কিছু মানুষ মনে করে, অ্যাডভারটাইজমেন্ট বা বিজ্ঞাপন তার জন্য কোনো সমস্যা না। ফ্রি সার্ভিস যেহেতু নিচ্ছি, বিজ্ঞাপন তো থাকবেই। তারা আমাকে বিজ্ঞাপনের ফাদে ফেলতে পারবে না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, যে ব্যাক্তিকে বিজ্ঞাপনের ফাদে ফেলা হচ্ছে, তার কাছে বিজ্ঞাপনদাতার গ্রাহককে আকৃষ্ট করার কৌশলগুলো অজানা থাকে। ফলে যে ব্যক্তি মনে করেন তিনি বিজ্ঞাপনের ফাদ থেকে নিরাপদ, তিনিই সবার আগে এ ফাদে পা দেন। বিজ্ঞাপনের দ্বারা মানুষের মনস্তত্ত্বকে নিয়ন্ত্রণের ইতিহাস লম্বা। যেহেতু সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যক্তির সামনে বিজ্ঞাপন আসে অ্যালগরিদমের মাধ্যমে, তাই অনেক সময় ইউজার বুঝতে পারেন না তার সাথে কি ঘটছে। কারণ, টিভিতে বা বিলবোর্ডে একই বিজ্ঞাপন সবার সামনে দেখানো হলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিটা ব্যক্তির সামনে ভিন্ন ভিন্ন বিজ্ঞাপন আসে। আর কোন বিজ্ঞাপন আসবে সেটা ঠিক করে অ্যালগরিদম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে। ব্যক্তির ওয়েব সার্চ, চ্যাটিং, তিনি কোথায় যাচ্ছেন, তার মানসিক অবস্থা – ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হয়। সোশ্যাল মিডিয়াকে ডিজাইনই করা হয়েছে আসক্তিপ্রবণ করে। এটা আমার কথা নয়, যারা সোশ্যাল মিডিয়ায় কাজ করেছেন তারা নিজেরাই এর স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। তাদের মূল উদ্দেশ্য কীভাবে আপনার মনোযোগ দখল করা যায়। কেন? কারণ, আপনি যত বেশী সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় কাটাবেন, তারা আপনাকে তত বেশী বিজ্ঞাপন দেখাতে পারবে। যত বেশী বিজ্ঞাপন দেখা হবে, পণ্য কেনার পরিমাণও তত বেড়ে যাবে। ফলে বিজ্ঞাপনদাতা কোম্পানি লাভবান হবে। বিজ্ঞাপন সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়ায় তারাও লাভবান হবে। তারা যে কোনো মূল্যে আপনার মনোযোগ কাড়তে চায়। এ জন্য যত প্রকারের মনস্তাত্ত্বিক কৌশল খাটানো সম্ভব, তারা এর সবগুলোই প্রয়োগ করে।
ধরুন, আপনি ইউটিউবে একটা বড় সময় ব্যয় করেন। ইউটিউবের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ফেইসবুক। আপনি ইউটিউবে বেশি সময় দিলে ফেইসবুকে ততটা সময় দিতে পারবেন না। নেটফ্লিক্সের সিইও কিছুদিন আগে বলেছেন, তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে ফেইসবুক, ইউটিউব এবং ঘুম। ঘুম কেন? কারণ, আপনার সারাদিনের সময়টা সীমিত – ২৪ ঘন্টা মাত্র। যেটুকু সময় ঘুমে থাকছেন, তারা ওই সময়টায় আপনাকে বিজ্ঞাপন দেখাতে পারবে না। এক সাইটে সময় বেশী দিলে অন্য সাইটে সময় কমে যাবে। তারা যদি আপনার সময় কাড়তে ব্যর্থ হয়, তাহলে অন্য কোনো অ্যাপ আপনার সময় কেড়ে নেবে। তাই এ সোশ্যাল মিডিয়া ও এন্টারটেইনমেন্টগুলো এক মারাত্মক প্রতিযোগীতায় লিপ্ত – কীভাবে আপনার মনোযোগ আকর্ষণ করা যায়, কীভাবে আপনাকে সর্বোচ্চ সংখ্যক বিজ্ঞাপন দেখিয়ে নিজেদের মুনাফার সর্বোচ্চকরণ করা যায়। সবাই আমাদের জীবনের মহামূল্যবান সময় কেড়ে নেওয়ার প্রচেষ্টারত।
কিন্তু আপনি জানেন এ সময় কতটা মূল্যবান? —– আল্লাহ সুরা আল আসরে সময়ের শপথ করেছেন। আল্লাহ কেবল এমন বিষয়েরই শপথ নেন যার অন্তর্নিহিত মূল্য অভাবনীয়, যেন মানুষকে সে বিষয়ের গুরত্ব বোঝাতে পারেন। এরপরে তিনি বলেছেন, নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতির মধ্যে আছে। সময়ের ব্যাপারে একজন মুসলিমের কর্তব্য হচ্ছে, সময়ের যথাযথ সংরক্ষণ করা। মানুষ যেভাবে নিজের সম্পদের সংরক্ষণ করে, ঠিক একইভাবে সময়েরও সংরক্ষণ করতে হবে। বরং তার চেয়েও অধিক গুরত্ব দিতে হবে যেমনটা হাসান বসরি রাহ. বলেছেন, ‘আমি এমন অনেককে পেয়েছি, যারা দিনার-দিরহামের চেয়ে সময়ের ব্যাপারে অধিক কৃপণ ছিলেন।’
সোশ্যাল মিডিয়া, ইন্টারনেফ অফ থিংস ও সর্বদা ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত থাকার কারণে বিশ্বের একটা বিশাল জনসংখ্যা সর্বদা নজরদারিতে রয়েছে। তারা কি খাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে তার কোনোকিছুই টেক জায়ান্ট বা গভর্নমেন্টের কাছে অজানা থাকছে না। ফেইসবুক, টুইটার, ইউটিউবে আসক্ত হওয়ার কারণে মানুষের মাঝে প্রতিনিয়ত আচরণগত পরিবর্তন হচ্ছে। তরুণরা মারাত্মক ডিপ্রেশন, অ্যানজাইটিসহ অন্যান্য মানসিক সমস্যায় ভুগছে। সোশ্যাল মিডিয়ার অতিরিক্ত ব্যবহার বা অন্যান্য কারণে তাদের জীবনে স্ট্রেস তৈরী হচ্ছে। কিন্তু তারা স্ট্রেস মোকাবিলার জন্য, স্ট্রেসের যন্ত্রণাকে ভুলে থাকার জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার রঙ্গিন জগতে ডুবে থাকছে যেগুলো তাদের হয়তো সাময়িক স্বস্তি দিতে পারছে জীবনের নানা সমস্যা থেকে, কিন্তু মূল সমস্যা অভ্যন্তরে থেকেই যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা অসংখ্য গবেষণায় প্রমাণ পেয়েছেন, যারা সোশ্যাল মিডিয়ায় অধিক সময় ব্যয় করে তাদের ডিপ্রেশনের হার তুলনামূলক বেশি থাকে। সোশ্যাল মিডিয়া এমন এক অস্ত্র যা ব্যবহার করে শয়তান তার অন্যতম দুটো উদ্দেশ্য হাসিল করে।
প্রথমত, এটা আপনাকে এক মিথ্যা ভার্চুয়াল সামাজিক জীবনে জড়িয়ে রাখে। ফলে, আপনি বাস্তবের সামাজিক জীবন থেকে দূরে থাকেন। জীবনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে আমাদের মনোযোগ থাকে না। আল্লাহর নির্ধারিত আদেশ-নিষেধ পালনের প্রেরণা কাজ করে না।
দ্বিতীয়ত, এ অস্ত্রের মাধ্যমে শয়তান আপনাকে পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। আপনার জীবন হয়ে যায় একাকী, নি:সংগতাময়। আর মানুষ একাকী অবস্থাতেই অধিক পাপ করে। মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ তৈরীর দ্বারা তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে পাপের সাগরে নিমজ্জিত করার জন্য শয়তানের এক আদর্শ হাতিয়ার। শয়তানের নিজস্ব সেনাবাহিনী আছে। তার আসনে থেকে সে বিভিন্ন সেনাদলকে নানান জায়গায় বিভিন্ন উদ্দেশ্যে প্রেরণ করে। যারা সবচেয়ে বেশি ফিতনা ও ফাসাদ সৃষ্টি করতে সক্ষম, তারা শয়তানের তত নিকটবর্তী। জাবির র. থেকে বর্ণিত আছে যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ইবলিস পানির ওপর তার সিংহাসন স্থাপন করে। তারপর সেখান থেকে সে তার বাহিনীকে মানুষকে ফিতনায় ফেলার জন্য পাঠায়। যে সবচেয়ে বড় ফিতনা সৃষ্টিকারী – সে তার সবচেয়ে নৈকট্যপ্রাপ্ত। তাদের কেউ তার কাছে এসে জানায়, ‘আমি অমুক অমুক কাজ করেছি।’ ইবলিস বলে, ‘তুমি কিছুই করোনি।’ তারপর আরেকজন এসে রিপোর্ট করে, ‘আমি ততক্ষণ তাকে ছেড়ে যাইনি, যে যাবত না তার ও তার স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি করেছি।’ ইবলিস তাকে কাছে টেনে বলে, ‘তুমিই আমার লোক।’ এ হাদিস নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করা উচিত। মদ্যপান হারাম, বিনা অপরাধে মানবহত্যা হারাম, জিনা-ব্যভিচার হারাম। কিন্তু ডিভোর্স হারাম নয়। তবে কেন শয়তান একটা হালাল কাজ নিয়ে এত উত্তেজিত? ঐক্যবদ্ধ জাতিকে পরাজিত করা কঠিন। এ জন্য শত্রুরা চায় বিভেদ ঘটিয়ে বিজয় আনয়ন করতে। ডিভোর্সের মাধ্যমে সমাজের সবচেয়ে মৌলিক ইউনিট অর্থাৎ পরিবার ভেঙ্গে যায়। একটা সমাজ অসংখ্য পরিবার দ্বারাই গঠিত হয়।
ঠিক যেভাবে শত শত ইটের গাথুনিতে দেয়াল গড়ে ওঠে, তেমনি শত শত শক্তিশালী পরিবারের মাধ্যমে শক্তিশালী সমাজ গড়ে ওঠে। ভংুর ইটের কারণে দেয়াল যেমন দুর্বল হয়ে যায়, ভঙ্গুর পরিবারের কারণে সমাজও দুর্বল হয়ে যায়। এসব তথ্যপ্রযুক্তি আসার আগে শিশুরা বিভিন্ন ইনডোর ও আউটডোর খেলায় মেতে থাকত, পরিবারের সাথে সময় কাটাত। কিন্তু প্রযুক্তিপণ্য আসার পর থেকে শিশুরা ফেইসবুক, ইউটিউব, টুইটারে দিনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করছে। আমাদের এসব বিষয়ে নজরদারি করতে হবে। শিশুদের সাথে সময় কাটাতে হবে, তাদের সংগ দিতে হবে। আজ তাদের পাশে থাকলে তারা আগামীতে আমাদের পাশে থাকবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্যের জীবন দেখে সে নিজেকে সেটার সাথে তুলনা করতে থাকে। তার বন্ধুর আইফোন টেন থাকলে সে নিজেও আইফোন টেন কিনতে চায়, অন্যের কাছে গেইমিং কম্পিউটার দেখলে সে নিজেও গেইমিং কম্পিউটার কিনতে চায়। এভাবে সে দুনিয়াবি আরামআয়েশে মত্ত হয়ে পড়ে। অথচ, দুনিয়াবি এসব আরামআয়েশ মরীচিকা ব্যতিত কিছুই নয়। তাই এসবের পেছনে ছুটতে থাকা বোকামি। যদি সত্যিকার অর্থেই তুলনা করতে হয়, তবে সৎকর্মের সাথে তুলনা করতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়াকে এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যেন আপনি নিজেই পণ্যে পরিণত হন। ফেইসবুকের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট শন পার্কার বলেন, “ফেইসবুক যখন মানুষের মাঝে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল তখন মানুষ আমার কাছে এসে বলত, ‘আমি সোশ্যাল মিডিয়াতে নেই।’ আমি বললাম, ‘সমস্যা নেই, তুমিও এসে পড়বে এই জগতে।’ এরপর তারা প্রতিবাদ করে বলত, ‘না, না। আমি বাস্তব জীবনের সামাজিকতাকে মূল্য দেই। নিজের সময়কে মূল্য দেই। পারস্পরিক মেলামেশাকে পছন্দ করি। ভার্চুয়াল দুনিয়ায় এসে এসব হারিয়ে ফেলতে চাই না।’ আমি তাদেরকে কনফিডেন্সের সাথে বলতাম, ‘তুমি একসময় না একসময় এখানে আসবেই।’ যদি আমি জানতাম তাদেরকে যা বলছি সেটা বাস্তবে রূপ নিলে তার ফলাফল কতটা ভয়াবহ হবে তবে আমি কোনোদিনও সেটা বলতাম না। কারণ, একটা নেটওয়ার্কে যখন ১০০ বা ২০০ কোটি মানুষ সংযুক্ত থাকে, তখন সমাজের সাথে আমাদের সম্পর্কটাই পুরোপুরি বদলে যায়। স্রষ্টাই ভালো জানেন আমাদের সন্তানদের ওপর এসব মিডিয়া কেমন বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলছে।