকুরের ঘেউঘেউ শব্দে এগিয়ে যায় অনুসন্ধিৎসু কিশোরের দল। ঢিল ছুড়ে তাড়ায় ক্ষুধার্ত কুকুরগুলোকে। কিশোর দলের চোখ আটকে যায় একদিন বয়সী ছোট্ট একটি শিশুর রক্তাক্ত দেহের উপর। চিৎকার দেয় ওরা। ওই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় জাহানারা নামে স্থানীয় এক নারী এগিয়ে যান আবর্জনার মতো করে ছুড়ে ফেলা শিশুটাকে বাঁচাতে। পবিত্র প্রেমের বলি হওয়া থেকে বেঁচে যায় নিষ্পাপ শিশুটি।
.
বিয়ে বহির্ভূত পবিত্র প্রেম-ভালোবাসার এ এক অনিবার্য পরিণতি! ডাস্টবিনে কুকুরের মুখে খুবলে খুবলে খাওয়া নবজাতকের নিষ্পাপ দেহ, টয়লেটের কমোডে কিংবা হলের ট্রাংকে নবজাতকের লাশ। জাস্ট কয়েক মিনিটের সাময়িক আনন্দের জন্য নিষ্পাপ শিশুর রক্তে হাত রাঙায় তারই জন্মদাতা আর জন্মদাত্রীরা! মানবসভ্যতার কী করুণ এক পরিণতি! এই বিশ্বকাঠামো রঙচঙ মেখে কাছে আসার গল্প শেখায়। কিন্তু কাছে আসার গল্পের পরের দৃশ্য আর দেখায় না।
.
ডাস্টবিনে রাস্তায় নবজাতককে ছুড়ে ফেলার ঘটনাগুলো চোখে লাগে। সংবাদ শিরোনাম হয়। তবে এর চাইতেও আরো নিষ্ঠুরভাবে, আরো সিস্টেমেটিকভাবে ‘পবিত্র প্রেমের’ ফসল কোটি কোটি নিষ্পাপ শিশুকে হত্যা করা হচ্ছে। নীরবে, নিভৃতে। যা নিয়ে কোনো সংবাদ হয় না।
.
উল্টো মানবাধিকারের বুলি আওড়ানো সুশীল প্রগতিশীলরা নিষ্পাপ শিশুর মানবাধিকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রক্তের আদিম নেশায় হাততালি দেয়। আইনওয়ালারা চোখ বুজে ঘাড় ঘুরিয়ে থাকে। কেউ কেউ ‘গর্ভ যার, সিদ্ধান্ত তার’ এই যুক্তিতে বৈধতাও দিয়ে দেয় মানব ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য গণহত্যাগুলোর একটি–গর্ভপাতকে।
.
অন্ধকার যুগে মেয়ে নবজাতক হলে জীবন্তই পুঁতে ফেলা হতো। আর এখন এই অতি আধুনিক যুগে শুধু মেয়ে শিশু না, ছেলে শিশুকেও খুন করার জন্য ছুড়ে ফেলা হয় রাস্তার পাশের ডাস্টবিনে। আইয়ামে জাহিলিয়াতের চাইতেও নির্দয় আকারে ফিরে এসেছে মানবশিশু খুনের মহাউৎসব!
.
অপরাধ বিজ্ঞানী ফারজানা রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ড.আতিকুর রহমানসহ অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক অবক্ষয়ের কারণেই বিয়েবহির্ভূত অনেক ধরনের সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে নারী-পুরুষ। ফলে এমন বেওয়ারিশ নবজাতকদের জন্ম যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়ে গেছে জীবন্ত নবজাতককে ফেলে দিয়ে সব দায় থেকে নিষ্কৃতি চাওয়ার মতো ঘটনাগুলোও!
.
গর্ভপাতের প্রক্রিয়াটা খুবই নির্দয়, নিষ্ঠুর। সার্জিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট, ছুরি, কাঁচি ইত্যাদি দিয়ে গর্ভের শিশুকে টুকরো টুকরো করা হয়। শকুন বা কুকুর যেমন খুবলে খুবলে খায় মানুষের মৃতদেহ, ঠিক তেমন করেই খুবলে খুবলে মায়ের নিরাপদ গর্ভ থেকে বের করে নেওয়া হয় শিশুর শরীরের টুকরো–পা, পেট, পাঁজর, হাত, থেঁতলে ফেলা মাথা!
.
১৯৭৩ সালে গর্ভপাতকে বৈধতা দেবার পর গত ৪৭ বছরে কেবলমাত্র অ্যামেরিকাতেই ৬ কোটি ২০ লাখেরও বেশি শিশুকে গর্ভপাতের মাধ্যমে খুন করা হয়েছে। বলা হয়, হিটলার ৬০ লাখ ইহুদীকে খুন করেছিল। গর্ভপাতের মাধ্যমে অনাগত সন্তানদের হত্যা করার এই পরিমাণ হিটলারের ইহুদি নিধনের চাইতেও প্রায় ১০ গুণ বেশি! দশকের পর দশক জুড়ে পুরো পৃথিবী জুড়ে হিসেব করলে এই সংখ্যাটা কতো বড় হতে পারে… চিন্তা করতে পারো?
.
ফিরআউন বনী ইসরাইলের পুত্র সন্তানদের হত্যা করতো। আমাদের কাছে ফিরআউন ঘৃণিত, নিকৃষ্ট। অথচ এই আধুনিক পৃথিবী কোটি কোটি নিষ্পাপ শিশুদের নিষ্ঠুরভাবে খুন করাকে আইন করে বৈধতা দিয়েও সভ্য। খুন করাকে ঘাতক মায়ের অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। আর কোটি কোটি মানবশিশু খুন হবার পেছনে মূখ্য ভূমিকা রাখা প্রেম নামের যিনার জন্য গাওয়া হচ্ছে জয়গান। কী বিচিত্র ভণ্ডামি!
.
শীঘ্রই বিশাল এক মাঠে সমবেত হতে যাচ্ছি আমরা। আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত প্রত্যেকটি মানুষ সেখানে সমবেত হবে সারিবেঁধে। নতমুখে। আল্লাহর সামনে। একে একে আসবে ছুরি আর কাঁচিতে নিষ্ঠুরভাবে খুচিয়ে খুঁচিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলা সকল শিশু; ডাস্টবিন আর কমোডে ছুড়ে ফেলা সকল নবজাতক; কুকুরের মুখ থেকে বেঁচে ফেরা সকল নিষ্পাপ মানবাত্মা। বিচার দিবসের মালিক মহান আল্লাহর সামনে তারা তাদের অভিযোগ জানাবে। মালিকুল মুলক আল্লাহ সেইদিন বিচার করবেন। প্রশ্ন করবেন–সেই প্রশ্নের মুখোমুখি হবার সামর্থ্য কি তোমার হবে?
.
প্রবন্ধ: কাছে আসার আরেক গল্প
বই: আকাশের ওপারে আকাশ
মেহেজাবীন শারমিন প্রিয়া
My name is Mahazabin Sharmin Priya, and I am an author who studied Mathematics at the National University. I have a deep passion for writing in various genres, including Islam, technology, and mathematics. With my knowledge and expertise, I strive to provide insightful and engaging content to readers in these areas.