করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে ১৪ দিনের কঠোর বিধিনিষেধ চলছে। কিন্তু সাত দিন যেতে না যেতেই বিধিনিষেধের আওতায় থাকা বিভিন্ন খাত সংশ্লিষ্টরা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার দাবি তুলেছেন। এরই মধ্যে বিধিনিষেধের ১০ দিনের মাথায় রফতানিমুখী শিল্প-কারখানা খুলে দেয় সরকার। এখন মালিক-শ্রমিকরা দোকান-রেস্তোরাঁ, গণপরিবহন খুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন। চলমান লকডাউনের মেয়াদ শেষে ৫ আগস্টের পর কেউ আর বিধিনিষেধ মানতে চান না।
কিন্তু এর মধ্যে নিয়ন্ত্রণে আসেনি করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি। বরং দিনের পর দিন পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। প্রতিদিনই করোনায় আক্রান্ত হয়ে আড়াইশ মানুষ মারা যাচ্ছেন, আক্রান্ত হিসাবে শনাক্ত হচ্ছেন ১৫ হাজারের মতো। এর মধ্যে বিধিনিষেধ আরও ১০ দিন বাড়ানোর সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
এর ভেতরে রফতানিমুখী শিল্পকারখানার কর্মীদের কর্মস্থলে ফেরাতে শনিবার রাত থেকে রোববার রাত পর্যন্ত বাস এবং সোমবার দুপুর পর্যন্ত লঞ্চ চালু রেখেছিল সরকার।
দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতি উদ্বেগজনক পর্যায়ে চলে যাওয়ায় কয়েক মাস ধরে বিধিনিষেধ আরোপ করে তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে সরকার। ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে আট দিনের জন্য শিথিল করা হয়েছিল বিধিনিষেধ। এরপর আবার গত ২৩ জুলাই সকাল ৬টা থেকে ১৪ দিনের বিধিনিষেধ দেয়া হয়। আগামী ৫ আগস্ট মধ্যরাতে শেষ হবে সেই লকডাউন।
বিধিনিষেধে সব ধরনের গণপরিবহন, সরকারি-বেসরকারি অফিস বন্ধ। খাদ্যপণ্য উৎপাদন-প্রক্রিয়াকরণ, চামড়া পরিবহন-সংরক্ষণ ও ওষুধ খাত ছাড়া বন্ধ রয়েছে সব ধরনের শিল্পকারখানা। তবে ১ আগস্ট থেকে রফতানিমুখী শিল্পকারখানা খুলেছে। বন্ধ রয়েছে দোকান ও শপিংমল। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া মানুষের বাইরে বের হওয়াও নিষেধ।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী সোমবার রংপুর ডেইলীকে বলেন, ‘১৬ মাস ধরে করোনা চলছে। এর মধ্যে আমাদের গাড়ি চলছে ১১৩ দিন। আমরা সব সময় সরকারকে বলে আসছি, আপনারা ১০ টাকা কেজি দরে চাল দেয়ার কর্মসূচির আওতায় পরিবহন-শ্রমিকদের নিয়ে আসেন। এরপর বলেছি পরিবহন শ্রমিকদের দ্রুত টিকার আওতায় নিয়ে আসুন। প্রণোদনা চেয়েছি সেটাও বা কোথায়!’
তিনি বলেন, ‘আমরা ৩২ লাখ পরিবহন-শ্রমিককে প্রণোদনা (আড়াই হাজার টাকা করে) দেয়ার তালিকা দিয়েছিলাম। কিন্তু মাত্র দুই লাখ ৩৫ হাজার শ্রমিককে প্রণোদনা দেয়া হলো। আমি ওয়েবসাইট থেকে প্রজ্ঞাপন নিলাম। কিন্তু ডিসিরা বলছেন তারা প্রজ্ঞাপন পাননি। আমি তো মনে করি, প্রশাসনসহ কিছু লোক বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে গণজোয়ার তৈরি করার চেষ্টা করছে।’
৫ আগস্টের পর থেকে বাস চালুর দাবি জানিয়ে ওসমান আলী বলেন, ‘করোনার জন্য তো বাস মালিক-শ্রমিকরা দায়ী নন। সব খুলে দেয়া হয়, কিন্তু গাড়ি বন্ধ রাখা হয় কেন? আমরা সরকারের সঙ্গে কথা বলছি, আমাদের দাবি জানাচ্ছি। তারা শুধু বলেন, দেখছি। আমরা আশা করি, ৫ আগস্টের পর বাস চালাতে পারব। সরকার এ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখবে।’
ওসমান আলী আরও বলেন, ‘যারা একটি-দুটি গাড়ির মালিক তারা সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছেন। তারা কারও কাছে হাত পাততে পারছেন না। তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে নিদারুণ কষ্টে আছেন।’
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন (যাপ) সংস্থার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট বদিউজ্জামান বাদল রংপুর ডেইলীকে বলেন, ‘আগামী ৫ আগস্ট থেকে লঞ্চ যাতে চলাচল করতে পারে সেই অনুমতি চেয়ে আমরা সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছি। একই সঙ্গে লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত মালিকদের প্রণোদনা ও অনুদান দেয়ারও দাবি জানিয়েছি।’
‘আমরা সরকারকে জানিয়েছি নির্বিঘ্নে লঞ্চ চালাতে দিন। লঞ্চগুলো বসে থাকায় এর মেইনটেনেন্স খরচও অনেক। সরকারের ট্যাক্স তো কোনোটাই মাফ নেই। সবই আমরা দিচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘অনেক লঞ্চ মালিক আছেন, যারা এই লঞ্চের ওপর ভিত্তি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তারা অত্যন্ত কষ্টের মধ্যে পড়ে গেছেন। লঞ্চে শুধু মানুষই আসে না। নানা ধরনের পচনশীল পণ্যও আসে। সেগুলো শহরে আসছে না।’
বদিউজ্জামান বাদল বলেন, ‘তাই বলছি ৫ আগস্টের পর আমাদের ওপর যাতে লকডাউন না দেয়া হয়। আমাদের নির্বিঘ্নে লঞ্চ চালানোর সুযোগ দেন।’
আগামী ৫ আগস্টের পর বিধিনিষেধ তুলে দিয়ে সব দোকান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বিপণি-বিতান খুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি। রোববার রাজধানীর নিউমার্কেটে এক সংবাদ সম্মেলনে সমিতির সভাপতি হেলালউদ্দিন এ দাবি জানান।
তিনি বলেন, ২০২০ সালে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত মোট ২৭০ দিন দোকানপাট বন্ধ ছিল। সব মিলিয়ে গত দেড় বছরে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হয়েছে ২৭ লাখ কোটি টাকা।
অন্যদিকে ৫ আগস্টের পর স্বাস্থ্যবিধি মেনে হোটেল-রেস্তোরাঁ স্বাভাবিক নিয়মে খোলা রাখতে চান মালিকরা। তা সম্ভব না হলেও অন্তত অর্ধেক আসনে বসিয়ে হোটেল-রেস্তোরাঁ চালুর দাবি জানিয়েছেন তারা। সোমবার (২ আগস্ট) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি এ দাবি জানায়।
সংবাদ সম্মেলনে সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান লিখিত বক্তব্যে বলেন, মহামারি করোনাভাইরাসের আঘাতে রেস্তোরাঁ সেক্টর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন পর্যন্ত করোনার কারণে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী কখনো অর্ধেক আসনে বসিয়ে আবার কখনো শুধু অনলাইন/টেকওয়ের মাধ্যমে আমাদের ব্যবসা সীমিত রেখেছি। কিন্তু টেকওয়ে দিয়ে ব্যবসা চালানো সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, ‘এখন শুধু টেকওয়ে চলছে। তাতে বিক্রি হচ্ছে না। রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরা আজ দিশেহারা ও বর্তমানে নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত।’
৫ আগস্টের পর গণপরিবহনসহ সবকিছু খুলে দেয়ার দাবি জোরালো হচ্ছে- এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন রংপুর ডেইলীকে বলেন, ‘সবাই তাদের ভয়েস রেইজ করতে চাইবে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু সরকার সিদ্ধান্ত নেবে- কী করলে ভালো হবে। সবার আগে দরকার আমাদের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ।’
তিনি বলেন, ‘লাখ লাখ লোক রফতানিমুখী শিল্প-কারখানাগুলোয় কাজ করেন। বিদেশি ক্রেতারা রয়েছে, আমাদের শিল্প বন্ধ থাকলে এই অর্ডারগুলো অন্য দেশে চলে যাবে। আমাদের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এজন্য এটা খুলতে হয়েছে। একেকজনের বাস্তবতা একেক রকম, সেটা চিন্তা করতে হবে। সবকিছুর ওপর বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের করোনা।’
প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, ‘সরকার এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে। সবাইকে সুবিবেচক হয়ে সিদ্ধান্তটা গ্রহণ করতে হবে। পরবর্তী সিদ্ধান্ত আমরা (৩ আগস্ট) জানানোর চেষ্টা করবো। ওই দিন না হলে ৪ আগস্ট জানিয়ে দেয়া হবে।’