হাসান বসরি রাহ. এর দুটি শিক্ষামূলক গল্প, হাসান বসরি রাহ. জন্মগ্রহণ করেন ৬৪২ খ্রিষ্টাব্দে ও মৃত্যুবরণ করেন ৭২৮ খ্রিষ্টাব্দে। তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট আলিম, দায়ি ও দুনিয়াবিমুখ ব্যক্তিত্ব। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন রাসুল মুহাম্মাদ সাঃ–এর শহর মদিনায়। তিনি জীবনের দীর্ঘ একটি সময় রাসুলের সাহাবি ও তাবিয়িদের সাথে কাটানোর সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছিলেন, যা ছিল তাঁর মহান জীবন গড়ার অন্যতম ভিত্তি। তিনি নিজেও ছিলেন তাবিয়িদের একজন। তার দীর্ঘ ও ঘটনাবহুল জিবনে তিনি ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে সম্মানিত ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের একজনে পরিণত হন। তিনি তার দীনদারিতা, প্রজ্ঞা ও বাগ্মীতার জন্য সুপচিরিত।
হাসান বসরি রাহ. এর দুটি শিক্ষামূলক গল্প
হাসান বসরি রাহ. এর দুটি শিক্ষামূলক গল্প, হাসান বসরির শুরুর জীবনটা ছিল দুঃখ–কষ্টে ভরপুর। তাকে প্রচুর সংগ্রাম করতে হয়। তার পিতার নাম ছিল ইয়াসার। ইয়াসার ছিলেন রাসুল মুহাম্মাদ সাঃ–এর মুক্তিপ্রাপ্ত দাস। হাসান বসরির মা ছিলেন আবিসিনিয়ান।হাসান বসরি রাহ. এর দুটি শিক্ষামূলক গল্প, অল্প বয়স থেকেই হাসান বসরির মধ্যে প্রখর বুদ্ধিমত্তা ও জ্ঞানতৃষ্ণা দেখা গিয়েছিল। তিনি মদিনায় তার শিক্ষাজীবন শুরু করেন। কুরআন, হাদিস ও আরবি ব্যাকরণ অধ্যয়ন করেন তৎকালীন কিছু বিখ্যাত আলিমের অধীনে।
তবে হাসান বসরির তীব্র জ্ঞানতৃষ্ণা ও ব্যক্তিগত বিকাশের আকাঙ্খার কারণে তিনি কেবল মদিনাতেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। তিনি সমগ্র মুসলিম বিশ্বে জ্ঞান আহরণের জন্য ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি কুফা, বসরা ও দামেশকের মতো শহরে আলিম ও শিক্ষকদের অধীনে অধ্যয়ন করেন। তিনি ভ্রমণের কারণে ইসলামের বিভিন্ন শাস্ত্রে বিস্তৃত ও গভীর পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। তার পাণ্ডিত্য ও প্রজ্ঞার জন্য তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন।
নিজের ইলমি পরিক্রমার পাশাপাশি হাসন বসরি পরিচিত ছিলেন তার শক্তিশালী ও কার্যকর দাওয়াতের জন্য। তিনি বাগ্মিতায় অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। নিজের ইখলাস ও অলংকারপূর্ণ বক্তৃতা দ্বারা শ্রোতার হৃদয় জয় করে ফেলতে পারতেন। হাসান বসরি রাহ. এর দুটি শিক্ষামূলক গল্প, তার খুতবাগুলো পূর্ণ থাকত নানা জ্ঞানগর্ভ কথামালায়। নৈতিকতার ছাপ রাখতেন প্রতিটি কথায়। তিনি তার বক্তব্যকে তুলে ধরতে প্রায়ই বিভিন্ন উপমা ও গল্প ব্যবহার করতেন।
কেমন ছিলেন হাসান বসরি রাহ.
হাসান বসরির শিক্ষা ও লেখার ক্ষেত্র ছিল বিস্তৃত। তিনি ধর্মতত্ত্ব, ফিকহশাস্ত্র, নীতিশাস্ত্র এবং তাফসিরসহ বিভিন্ন বিষয়ে পড়িয়েছেন ও লিখেছেন। তিনি ইসলামের নৈতিক শিক্ষার এক প্রবক্তা ছিলেন। আন্তরিকতা, নম্রতা ও আত্ম–শৃঙ্খলার গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছিলেন তিনি। অনুতপ্ত হওয়া এবং তাওবার গুরুত্বকে তুলে ধরতেন তিনি। তিনি তার অনুসারীদের আত্মোন্নয়ন ও আধ্যাত্মিক বিকাশের জন্য প্রচেষ্টা চালাতে উৎসাহিত করতেন।
হাসান বসরির আধ্যাত্মিকতার শিক্ষাগুলো গভীরভাবে প্রভাবিত ছিল তার আপন অভিজ্ঞতা দ্বারা। তিনি মনে করতেন, আধ্যাত্মিকতার উন্নয়ন ঘটাতে হলে নিজের কলব ও নফসকে পরিশুদ্ধ করার আন্তরিক ইচ্ছা ও প্রচেষ্টা প্রয়োজন।হাসান বসরি রাহ. এর দুটি শিক্ষামূলক গল্প, সর্বদা আল্লাহর উপস্থিতির খেয়াল করা, তিনি আপনার–আমার ওপর নজর রাখছেন এই অনুভূতি লালন করা, আল্লাহর সামনে নিজেকে বিনয়নম্র রাখা এবং সর্বদা আল্লাহর প্রতি সন্তোষবোধ লালন করা – এগুলো আধ্যাত্মিকতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
হাসান বসরি রাহ. সর্বদাই মানুষকে ইলম ও প্রজ্ঞা অর্জনে অনুপ্রাণিত করতেন, এগুলোর গুরুত্ব বোঝাতেন। কারণ এসবের দ্বারাই রবের নিকটবর্তী হওয়া সহজতর হয়। তিনি বিশ্বাস করতেন, শুধু কিতাব অধ্যয়ন করে প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করা যায় না। প্রকৃতি নিয়ে ভাবনা ও আত্মদর্শনও জ্ঞানের একটি উৎস। আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে ইলম অর্জন করা এবং সেই ইলমকে অন্যের উপকারে ব্যবহারের নিয়তে ইলম অর্জনের ওপর গুরত্ব দিতেন হাসান বসরি রাহ.।
হাসান বসরিকে নিয়ে অনেক গল্প শোনা যায়
হাসান বসরির শিক্ষার আরেকটি গুরত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তিনি আত্মশৃংখলা ও আত্মসংযমের ওপর প্রচুর গুরুত্ব দিতেন। তিনি মনে করতেন, প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা অর্জন করতে হলে নিজের কামনাবাসনাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয় এবং নিজের ভেতর শান্তি ও প্রশান্তির সুগভীর অনুভূতির বিকাশ ঘটাতে হয়। তিনি তার অনুসারীদের জুহদ বা দুনিয়াবিমুখ হওয়ার শিক্ষা দিতেন, দুনিয়াবি সম্পদের প্রতি অত্যধিক আসক্তি পরিহার করতে বলতেন। সহজসরল ও বিনয়নম্র জীবনযাপন করার উপদেশ দিতেন।
১. নারী ও চোরের গল্প
একদিন হাসান বসরি বাজারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি দেখলেন এক চোর এক নারীর পার্স চুরি করছে। চোরটা চুরি করেই দ্রুত পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তিনি নারীটির কষ্ট টের পেয়ে দ্রুত হস্তক্ষেপ করলেন। তিনি চোরটির উদ্দেশে বললেন, “আল্লাহকে ভয় কর। যা নিয়েছ ফিরিয়ে দাও!” আশ্চর্যজনকভাবে চোরটি রাস্তায় দাঁড়িয়ে গেল।হাসান বসরি রাহ. এর দুটি শিক্ষামূলক গল্প, অনুশোচনাবোধ তাকে কাবু করে ফেলল। সে চুরি করা পার্সটা মহিলার হাতে ফেরত দিল এবং নিজের ভুলের কথা স্বীকার করল। হাসান বসরি এরপর চোরকে আন্তরিকভাবে তাওবা করতে বললেন এবং আল্লাহর কাছে বারবার ক্ষমা চাইতে বললেন।
এ ঘটনা থেকে বোঝা যায়, ন্যায়ের প্রতি হাসান বসরির নিষ্ঠা ছিল। এ ছাড়া তিনি তার কথাবার্তা ও উপস্থিতি তারা সবচেয়ে কঠোর হৃদয়ের মানুষদেরও প্রভাবিত করতে সক্ষম ছিলেন।
২. ইলমের মূল্য
একবার এক লোক হাসান বসরির কাছে এল। এসে ইলম ও প্রজ্ঞা অর্জনের ইচ্ছা প্রকাশ করল। লোকটি তার ইলম অন্বেষণের যাত্রা কোথা থেকে শুরু করবে সে সম্পর্কে হাসান বসরির নির্দেশনা চেয়েছিল। হাসান বসরি রাহ. এর দুটি শিক্ষামূলক গল্প, জবাবে হাসান বসরি লোকটিকে পাশের একটি নদীতে নিয়ে যান এবং পানিতে ডুব দিতে বলেন। লোকটি হতবাক হয়ে যায়, দ্বিধান্বিত হয়। তবে শেষ পর্যন্ত হাসান বসরীর নির্দেশ অনুসরণ করে।
ডুব দেওয়ার কিছুক্ষণ পর লোকটি পানির ওপর হাঁসফাঁস করতে করতে ভেসে ওঠে শ্বাস নেওয়ার জন্য। হাসান বসরি তাকে জিজ্ঞেস করেন, “পানির নিচে থাকার সময় কোন জিনিসটার আকাঙ্ক্ষা সবচেয়ে বেশী করছিলে?” লোকটি জবাব দেয়, “বাতাস! আমার বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন দরকার।” হাসান বসরি তখন লোকটিকে এক মূল্যবান শিক্ষা দিলেন। “যেভাবে তুমি পানির নিচে কাটানো কয়েক মূহুর্তে বাতাসের জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলে, ইলমের জন্যও তেমন পাগল হতে হবে তোমাকে। একইরকম আকাঙ্ক্ষা ও অধ্যবসায়ের সাথে ইলম অর্জন করবে। কারণ, তোমার শরীরের বেঁচে থাকার জন্য যেমন বাতাস দরকার, তেমনি তোমার আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য ইলম অপরিহার্য।”
হাসান বসরি ইলমের কতটা কদর করতেন এবং ইলমের মানুষকে পরিবর্তনের ক্ষমতা উঠে এসেছে এই গল্পে। তিনি মানুষকে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে ইলম অর্জন করতে বলতেন। কারণ আধ্যাত্মিক উন্নতি ও রবকে চেনার ক্ষেত্রে ইলমের বিকল্প নেই।
৩. নারীর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ
একদিন এক মহিলা কাঁদতে কাঁদতে হাসান বসরির কাছে বিচার ও সাহায্যের জন্য এলেন।। তাকে ব্যভিচারের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল যা ছিল সমাজের চোখে একটি গুরুতর অপরাধ।হাসান বসরি রাহ. এর দুটি শিক্ষামূলক গল্প, মহিলাটি বারবার নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করছিলেন। কিন্তু অভিযোগটা বেশ জোরালো মনে হচ্ছিল।
হাসান বসরি তার প্রজ্ঞা ও ন্যায় বিচারের জন্য সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। তিনি বিষয়টি আরো তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। যে ব্যক্তি ওই নারীকে অভিযুক্ত করেছে তাকে তার সামনে হাজির হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। অভিযোগকারী ব্যক্তি উপস্থিত হলে হাসান বসরি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি এই নারীর অপরাধের ব্যাপারে নিশ্চিত?”
লোকটি আত্মবিশ্বাসের সাথে উত্তর দিল, “হ্যাঁ, আমি তাকে নিজের চোখে এই কাজ করতে দেখেছি!”
হতাশ না হয়ে হাসান বসরি শান্তভাবে বললেন, “আচ্ছা বিচার তো করা হবে অবশ্যই। তবে আমি আপনাকে একটা বিষয় জানাতে চাই। আপনি কি জানেন, ইসলামি আইন অনুসারে, কারো ওপর ব্যভিচারের মিথ্যা অভিযোগ করার শাস্তি ব্যভিচারের শাস্তির মতোই কঠিন?”
এই কথা শুনে অভিযুক্ত ব্যক্তি কিছুটা কেঁপে ওঠে। নারীর ওপর সে যে মিথ্যা অভিযোগ করেছিল তা প্রত্যাহার করে নেয়। স্বীকার করে যে সে হিংসার বশবর্তী হয়ে মহিলার ওপর মিথ্যা অভিযোগ করেছে।
হাসান বসরি এভাবেই তার সুগভীর প্রজ্ঞা ও ন্যায়বিচারের ক্ষমতা দ্বারা নারীটিকে অন্যায় শাস্তির হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। মিথ্যা অভিযোগের গুরুতরতা শিক্ষাও মানুষকে দিয়েছিলেন।হাসান বসরি রাহ. এর দুটি শিক্ষামূলক গল্প, তার এই বিচারকার্য থেকে বোঝা যায়, বিচারকের কখনই তড়িঘড়ি করে বিচার করা উচিত নয়, অভিযোগের স্বপক্ষে দলিল–প্রমাণ যতই শক্তিশালী হোক না কেন। আর অবশ্যই বিচারের সময় দলিল–প্রমাণকে খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করা উচিত।
হাসান বসরি রাহ. তার জীবনে এমনই ছিলেন
পুরো জীবন জুড়েই হাসান বসরি ইসলামের মূলনীতিগুলো দৃঢ়ভাবে অনুসরণ করেছেন। হাসান বসরি রাহ. এর দুটি শিক্ষামূলক গল্প, সর্বদা অন্য মুসলিমদের কল্যাণার্থে কাজ করতেন তিনি। তার জীবন ও কর্ম আজও মুসলিম প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে। তার শিক্ষা ও লেখাগুলো আজও ইসলামি গবেষণা ও আধ্যাত্মিকতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।