সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলা শহরের পূর্ব দিকে বয়ে গেছে বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের প্রিয় নদী কালনী। এই নদীতীরেই আবদুল করিমের বাড়ি। পাহাড়ি ঢলের পানিতে গত বুধবার কালনী কানায় কানায় ভরা ছিল। কিন্তু গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে মানুষ ঘুম থেকে জেগে দেখে, নদীর পানি কমে গেছে দুই থেকে তিন ফুট। এত পানি গেল কোথায়? বাতাসের আগে খবর ছড়িয়ে পড়ে, এলাকার চাপতির হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে গেছে। নদীর পানি ঢুকেছে হাওরের পেটে। তলিয়ে গেছে হাওরের সব বোরো ধান।এদিকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক গতকাল সুনামগঞ্জে হাওর পরিদর্শনে আসেন। তিনি ধর্মপাশার ভেঙে যাওয়া চন্দ্রসোনার থাল হাওরের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন। এ সময় মন্ত্রী বলেন, হাওরে বাঁধ নির্মাণে কারও অনিয়ম বা গাফিলতি থাকলে তার বিরুদ্ধে টাস্কফোর্সের মাধ্যমে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গতকাল দুপুরে দিরাইয়ের চাপতির হাওরের তাজপুর ও কচুয়া গ্রামের পাশে গিয়ে দেখা যায়, হাওরে ঢলের পানি থই থই করছে। চৈত্রের কাঠফাটা রোদে মানুষ কাঁচা ধান কাটছেন। ছোট ছোট নৌকার করে সেগুলো আনছেন পাড়ে। নারী-শিশুরা সেই কাঁচা ধান তুলছে বাড়িতে। কচুয়া গ্রামের বাড়িঘর থেকে পা ফেললেই হাওর শুরু। হাওর থেকে ফেরা সঞ্জয় দাস (৬৩) ক্লান্ত শরীরে উঠানের এক কোণে একটি গাছের ছায়ায় বসেছিলেন। এই ধান কী করবেন জানতে চাইলে গামছা দিয়ে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে সঞ্জয় বলেন, ‘হাওর ডুবায় আমরা তো নিঃস্ব অইগিলাম, আর তো আর কোনতা রইল না। ধান নাই, খড়ও নাই। এখন ঘরের গরুর কিতা অই? এর লাগি কাঁচা ধান কাইট্যা আনছি। এসব তো মানুষে খাওয়ার উপযুক্ত অইছে না।’চাপতির হাওরে দিরাই উপজেলার জগদল, করিমপুর ও তাড়ল ইউনিয়নের ৪৬টি গ্রামের মানুষের ফসলি জমি রয়েছে। আর সপ্তাহখানেক সময় পেলেই মানুষ ধান কাটা শুরু করতে পারতেন। কিন্তু এখন সেই ধান চোখের সামনে তলিয়ে যাচ্ছে।
‘প্রশাসনের কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, কৃষকসহ সবাই মাঠে আছেন। আমরা হাওরের ফসল রক্ষায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। তবে এখনো বড় হাওরগুলো সুরক্ষিত আছে।কচুয়া গ্রামের মাঝহাটিতে হাওরপারের খলায় মনমরা হয়ে বসে ছিলেন আবুল হোসেন (৫০)। তাঁর বাড়ির পাশের গ্রাম তাজপুরে। জমি চাষ করার সুবিধার্থে কার্তিক মাসে পরিবারের সবাইকে নিয়ে এসে এখানে টিন দিয়ে অস্থায়ী একটি ঘর করে থাকছেন। ফসল নিয়ে বাড়ি ফেরার কথা ছিল। কিন্তু এখন হাওরের দিকে তাকিয়ে কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন।
আবুল হোসেন জানান, হাওরে চুক্তিতে অন্যের ১২ একর জমি আবাদ করেছিলেন। তাঁর পাঁচ ছেলেকে নিয়ে কাজ করেছেন। এতে খরচ হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। ধারদেনা করে আনা এই টাকা ফসল তোলার পর শোধ করার কথা। কান্নার দমকে কথা আটকে আসে এই কৃষকের। বলেন, ‘এখন খাইতাম কিলা? কিলা একটা বছর চলতাম, এই চিন্তায় আছি।’হাওরপারেই কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন চণ্ডীপুর গ্রামের কৃষক আফাজ মিয়া (৪০)। তাঁর সব ক্ষোভ বাঁধ নিয়ে। জানালেন, বাঁধের কাজ সময়মতো হলে এভাবে এই হাওর ডুবত না। বাঁধের কাজের মান, তদারকিতে ঘাটতি ছিল। কেউই খোঁজ নেয়নি। আফাজ মিয়া বলেন, ‘বাঁধ দিছে আওয়ামী লীগের লোকজন, এর লাগি কেউ কোনো কথা খইতে সাহস পাইছে না।’
বাঁধের কাজ সময়মতো হলে এভাবে এই হাওর ডুবত না। বাঁধের কাজের মান, তদারকিতে ঘাটতি ছিল।এক সপ্তাহ ধরে ভারতের মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টিপাতের কারণে পাহাড়ি ঢল নামছে। এতে অস্বাভাবিকভাবে সুনামগঞ্জ জেলার নদ-নদী ও হাওরের পানি বাড়ছে। ঝুঁকিতে পড়েছে জেলার সব হাওরের ফসল। একে পর পর এক হাওরের বাঁধ ভেঙে ফসল তলিয়ে যাচ্ছে। মানুষজন দিনরাত বাঁধে অবস্থান করে স্বেচ্ছাশ্রামে কাজ করছেন। গত শনিবার প্রথমে বাঁধ ভেঙে তাহিরপুরের টাঙ্গুয়ার হাওরের ফসল তলিয়ে যায়। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাতে বাঁধ ভেঙে ফসলহানি ঘটে চাপতির হাওরে।সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘প্রশাসনের কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, কৃষকসহ সবাই মাঠে আছেন। আমরা হাওরের ফসল রক্ষায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। তবে এখনো বড় হাওরগুলো সুরক্ষিত আছে। আশা করছি পরিস্থিতির উন্নতি হবে।’