টাবলুর মনটা আজ ভালো নেই।কারণ সে স্কুলে যেতে পারেনি।বাইরে কি বৃষ্টি!সকালটা ঘরে শুয়ে বসেই কাটলো।দুপুরের ঘুমের পর বিকেলে সাইকেল নিয়ে বের হয়েছে টাবলু।সাইকেল চালাতে চালাতে হঠাৎ গেল পড়ে।আশেপাশের ছেলেমেয়েগুলো দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো।টাবলুর এত খারাপ লাগলো!হঠাৎ কোথা থেকে একটা ছেলে ছুটে এলো।টাবলুর বয়সীই হবে।টাবলুকে টেনে তুললো ছেলেটি।
-ওঠো,ওঠো।কোথাও ব্যথা পাওনাই তো?
-হাঁটুতে পেয়েছি একটু।
-তোমার বাসা কই?চলো দিয়ে আসি।
-আচ্ছা চলো।
ছেলেটি টাবলুর সাইকেল টেনে নিয়ে যাচ্ছে।পাশে টাবলু।সমবয়সী হওয়ায় দুজনের মাঝে ভালোই কথা জমে উঠেছে।
-তোমার নাম কি?
-টাবলু।ভালো নাম তীর্থ মজুমদার।
-আমার নাম সেলিম।ভালো নামও সেলিম।
-হাহাহা….কোন ক্লাসে পড়ো তুমি?
-সেভেনে।
-আরে আমিও তো সেভেনে।
-আমার কোনো বন্ধু নাই।তুমি আমার বন্ধু হবা?
-হ্যাঁ, হবো।
এভাবেই শুরু হলো টাবলু আর সেলিমের বন্ধুত্ব।দুজনের স্কুল আলাদা হওয়ায় বিকেল ছাড়া একসাথে হওয়ার উপায় নেই।তাই প্রতিদিন বিকেলে টাবলু সাইকেল নিয়ে বের হয় শুধু সেলিমের জন্য।মাঝে মাঝে সেলিমকে নিজের বাড়িতেও নিয়ে আসে;গল্প করে।টাবলুর মা অবশ্য সেলিমের মত একটা মা-হারা নিচু জাতের ছেলের সাথে নিজের ছেলের মেলামেশা অতটা ভালো চোখে দেখেন না।কিন্তু টাবলু মন খারাপ করবে বলে সেলিমকে নিষেধও করতে পারেন না।
যাই হোক,এভাবেই চলছে টাবলু আর সেলিমের নিষ্পাপ বন্ধুত্ব।
একদিন বিকেলে-
-সেলিম,কালকে আমার জন্মদিন।
-তাই নাকি?
-হ্যাঁ।বাবা বলেছে এবারের জন্মদিনে বড় একটা কেক আনবে।অনুষ্ঠান করবে।
-আমি যাব সেই অনুষ্ঠানে?
-তা যাবি না? তোকে ছাড়া কেকই কাটব না।
-জানিস,মা বেঁচে থাকতে একবার আমারও জন্মদিন হইছিল।কেক কাটছিলাম।মা টাকা জমায় দামী একটা উপহারও দিছিলো। খুব মজা হইছিল।
-কালকেও হবে।তাড়াতাড়ি আসবি।
-আচ্ছা।আমি সবার আগে যাব।
-হাহাহা
আজ টাবলুর জন্মদিন।সেলিম একটু আগেই চলে এসেছে। টাবলুদের বসার ঘরটা কি সুন্দর করে সাজানো হয়েছে আজ!চারদিকে রং বেরং এর বেলুন,কাগজ,লাইট।অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি সুন্দর লাগছে।কতরকম খাবার চারদিকে!অনেক বড় একটা কেক এসেছে।এত কিছু দেখে লোভ সামলানো মুশকিল।
আত্মীয়রা আসতে আরো অনেক সময় বাকি আছে।টাবলু সেলিমের সাথে বসে গল্প করছে।রাতে মা বাবা ওকে কি কি দিলো সেইসব দেখাচ্ছে।মা দিয়েছেন একটা ভিডিও গেম।সেলিমকে গেমটা বুঝিয়ে দিলো টাবলু।বাবা দিয়েছেন একটা সোনার চেইন।টাবলু গলায় পরেছে সেটা।চেইনটা দেখে সেলিমের চক্ষু ছানাবড়া….অবাক চোখে তাকিয়ে আছে চেইনটার দিকে।কিছু একটা বলতে যাবে,তখন এলো টাবলুর মা।
-টাবলু,তাড়াতাড়ি স্নান করে রেডি হয়ে নে,বাবা। গেস্টরা চলে আসবেন আর কিছুক্ষণের মধ্যে।
টাবলু আর পাঁচ মিনিট সেলিমের সাথে ভিডিও গেম খেলে স্নান করতে চলে গেল।
অতিথিরা সবাই চলে এসেছেন।টাবলুর কেক কাটা হবে এখন।তার আগে কেক কাটার ভঙ্গিতে পোজ দিয়ে ছবি তোলা হবে।ছবি তুলতে গিয়ে টাবলুর বাবা হঠাৎ খেয়াল করলেন টাবলুর গলায় সোনার চেইনটা নেই।
-এ কি!টাবলু!তোর জন্মদিন উপলক্ষ্যে যে সোনার চেইনটা দিলাম রাতে সেটা গলায় দিস নি কেন?
-মানে?রাত থেকে আমার গলায়ই তো ছিল ওটা।কিছুক্ষণ আগে সেলিমকেও তো দেখালাম।
-গলায় ছিল তো কোথায় গেল?
চারিদিকে হৈ চৈ পড়ে গেল।সবাই মেঝেতে দেখতে লাগলো পড়ে টড়ে গেছে নাকি।কিন্তু ঘরের কোথাও পাওয়া গেলনা চেইনটা।হঠাৎ টাবলুর মা বললেন-
-টাবলু,তুই তো সেলিমকে দেখিয়েছিলি একটু আগেই।ওর কাছে নেই তো আবার?
-কি বলছো তুমি!সেলিমের কাছে থাকবে কি করে?
-ও নিয়েছে বলছি না,খেলতে গিয়ে ওর কাছে পড়েও তো যেতে পারে।ওর জামাকাপড়ের কোথাও আঁটকে আছে হয়তো।খুঁজে দেখি।
টাবলু তেমন কিছু বলতে পারলো না।সেলিম অবাক হয়ে সব দেখছে।কোথা থেকে কি হয়ে যাচ্ছে ও বুঝতে পারছে না।টাবলুর মা সেলিমের শার্টের পকেট,প্যান্টের পকেট চেক করতে লাগলেন।তারপরই ঘটলো ঘটনাটা।সেলিমের প্যান্টের পকেটে পাওয়া গেল সোনার চেইন।টাবলুর মা চেইনটা বের করলেন।
টাবলু অবাক হয়ে গেছে।সেলিম অবশেষে চুরি করলো!-মনে মনে এই কথা ভেবে তার ভীষণ কষ্ট হলো।
সেলিম টাবলুর সাথে কথা বলার জন্য এগিয়ে যেতেই টাবলু চিৎকার করে উঠলো-
-সেলিম,তুই চুরি করেছিস?কেন করেছিস?তুই বন্ধু নাকি শত্রু?
সেলিম তাকিয়ে আছে টাবলুর দিকে।
-তোকে কোনোদিনও রাস্তার ছেলে ভাবিনি।আপন করে নিয়েছি।আর সেই তুই চুরি করলি?চোর কোথাকার।
বলতে বলতে টাবলু কেঁদে ফেলেছে।সেলিম এখনও অবাক দৃষ্টিতে টাবলুর দিকে তাকিয়ে আছে।তার চোখও ভেজা।
টাবলু মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো-
-এই চেইন ওকে দিয়ে দাও, মা।বন্ধুত্বের চেয়ে একটা সোনার চেইনই যখন ওর কাছে বড় তখন থাকুক ও এই চেইন নিয়ে।চলে যা সেলিম এখান থেকে।আর কোনোদিন আমার সামনে আসবি না।
এই বলে কাঁদতে কাঁদতে নিজের ঘরে চলে গেল টাবলু।
টাবলুর মা অনিচ্ছা সত্ত্বেও চেইনটা সেলিমকে দিয়ে দিলো।চেইন নিয়ে মাথা নিচু করে চলে গেল সেলিম।
কয়েকমাস পরের ঘটনা।টাবলুর বাবার ঢাকায় বদলি হয়েছে।এই শহর ছেড়ে চলে যাবে টাবলুরা।আজকে ওরা চলে যাচ্ছে।মালপত্র বোঝাই হয়েছে ট্রাকে।আর কিছুক্ষণ পরেই গাড়িতে উঠবে ওরা।
এমন সময় সেলিম এলো।জন্মদিনের ঘটনার পর আর দেখা হয়নি ওদের।টাবলুরা চলে যাবে শুনে টাবলুর সাথে শেষ দেখা করতে এসেছে সেলিম।কিন্তু সেলিম কাছে আসতেই টাবলু, “চোর কোথাকার।তুই আবার এসেছিস?চলে যা” বলে সেলিমকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো।তারপর গাড়িতে উঠে বসলো।
টাবলুদের গাড়ি ছেলে দিলো।রাস্তায় পড়ে থাকলো সেলিম।
বেশ কয়েকবছর কেটে গেছে।টাবলু এখন বিরাট অফিসার।বিয়েও করেছে কিছুদিন আগে।এক শুক্রবারের রোদেলা সকালে টাবলুর মা নতুন বৌকে টাবলুর ছোটবেলার গল্প শোনাচ্ছে।পাশে বসে ল্যাপটপে অফিসের কাজ করছে টাবলু।
-এই দেখো,বউমা।এটা আমার টাবলুর ছোটবেলার গাড়ি।সারাদিন এটা নিয়ে ভুমভুম করে বেড়াতো।রাতে ঘুমোতোও এই গাড়ি নিয়ে।
বউমা মুচকি হাসলো।
-আর এটা আমার টাবলুর চেইন।ওর এক জন্মদিনে ওর বাবা ওকে দিয়েছিল।
চমকে উঠলো টাবলু।সেই সোনার চেইন এখানে কি করছে?এটা তো সেলিমকে দিয়ে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল।
বউকে চা করতে পাঠিয়ে টাবলু মা কে চেপে ধরলো-
-এই সোনার চেইন টা তোমার কাছে কি করে এলো,মা?
মা চুপ করে আছেন।
-কি হলো?চুপ করে থেকো না, মা।তোমাকে বলতেই হবে।
মা কাঁপা গলায় বললেন, “সেদিন চেইনটা সেলিম চুরি করেনি রে টাবলু”
-তাহলে?
-ঐদিন রাতে তোর ঘরের বাথরুমে গিয়ে দেখি চেইনটা বাথরুমে পড়ে আছে।তুই স্নান করার সময় হয়তো কোনোভাবে পড়ে গিয়েছিল।
আকাশ ভেঙ্গে পড়লো টাবলুর মাথায়।
-তুমি সেটা আমাকে সেদিন বলোনি কেন,মা?
-আমি কোনোদিনই চাইনি সেলিমের মত একটা নিচু জাতের ছেলের সাথে তুই মিশিস।আমরা নিষেধ করলে তুই হয়তো কখনোই কথা শুনতি না।তাই একটা দুর্ঘটনার মাধ্যমে যখন সেলিমের সাথে তোর বন্ধুত্বটা নষ্ট হলো তখন সেটাকেই সুযোগ মনে করে আমি চুপ করে ছিলাম।আমাকে ক্ষমা করে দে,বাবা।
টাবলুর মনে হলো ওর পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে।গোটা দুনিয়াটা ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে।মেঝেতে বসে পড়লো টাবলু।
টাবলু তার আগের শহরে এসেছে সেলিমের খোঁজে।অনেক খোঁজ নিয়ে জানা গেল- টাবলুরা চলে যাওয়ার এক বছরের মাথায় সেলিমের বাবা মারা যায়। তারপর সেলিম কোথায় গেছে তা কেউ জানেনা।সেলিমের বাবার কোনো সম্পত্তি না থাকায় তার চাচা মামারাও সেলিমকে নিয়ে আর মাথা ঘামায়নি।
অঝোরে কাঁদতে লাগলো টাবলু।তার কানে সেলিমের সেই প্রথমদিনের কথাটা বাজতে লাগলো-আমার কোনো বন্ধু নাই।তুমি আমার বন্ধু হবা?….
আসলে সেলিমের প্যান্টের পকেটে সেদিন যে সোনার চেইনটা ছিল সেটা ছিল সেলিমের নিজের চেইন।ওর মায়ের মৃত্যুর আগে যেবার ওর জন্মদিন হলো,সেবার মা টাকা জমিয়ে চেইনটা দিয়েছিল ওকে।প্রিয় বন্ধুর জন্মদিনে কোনো ভালো উপহার দেয়ার সামর্থ্য না থাকায় মায়ের ঐ স্মৃতিই উপহারস্বরূপ পকেটে করে নিয়ে গিয়েছিল সেলিম।ভেবেছিল টাবলু খুব খুশি হবে।কিন্তু হায়!পরিস্থিতি এমন হবে তা কি সে ভাবতে পেরেছিল?ইচ্ছা করলেই হয়তো টাবলুকে সত্যটা বলতে পারতো সেলিম।টাবলু বুঝতোও।কিন্তু সেলিমের কথা না শুনেই টাবলুর চোখে সেলিমের প্রতি ঘৃণা দেখে আর সত্যটা প্রকাশ করেনি সে।খানিকটা অভিমানেই বলা চলে।তাও টাবলুরা চলে আসার দিন বলার জন্য গিয়েছিলও একবার।কিন্তু টাবলু তাকে ধাক্কা মেরে চলে গিয়েছিল।সেলিম পড়ে ছিল রাস্তায়।
কলমে- দীপা সিকদার জ্যোতি