বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা সবচেয়ে বেশি আঘাত হেনেছে সাগরের মধ্যে আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিনে। আজ রোববার বেলা দুইটা থেকে বিকেল সোয়া পাঁচটা পর্যন্ত তিন ঘণ্টার তাণ্ডবে দ্বীপটির অন্তত ৯০০ কাঁচা ও টিনের আধা পাকা ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। ৪২০টি নারকেলগাছসহ অন্তত ৩ হাজার গাছগাছালির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ঝড়ে আহত হয়েছেন ১১ জন। এ ছাড়া জলোচ্ছ্বাসে দ্বীপটির উত্তর পাড়া, পশ্চিম পাড়া ও পূর্ব দিকের কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় শুরুর আগে দ্বীপের ৩টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, ৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ৩৭টি হোটেল-রিসোর্ট-কটেজে স্থানীয় প্রায় ৬ হাজার বাসিন্দাকে সরিয়ে আনা হয়েছিল। যাঁদের বেশির ভাগই শিশু ও নারী। রোববার সন্ধ্যায় ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব থামার পর তাঁরা আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে বাড়িতে ফিরে যান।
মোখার টানা তিন ঘণ্টার তাণ্ডবকে ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের চেয়ে শক্তিশালী দাবি করেন সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান। সন্ধ্যায় তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখা যখন সেন্ট মার্টিনে আঘাত হানে, তখন সাগরে ভাটা চলছিল। মরা কাটাল থাকায় জোয়ারের উচ্চতাও কম ছিল। মোখার গতিবেগ ছিল ১৮০ থেকে ১৯০ কিলোমিটার।
কয়েক দশকের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ইউপি চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখার ভয়াবহতা নিয়ে শুরু থেকে প্রচার-প্রচারণা চালানোয় সেন্ট মার্টিনের বাসিন্দারা আতঙ্কে ছিলেন। ব্যাপক প্রচারণার কারণে দ্বীপের প্রায় ৬ হাজার বাসিন্দা আগেভাগে আশ্রয়কেন্দ্রে ওঠেন। গত কয়েক দশকে এত মানুষকে ঘরবাড়ি ছেড়ে তিনি আশ্রয়কেন্দ্রে উঠতে দেখেননি। এ কারণে তিন ঘণ্টার তাণ্ডবে কারও প্রাণহানি ঘটেনি।
ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক তথ্য উল্লেখ করে ইউপি চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, সন্ধ্যা পর্যন্ত খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছেন, সেন্ট মার্টিনে ৭০০টি কাঁচা ঘরবাড়ি ও ২০০টি টিনের আধা পাকা বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৬০০টি কাঁচা ও ২৫টি টিনের ঘর সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে। পুরো দ্বীপে ৪২০টি নারকেলগাছ ভেঙে পড়েছে। এ ছাড়া তিন হাজারের মতো বিভিন্ন গাছগাছালি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কয়েক কিলোমিটার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গৃহহীন মানুষেরা স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে তাঁদের দ্রুত পুনর্বাসন করতে হবে। এ জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করেন।
ঘূর্ণিঝড়ে দ্বীপের পশ্চিম পাড়া এলাকার জেলে মকবুল আহমদের (৫১) ত্রিপলের ছাউনির ঘরটি উড়ে গেছে। পরিবারের পাঁচ সদস্য নিয়ে মকবুল পাশের একটি বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। মকবুল আহমদ বলেন, বেলা সোয়া দুইটার দিকে ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে তাঁর ঘরটি উড়িয়ে নিয়ে যায়। তখন তিনিসহ পরিবারের সদস্যরা পাশের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছিলেন।
পশ্চিম পাড়ার বশির আহমদের (৭৫) টিনের পাকা বাড়িও ভেঙে গেছে ঘূর্ণিঝড়ে। বশির আহমদ বলেন, বেলা দুইটার দিকে হঠাৎ ঝোড়ো হাওয়া শুরু হয়। আধা ঘণ্টার ব্যবধানে তাঁর টিনের ঘরটি উড়ে যায়। তখন তিনিসহ পরিবারের ছয়জন পাশের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলেন। ঘরবাড়ি হারিয়ে দিশাহারা মাঝিরপাড়ার ব্যবসায়ী কবির আহমদ (৩৫) বলেন, সাগরে মাছ ধরেই তাঁর সংসার চলে। এখন নতুন করে মাথা গোঁজার ঠাঁই নিয়ে তিনি দুশ্চিন্তায় আছেন।
বেলা তিনটার দিকে যখন ঘূর্ণিঝড় দ্বীপে তাণ্ডব শুরু করে, তখন আশ্রয়কেন্দ্রে লোকজন ভয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দেন। অনেকে বিপদ থেকে বাঁচতে আজান দিতে থাকেন। কেউ কেউ হাত তুলে আল্লাহকে স্মরণ করেন। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ উলামা পরিষদের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মাওলানা নুর মোহাম্মদ (৫৩) বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখা নিয়ে শুরু থেকেই দ্বীপের মানুষ আতঙ্কে ছিলেন। আল্লাহর রহমত ছিল বলেই মানুষগুলো প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন।
সেন্ট মার্টিনে দুই দফায় ১০ বছর ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন ফিরোজ আহমদ খান। দুর্যোগ মোকাবিলার তাঁর অভিজ্ঞতাও অনেক। ঘূর্ণিঝড় মোখা নিয়ে তিনিও আতঙ্কগ্রস্ত ছিলেন। তিনি বলেন, গত বছর ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের সময়ও দ্বীপের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে প্রচারণা চালানো হয়েছিল। কিন্তু সিত্রাংয়ের তেমন প্রভাব পড়েনি। কিছু গাছ ও ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এবারের ঝড়ে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে ছিল সেন্ট মার্টিন। ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবও চলেছে সেন্ট মার্টিনে। এর সঙ্গে জলোচ্ছ্বাস হলে পুরো দ্বীপ লন্ডভন্ড হয়ে যেত। আল্লাহর রহমত ছিল বলে ক্ষয়ক্ষতি সেভাবে হয়নি।